বহু অনন্যা এভাবেই ঝরে যায় (একটি সত্য কাহিনী)

অরুণিমা মণ্ডল দাস:

দুই তিন বছর আগের কথা হবে … ঠিক আবছা, কিন্তু স্পষ্ট, তাই মেমোরি তে থেকে গেছে বলা যেতে পারে। আসলে জীবনে কাকতালীয় কিছুই নয় … ঘটনাগুলো কারো না কারো সংগে ঘটেই থাকে।

সবুজ প্রকৃতি ধানক্ষেত বৃষ্টি সবই যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই ঝড় খরা আমাদের খুব ক্ষতি করে— আনমনা প্রকৃতির খেয়ালের মতই আমাদের ভাগ্য ওঠানামা করছে—কখনও গ্রহের দোষ, কখনো বৃহস্পতির যোগ, কখনো মাহেন্দ্র যোগ ইত্যাদি ইত্যাদি!

কী বলুন তো, ভাগ্যটাকে আমাদের নিজেদের তৈরি করতে হবে—-সিঙাড়া খাবো ভেবে বসে থাকবো ভাবলে কেউ মুখে পুরে দেবে না … হয় গিয়ে না হয় চেয়ে খেতে হবে।

অনন্যা খুব সহজ সরল মেয়ে, বাবা-মা-ভাই-বোন নিয়ে সংসার, ক্লাশ টেন অবধি পড়ে ভাবলো কী আর হবে পড়ে!সংসারের হাল ধরতে কাজ শুরু করলো, টেইলারিং শিখে বাড়িতে মেশিন নিয়ে টুকটাক কাজ হতো, কিন্তু গ্রামের দিকে ঠিকঠাক ইনকাম হতো না।
সে ভাবলো শহরে যাবে, অনেক টাকা ইনকাম করবে, ভাইকে সাহায্য করবে, বাবা-মাকে সংসার চালাতে সাহায্য করবে।

একটা মেয়েকে সমাজে নিজের পায়ে দাঁড়াতে কতখানি স্ট্র্যাগল করতে হয় তা আমরা দেখতেই পাই— একটা মেয়ে বড় হলেই বাড়িতে ছেলেদের আনাগোনা লেগে যায়—বয়স্কদের উপদেশে দুইকান উপচে পড়ে। এইভাবে থাকতে হবে, এই করা যাবে না, ওই করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

অনন্যার ক্ষেত্রে অনন্যার মা একটু অন্যরকম ছিলেন, অনন্যাকে শহরে কাজ করতে যেতে বাধা দিলেন না! গরিবী মানুষকে সবকিছুই করাতে বাধ্য করায়। যে বয়সে ক্যারিয়ার গড়ার বয়স! হাসি খুশি থাকার, খেলাধূলা করার বয়স, সেই বয়সে শহরের কল সেন্টার, শপিং মল, যেকোনো প্রাইভেট কোম্পানির দুয়ারে দুয়ারে কাজের জন্য ঘুরতে হয়েছে অনন্যাকে … যন্ত্রণা, ধিক্কার, কষ্ট সব বুকে চেপে তাকে হাসিমুখে কাজ করে যেতে হতো শুধুমাত্র পরিবারের জন্য। প্রতিটি দিনের সকাল আর সন্ধ্যা তার কাছে শুধু কাজের দিন হিসেবেই চিহ্নিত থাকতো।

যাই হোক, অনন্যা শহরে একটা ছোট্ট ভাড়ারুমে থাকতো, কলসেন্টারে কাজ ও পেল, মোটামুটি যা ইনকাম হতো, নিজের চলে যেতো, আর যৎসামান্য টাকা বাড়িতে পাঠাতো। বেশকিছু মাস যাওয়ার পর সে ভাবলো তার অনেক টাকা ইনকাম প্রয়োজন, তাই মাঝে-মধ্যে নাইট শিফটও করতো। শরীরে কুলোতো না, মাঝেমধ্যে বমি বমি লাগতো, পেটে গ্যাস, জ্বর লেগেই থাকতো, তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বাড়ির কথা ভেবে কাজ করে যেত।

নাইট শিফট খুব বেশি করার কারণে শরীর ও পরপর ভেঙে পড়ছিল!

একদিনের একটা ঘটনা তার জীবনটা তছনছ করে দিল—ঘটনাটি সত্যি এবং মর্মান্তিক।

অনন্যার মা ছাড়া আর কোনো ক্লোজ ছেলেবন্ধু ছিল না বললেই চলে—অফিসের কলিগ বাড়িওয়ালার ছেলে ট্রাই করতো, প্রেম করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

সেই দিনটা ছিল শনিবার, হাফ ছুটি, অনন্যা নাইট শিফট ফিরে বাড়ি ফিরছিল। বলা যায়, একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরছিল। মনটা খুব ভালো। বস বলেছে সোমবার টাকা দেবে।

খাওয়া দাওয়া হয়নি তখনও। ভাবছিল গিয়ে কী রান্না করবে, একটু ঘুমিয়ে নিয়ে বেলার দিকে রান্না করে খাবে।

এই ভেবে ভেবে অফিস থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরলো। কিন্তু আজ মাঝ রাস্তায় কিছু দূর যাওয়ার পর ট্যাক্সি আর যেতে চাইলো না, অনেক ভাড়া চাইলো, ভাড়াবাড়ি একটু ভেতরে। এখন ভ্যান রিকশা পাওয়া অসম্ভব, শরীরও খুব দুর্বল লাগছে। এদিকে কেমন থমথমে পরিবেশ, ভয়ও লাগছে, কিন্তু বাড়ি তো ফিরতেই হবে।

একটা স্টপেজ পেরিয়ে মোড়ের মাথায় দেখলো মাতালদের আড্ডা—দুদিক থেকে তারা মদের বোতল ছোঁড়াছুড়ি করছে—নিজেদের মধ্যে নোংরা ভাষায় কথাবার্তা বলছিল।

অনন্যাকে দেখে তারা হঠাতই উঠে দাঁড়ালো, অনন্যা কিছু বলতে বা করতে যাবে বা প্রতিবাদ করতে কিছু করবে, সে সুযোগও পেল না।

চার-পাঁচজন মিলে জোর করে মুখ বেঁধে জামা কাপড় ছিঁড়তে শুরু করলো ওর।

হিংস্র বাঘের মতো তারা অনন্যাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেললো—প্রায় আধঘন্টা ধরে চললো নারকীয় এই কাজকর্ম।

অনন্যার কথা বলার শক্তি ছিল না— সে প্রায় অর্ধমৃত— সেই অবস্থায় মাতালরা যৌনাঙ্গে বোতল ঢুকিয়ে পালিয়ে যায়। তিনঘন্টা পর মানুষের নজরে আসে… তখন তার শরীর রক্ত ঝরতে ঝরতে এক লাশে পরিণত হয়েছে।

এই হচ্ছে আধুনিকতার ভয়ঙ্কর পরিণাম! পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে অনন্যার পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়ে, একটা ফুলের মতো জীবন অকালে ঝরে যায়?

আপনারা বলতে পারেন এর জন্য দায়ী কে? অনন্যা? সমাজ? মাতালরা? শাসনব্যবস্থা?

কাকদ্বীপ, পশ্চিমবঙ্গ

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.