আপনার চেয়ে আপন যে জন

শাহরিয়া খান দিনা:

এক বন্ধু সেদিন জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বলতো মানুষ কেন বিয়ে করে?

– শারীরিক চাহিদা এবং মানসিক প্রশান্তির আশায়! পরিবার গড়ার লক্ষ্যে।

– প্রথমাংশ ঠিক বলেছো, কিন্তু পরের অংশের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। আসলে ছেলেরা কেন বিয়ে করে জানো?

মা অসুস্থ হলে তাকে দেখাশোনার জন্য।

ঘরে কাজের লোকের অভাব হলে কাজ করার জন্য।

বাবা মৃত্যুশয্যায় তাকে বউ দেখানোর আশায়।

আর মেয়েরা বিয়ে করে, নিরাপত্তার আশায়। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। অনেকটা ইন্স্যুরেন্সের মতো।

বিয়ের সাথে আসলে প্রেম ভালোবাসার কোনো ব্যাপার নেই।

আসলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আমাদের সামাজিকতায় বিয়ে মানে এইসব কারণগুলো বলা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক নয়। বিয়ের প্রথম রাতেই সম্পূর্ণ অপরিচিত দুজন মানুষকে একঘরে থাকতে দেয়া হচ্ছে। আবার ছেলেটাকে দুধ-ডিম খাইয়ে পাঠানো হচ্ছে বাসর ঘরে।

কেন রে ভাই! এখানে কী প্রমাণ করার আছে? যুদ্ধ করতে যাচ্ছো? আর যদি যুদ্ধই হয়, তো প্রতিপক্ষকেও শক্তিশালী করো। দুর্বলের সাথে যুদ্ধ জয় তো কাপুরুষতা। প্রথমদিনে তুমি পুরুষত্ব দেখাতে গিয়ে আসলে কাপুরুষতা দেখাচ্ছো। এদেশে এ্যারেঞ্জ ম্যারেঞ্জে বেশিরভাগ মেয়েই বাসর রাতে স্রেফ ধর্ষণের শিকার হয়।

সমাজে বিয়েকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি ও অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যখন কেউ বিয়ে করেন, তখন সবাই তাকে স্বীকৃতি দেয় এবং তার জন্য আনন্দ করে। বিয়ে যেন সমাজের প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রতীক, একটি সম্পর্ককে বৈধতা দান। বিবাহিত ব্যক্তিকে সমাজ ও পরিবারে দায়িত্ববান এবং প্রাপ্তবয়স্ক বলে বিবেচনা করা হয়। সত্যিকারের ‘প্রাপ্তবয়স্ক’!

বিয়েতে নারীর সম্পর্ককে পুরুষের মালিকানায় বৈধতা দেওয়া হয়। দীর্ঘদিনের ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতার হাত ধরে এভাবেই বিয়ে হয়, পরিবার গড়ে উঠে, দেখে দেখেই আমরাও এমনটাই হয় মেনে নিয়েছি। এজন্যই ভালোবাসাহীন দাম্পত্যেও আমরা সুখী পরিবার বলে দেই।

বিয়ে ছেলেদের তুলনামূলক লাভবানই করে। তাদের জীবনটা আরেকটু গোছানো হয়। যাপিত জীবনে কিছু বাড়তি যত্ন যোগ হয়।

কিন্তু মেয়েদের বেলায় বিয়ে মানেই সুখী হয়ে গেলাম এমনটা নয়। মেয়েরা মুগ্ধ হতে চায়। গোসলের পরে চুলে তোয়ালে জড়ানো তাকে দেখে বলুক ‘তোমাকে অসম্ভব রূপবতী লাগছে’। রান্নার সময় পেছনে থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বলুক, ‘কী রান্না হচ্ছে?’

প্রাণ বাঁচাতে খাবার লাগে, মন বাঁচাতে মুগ্ধতা লাগে। দামি রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া বা ছুটিছাটায় দায়সারা দেশ/বিদেশ ভ্রমণও তুচ্ছ লাগে যদি সেখানে মুগ্ধ করার প্রয়াস না থাকে। ছেঁড়া জামাটাও রিপু করে চালিয়ে নেয়া যায় যদি ভালোবাসার ঘাটতি না থাকে।

প্রেম পূর্ণতা পায় শরীর ছুঁয়ে। শরীর ছোঁয়াই যদি লক্ষ্য হয়, তবে সেটা প্রেম নয় নিশ্চয়ই। ফন্দিফিকির করে বিছানায় নেয়া আর মন-প্রাণ উজার করো, কারোতে বিলীন হওয়া দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। শারীরিক প্রয়োজনীয়তা মেটাতে প্রেমের নাম দেয়াটা নোংরামি।

কেউ কেউ খুব সহজে যেমন বলে ফেলে ‘ভালোবাসি’ তেমনি ভালোবাসার মানুষ পাওয়াটাও খুব সহজলভ্য ভেবে নেন। একজন চলে গেলে ক্ষতি কি অন্যজন আসবে!

পৃথিবীটা অনেক বড়। প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের বসবাস এখানে। এখানের বাগানে অনেক ফুল ফুটে, আকাশে অনেক পাখি উড়ে। কেউ না কেউ আবার সহজেই এসে পড়ে বা পাওয়া যায় হয়তো।

তবে এমন যারা মনে করেন, তারা পায় না সত্যিকার ভালোবাসার সন্ধান। তারা জানে না কী করে একজন মানুষ হয় আরেকজনের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন, বেঁচে থাকার নিশ্বাস, আপনার চেয়েও আপন। চোখের আড়াল হয়েও একজন কী করে থেকে যায় অন্যের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই।

পৃথিবীতে যারা ভালোবাসা পায় না তারা যেমন হতভাগা তেমনি যারা ভালোবাসতে পারে না তারাও হতভাগা। আর এই পৃথিবীতে কেউ কখনওই কারও বিকল্প হয় না।

শেয়ার করুন: