দিলশানা পারুল:
ডিনায়াল ইজ দ্যা পাওয়ার। প্রত্যেকটা অপরাধ গোড়ায় পানি পায় ডিনাই করার মধ্য দিয়ে। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার চারটি স্তর থাকে, ব্যক্তিগত পর্যায়, পরিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়। ধরেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে ব্যাংক এর অর্থ ডাকাতি করবে, সে একদিনে এই জায়গায় আসে না। তার শুরু হয় ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছোট ছোট চুরি করার মধ্য দিয়ে। প্রথম সে নিজে অস্বীকার করে, চুরি যে একটা অপরাধ এইটাই সে মনে করে না। তারপর চোরের পরিবার, তারা বিশ্বাসই করতে চায় না যে তাদের ঘরের ছেলে চোর হতে পারে। ঘরের ছেলে চুরি করার জন্য আরো একটু হালে পানি পায়। সমাজের চোখে ছেলে ভালো কাজেই সে চোর হতেই পারে না, ডিনায়াল।
রাষ্ট্র মনেই করে না চুরি কোন অপরাধ, গৃহস্থ দুয়ার খোলা রাখলে চুরি তো হবেই। একজন ব্যক্তিকে এই চারটা স্তরে ডিনাই করার মধ্য দিয়ে ছিঁচকে চোর থেকে ব্যাংক ডাকাত বানিয়ে ফেলা হয়।
শুধু আমাদের দেশেই না, পৃথিবীব্যাপী যৌন নিপীড়ন এমন একটা অপরাধ যে অপরাধে অপরাধী সবসময়ই হালে পানি পেয়েছে, হালে পানি পায় এই চারটি স্তরে ডিনায়ালের মধ্য দিয়েই। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যৌন নিপীড়ন যে একটা অপরাধ, এইটাই কিন্তু অস্বীকৃত। নিপীড়ক কিন্তু কখনোই মনে করে না যে কোনো নারী বা শিশুর উপর যৌন নিপীড়ন করা অপরাধ। কারণ রাষ্ট্রিয়ভাবে যৌন নিপীড়নের ফলে নিপীড়কের বিচার হয়েছে এইটা প্রতিষ্ঠিত না, আমরা দেখি নাই।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এইটাকে ছেলেটার আলুর দোষ আছে এরকম একটা হালকা স্টেটমেন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা কখনোই যৌন নিপীড়নকে আমলে নেয় নাই। কিন্তু যদি ভিকটিমের উপর যৌন নিপীড়নের আফটার ইফেক্টকে প্যারামিটার হিসেবে ধরেন, তাহলে তার মনস্তাত্বিক ক্ষতির যে গভীরতা এবং সময় কালে স্থায়িত্ব, সেই অনুযায়ী যৌন নিপীড়ন অনেক বড় মাপের একটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু সেইটা হয় না।
আমার সব সময়ই এই চারটা স্তরে ডিনায়াল দেখে আসি। পরিবার এবং সমাজ নিপীড়ককে বাঁচানোর জন্য ক্রমাগত ডিনায়াল গেইম প্লে করতে থাকে। পরিবার সংশ্লিষ্ট লোকজন ভাবে আমার ছেলে, আমার চাচা, আমার স্যার, আমার বাবা এরকম করতেই পারে না। এইটা হতেই পারে না। সমাজ বলে, এতো বড় শিল্পী, এতো বড় লেখক, এতো বড় কবি, এতো বড় বিজ্ঞানী, এতো ভালো, প্রগতিশীল সাংবাদিক এরকম করতেই পারে না। আমি তাকে চিনি, আমি তাকে জানি, আমি তাকে বুঝি, আমরা একসাথে খেয়েছি, একসাথে চলেছি, একসাথে বলেছি, অতএব উনি এরকম করতেই পারেন না!
আমরা ভুলে যাই অথবা সমাজের ডিনায়াল মেকানিজম এতোই শক্তিশালী যে আমাদেরকে ভুলিয়ে দেয় প্রতিটি নিপীড়ক কোন না কোন পরিবারকে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিটি নিপীড়ক এই সমাজেরই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা সামাজিক জীব। তারা আপনার আমার মতই খায়-দায়, ঘুমায়, টিভি দেখে, হাসে, কাঁদে, সুযোগ পেলে একা নিরিবিলিতে নারী এবং শিশু পেলে যৌন নিপীড়নও করে।
পরিতাপের বিষয় যৌন নিপীড়কের মাথায় দুইটা শিং নাই, বড় বড় ড্রাকুলারের মতো দুইটা দাঁত নাই, মাথার চুল বেগুনীও না যে আপনি আলাদা করে তাদের চিনতে পারবেন। নিপীড়ককে আলাদা করে চেনার কোনো তরিকা নাই। যিনি যৌন নিপীড়ক, তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র, রক্ষা কবচ হচ্ছে এই সমাজ। নিপীড়ক জানে নিপীড়ন করলে প্রথমত ভিকটিম কাউকে বলবে না, কারণ এই সমাজ এ ভিকটিমকে দোষ দেয়া খুবই জনপ্রিয় একটা বিষয়। আর যদি বা বলেও, সমাজই নিপীড়ককে বাচাঁবে তার সামাজিক ভাবমূর্তির জন্য।
এই সমাজে পুরুষের ভাবমূর্তি বড় শক্ত জিনিষ, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটালেও ভাবমূর্তির জোরেই সে নিষ্কলুষিত থেকে যায়। আর মেয়েদের ইজ্জত এতোই ঠুনকো যে ‘আরে ওতো বেশ্যা’ বললেই মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হয়েও
বেশ্যায় পরিণত হয়ে যায়।
মিটু আন্দোলনটা যেটা করছে এই ভিকটিমের চুপ থাকার ধারণাটাকে সপাটে চপেটাঘাত করছে। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র এই তিনটি স্তরে ডিনায়াল এর যে খেলা চলে সেইটাকে সপাটে চপেটাঘাত করছে। এই সমাজ গড়তে হলে ভাংতে হবে। আর ভাংতে হলে মেয়েগুলোকে কথা বলতে দিতে হবে।