অবাঞ্ছিত গর্ভপাত, রিপ্রডাকটিভ চয়েস কি মেয়েদের হাতেই থাকা উচিত নয়?

অপর্ণা গাঙ্গুলী:

একটা ভাবনা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় শুকতারাকে। একটি ছোট শিশু একটি বিরাট হলঘরের এক কোনায় বসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে, কিন্তু শুকতারা এক পা এক পা করে এগিয়েও শিশুটির নাগাল পাচ্ছে না। আমরা ভাবতেই পারি, এ এক মা হতে না পারা মেয়ের জীবনের জলছবি। কিন্তু যদি ভাবনাটা কিছুটা পাল্টে যায়? যদি বলি, এ ছবি এমন এক মায়ের, যে মা হতে হতেও মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে? নিজের সন্তানকে খুন করতে হয়েছে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে?
তখন? সেই মা কে কী বলবেন আপনারা?

আসল ঘটনাটা এইরকম। নয় মাসের অর্ককে নিয়ে সুখে শান্তিতে মাতৃত্বে যখন ভরে ছিল শুকতারা, ঠিক তখনি ঘটে গেলো এই বিপর্যয়। যথেষ্ট গর্ভনিরোধক সুব্যবস্থা নেবার পরও মাতৃত্ব এসে গেলো তার শরীরে। বিদেশি কপারটির সুরক্ষার পরও মাতৃত্ব আসতে পারে, ভাবতেই পারেনি সে। আর তার বুকের দুধে লালিত শিশু বলেই মেন্সট্রুয়েশনের চক্রটাও বুঝি উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছিলো। জানা যখন গেলো, তখন মাস তিনেক পার হয়ে গেছে। শুকতারাই বুঝেছিলো নিজে নিজেই, সেই এক মর্নিং সিকনেস, সেই বমি ভাব, অলসতা, সব মিলিয়ে প্রথমবারের মতোই। ডাক্তার শাশুড়ির দ্বারস্থ হয় শুকতারা। এবং তিনি সব শুনে এক বাক্যে রায় দেন – বাচ্চা নষ্ট করে দিতে। সেই মুহূর্তে এতোটার জন্যেও তৈরি ছিল না শুকতারা। বাচ্চা নষ্ট? সে কী? সে যে খুনের অন্য নাম? খুন করবে মা হয়ে নিজের সন্তানকে?

মাথা কুটে মরে শুকতারা। প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে সে, কেবল বলে, ওগো তোমরা দয়া করো আমাকে, এমন কাজ আমি করতে পারবো না প্রাণ থাকতে। প্রথম বাচ্চার দেখভালের জন্য গভর্নমেন্ট স্কুলের কাজ ছেড়ে দিয়েছি। এই বাচ্চাও ঠিক সামলে নেবো একলা হাতে। ওগো তোমরা ওকে ছেড়ে দাও গো, আমার মধ্যে ও বড় হোক, পৃথিবীর আলো দেখুক। এক অসহায় মায়ের ওই হৃদয়ভাঙা কান্না কিন্তু গলাতে পারেনি শ্বশুরবাড়ির কাউকেই। শুকতারার বাড়ির লোক স্থিরপ্রতিজ্ঞ, কিছুতেই একে রাখা যাবে না। এক্ষুণি দ্বিতীয় বাচ্চা এলে, প্রথম বাচ্চার সেবা শুশ্রুষা হবে না, এই ছিল ওদের বক্তব্য।

শাশুড়িমাতা ডাক্তার বলেই সেই সংসার যে মাতৃতান্ত্রিক, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। ভালো কথা। তবে স্বামী যে এতোবড়ো শিরদাঁড়াবিহীন এক অকর্মক ক্রিয়াপদ্ধতি, সেদিন জেনে লজ্জায়, ঘেন্নায়, মরমে মরেই গিয়েছিলো শুকতারা। ছুটে গিয়েছিলো মাতৃসমা ডাক্তার আরতির কাছে, যাঁর হাতে অর্ক জন্মেছে। তিনিও বললেন, তুমি মা, তুমি যা বলবে তাই হওয়া উচিত। কখনোই তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ ভ্রুণহত্যা সম্ভব নয়।

কিছুটা সাহস নিয়ে ফিরে এসে শুকতারা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তার স্বামী কাজকর্ম ভালোই করে, তবে প্রবল মদ্যপ, তাই সংসারে তার কথা চলে না। শুকতারার হাহাকার শুনে সেদিন তারারাও কেঁদেছিলো মনে পড়ে। ঝড় উঠেছিল প্রবল। তবু ওর সমস্ত বিনতি ধুয়ে মুছিয়ে দিয়ে ওকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল, তাও পাঁচ মাসে গর্ভপাত করিয়ে, প্রবল বিপদ মাথায় নিয়ে।

শুকতারার মনে তখন একটাই বল ছিল, ওর স্বামী বলেছিলো, এরপর মদ ত্যাগ করবে। সেদিন সারাদিন নার্সিং হোমে শুকতারার পাশেই ছিল ওর স্বামী। কিন্তু বাড়ি ফিরে সে কথা রাখেনি। প্রবল মদ্যপ হয়ে বেহেড হয়ে গিয়েছিলো। দুঃখ প্রকাশ করেছিল, সন্তানকে ধরে রাখতে পারলাম না।

যাক সে কথা, এমন অনেক ঘটনা দেখে নিয়েছে শুকতারা, বুঝে গেছে জীবনকে। পরদিন ওই শরীরে আবার ছেলেকে কোলে নিয়েছিল, হেসেছিলো, খেলেছিল ওই সবেধন নীলমণি বুকজোড়া একমাত্র ছেলেটিকে বুকে নিয়ে। আর তারপর থেকে ওই শিশুটির না জানা না চেনা মুখটি কল্পনা করে মনে মনে তাকে ভালোবেসেছিলো, আদর করেছিল, আশীর্বাদ করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল তার কাছে।

ভেবেছিলো, সন্তানকে হত্যা করার পরও মায়েরা কেমন বেঁচে থাকতে পারে! তবে এক্ষেত্রে শুকতারার কিছু করার ছিল না, কিচ্ছু না। তবু বলি, কিছুই কি ছিল না? ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে চলে গিয়ে দ্বিতীয় সন্তানকে বাঁচাতে পারতো না শুকতারা? কষ্ট হতো, কিন্তু সে কষ্ট সে মেনে নিলো না কেন?

কেন কেন কেন ওই ভ্রুণহত্যা?

সব মায়েদের বলছি, এবরশন কিন্তু কন্ট্রাসেপশানের নামান্তর নয়, এবরশন মানে খুন, জেনে বুঝে। শুকতারাদের মতো কোটি কোটি মায়েরা এই দায়ে দায়ী। আসুন, ঘুরে দাঁড়াই, রোধ করি অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব, আর সেটা না করতে পারলে রোধ করি অনর্থক ভ্রুণহত্যা। রিপ্রডাকটিভ চয়েস থাকুক মেয়েদের হাতেই।

তাই আজ যখন শক্তি ও সাহস দুই ফিরেছে তখন কেবল এক কলম লেখায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে জমা কালো রক্ত, এইভাবে সন্তান হারানো কোটি কোটি মায়ের নীরব কান্না হয়ে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.