‘সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশন’ই অনলাইন হয়রানির কারণ

জয়নাল আবেদীন:

নাসিরের বোন, সাকিবের বউ, লিটনের ফ্ল্যাট কিংবা তাসকিনের বাচ্চা… প্রতিটা ইস্যুর পেছনে- সামনে-ভেতরে-বাইরে যে কারণটা কাজ করে সেটা আর কিছুই না, “সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশন”।

সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশন জিনিষটার স্বরূপ একটু সহজ করে ব্যাখা করি।

যারা বিভিন্ন দেশের মুভি দেখে অভ্যস্ত, তারা বাইরের মুভি আর উপমহাদেশের মুভির ভেতর একটা পার্থক্য লক্ষ্য করার কথা। বাইরের মুভিতে প্রচুর পরিমাণে বেড সিন থাকে। চুমু খাওয়া তো শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার মতোই স্বাভাবিক ঘটনা। কিছু কিছু জায়গায় শারীরিক সম্পর্কের পুরো প্রক্রিয়াটাই তারা দেখিয়ে ফেলে। আমরা এমন দেখে প্রায়ই আঁৎকে উঠি। কী অশ্লীল! কীভাবে সম্ভব ভেবে অবাক হই।

কিন্তু একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন, তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশিই শ্লীল। তারা নারীকে “সেক্সুয়াল এলিমেন্ট” হিসেবে ব্যবহার করে না। তারা সেই জিনিষটাই দেখাচ্ছে যেটা একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে করে অভ্যস্ত, একজন প্রেমিক “সুযোগ পেলে” প্রেমিকার সাথে করে থাকে। রেইপের সিন তারা রেইপের মতো করেই দেখায়। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বিশেষ ভঙ্গীতে নায়িকার ঠোঁট কামড়ানো, পশ্চাৎদেশ দুলিয়ে হাঁটা, একটু কায়দা করে বুকের একাংশ দেখানো, নাভি বা নিতম্বের কারুকাজ তাদের মুভিতে নেই।

আমাদের মুভিতে এই জিনিষ তাহলে কেন আসে?
এই যে সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশন। সেক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড জনগোষ্ঠীর কাছে এই দৃশ্যগুলোই প্রাণ, এগুলোই তাদের কল্পনার খোরাক। একটা নারীদেহ মানেই ফ্যান্টাসি, একটা নারীদেহ মানেই এক অসম্ভব এভভেঞ্চার।

এই ফ্রাস্ট্রেশনের উৎস কী?

এই নিয়ে বহু লেখালেখি হয়ে গেছে।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটা বিরাট জটিল। ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় আইনের প্রয়োগ এবং অপব্যবহারের যে অসামঞ্জস্যতা, সেখান থেকে আরো অনেক সমস্যার মতোই সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশনের উৎপত্তি। আমার কোমরের মাপ ৩২, আমাকে বলা হলো প্যান্ট পরতেই হবে, কিন্তু আন্ডারওয়ার পরা যাবে না। প্যান্টের সাইজ ৩৮, কিন্তু ব্যাল্ট পরার নিয়ম সমাজে নেই। তো কী হবে? আমি সব প্রক্রিয়ার শেষে ন্যাংটা হবো। কিন্তু সমাজ চেঁচিয়ে লাঠিসোটা নিয়ে এসে বলবে, তুমি ন্যাংটা কেন? তোমাকে তো ঠিকই প্যান্ট দেয়া হয়েছিল। প্যান্ট পরা সংশ্লিষ্ট যে সিস্টেম লস, সেটা কেউ দেখবে না।

একটা ছেলেমেয়ে এডাল্ট হচ্ছে ১৫-১৭ বছরে। শারীরিক সব রকমের চাহিদা তার ভেতরে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তার শরীর যখন বিয়ের জন্য পুরোপুরি তৈরি, তখনই সমাজ বলছে, “বাবু ওয়েট, দাঁড়ানো শেখো। তারপর বিয়ে।” বাবু দাঁড়াতে দাঁড়াতে পেরিয়ে যায় আড়াই যুগ। এই সময়ের মধ্যে একটা মানুষ তার যৌন চাহিদাকে কতদিন নিয়ন্ত্রণে রাখবে?

হ্যাঁ, রাখা সম্ভব। তিন যুগের বেশি সময় কাটানো অনেক মানুষই জীবনে কখনোই প্রকাশ্যে কথা, অঙ্গভঙ্গি দিয়ে অসভ্যতা করেননি। সেই সংখ্যাটা কতো? কজন পারে? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন কীভাবে পারবে তারা?

এদেশে যৌন শিক্ষা বলে কিছুই নেই। বিষয়টাকে আমরা এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছি যে প্রকাশ্যে আলোচনা করা নিষিদ্ধ, কিন্তু গোপনে সবই সিদ্ধ। কজন বাবা নিজের মেয়ের সাথে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলতে পারেন? কটা ছেলে তার বোন সুস্থ আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে পারে? একবিংশ শতাব্দির এই সময়ে এসে একটা মেয়েকে কেন সেনোরার প্যাকেটটা পত্রিকার কাগজে মুড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে? এতো লজ্জা আমাদের? এতো লজ্জা?

অথচ যারাই ভার্সিটি-কলেজ এমনকি স্কুল লেভেলে পড়াশোনা করেছেন, সবাই-ই জানেন বন্ধুদের মধ্যে যৌনতা
নিয়ে কত বিস্তৃত আলোচনা হয়। না, সেটা সুস্থ আলোচনা না। কোনো মেয়ের কিসের সাইজ কত, কোনো মেয়েটাকে কে পাইলে কী করতো, কোনো মেয়েকে কোন ছেলে কী করেছে… ইত্যাদি ছাপার অযোগ্য কথাবার্তা। মেয়েদের কথা বলতে পারি না, তবে ছেলেদের আলোচনার আড্ডার একটা বড় সময় জুড়েই নারী শরীরের প্রতি ইঞ্চির পোস্ট মর্টেম হয়। যে বান্ধবীর সাথে সারাদিন ঘোরাফেরা করেছে, তাকে নিয়ে সর্বোচ্চ রসালো আলাপ করতে পারে অনেক ছেলে।

কেন?

কারণ কৌতুহল, এ্যাডভেঞ্চার, ফ্যান্টাসি। ঐ যে শুরুতেই বললাম নারী মানেই বিরাট এক আগ্রহের জায়গা। একটা জিনিষের প্রতি তার চাহিদা আছে, এলিমেন্ট চোখের সামনে দিয়েই ঘুরছে.. অথচ সে কিছুই করতে পারছে না.. তখনই জন্ম নেয় ফ্রাস্ট্রেশন, ফ্যান্টাসি। নিজের হাতের কাছের যে পুরাকীর্তিতে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ, সেটা নিয়ে কৌতুহল কখনোই কমে না। ছেলেদের মাথার ভেতরেও একটা সময় পরে নারীদেহ স্থায়ীভাবে জুড়ে বসে।

আমাদের সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশন, এক্সপেক্টেশন, আপিল এমন জায়গায় চলে গেছে যে প্রতিটা শব্দকেই আমরা সেক্স এলিমেন্ট বানিয়ে নিয়েছি। শব্দগুলো টাইপ করতে অস্বস্তি লাগছে। ভাবুন তো কতটা ফলকে আমরা সেক্সের সমার্থক করেছি? কতটা তরকারিকে করেছি? কতটা নিরীহ শব্দ আছে যেটা এখন মনের ভুলে উচ্চারণ করে লজ্জায় পড়ে যান?
কেন?

ঐ ফ্যান্টাসি, ফ্যান্টাসি এবং ফ্যান্টাসি। আমাদের জগতটা এমনভাবে তৈরি হয়ে গেছে যে, যেদিকেই তাকাবেন, যাই ভাববেন, যৌনতার কোনো না কোনো নিদর্শন চলে আসবে। যে যাই বলেন, দ্বিমত করেন; এটাই সত্য।

এখন বলতে পারেন কেবল অবদমিত যৌন বাসনার জন্যই অসভ্য হতে হবে? নাসিরের বোন, সাকিবের বউ বা তাসকিনের বাচ্চার জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে? যৌনতাকে সহজ করে দিলেই সমস্যার সমাধান নিশ্চিত?

সবকটার উত্তর হচ্ছে, না। আমাদের সামাজিক সেটআপ না পাল্টানো পর্যন্ত কোনোকিছুই সমাধান আনবে না। ২০ বছর বয়সে যে বিয়ে করেছে সেও অসভ্যতা করবে, ৬০ বছরের বৃদ্ধও সুযোগ পেলে মেয়েদের গায়ে হাত দেবে। সামাজিক সেটআপটা কী আসলে?

যারা যারা এতোক্ষণ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হলেও আমার বক্তব্যকে হজম করতে পেরেছেন, তারা এবার গালি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হোন। গালি খাওয়ার জন্যই কিছু কথা বলবো।

সামাজিক সেটআপ মানে কিছু ডিলিট কিছু এডিট না; টোটাল ফরম্যাট। শুরুতেই নারীকে প্রকৃত সম্মানটুকু দিতে হবে।

আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, আমরা যখন “সেক্স” ব্যাপারটার কথা ভাবি, তখন নারীকে কীভাবে চিন্তা করি? আমরা ধরেই নিই নারী এই প্রক্রিয়ায় কর্ম কারক, ক্ষেত্রবিশেষে করণ। কর্তৃকারক সর্বদাই পুরুষ। একটা শারীরিক সম্পর্ক মানেই নারীকে “ব্যবহার” করা হয়েছে, নারীকে “লাগানো” হয়েছে, “মারা” দেয়া হয়েছে.. এই তো?
যে পুরুষটি কর্মের অংশীদার, সে এখানে হিরো। সে কাজটা করতে পেরেছে। যত অসম্মান সব নারীটিরই, কারণ কেউ একজন তাকে “লাগিয়ে” দিয়েছে। সুস্থ মাথায় বলুন ধারণাটা কি ঠিক? সম্মান-অসম্মানের ভাগ সমান সমান হওয়া উচিত না?

না না, ভুল বুঝবেন না। আমি নারীবাদী আলাপ করছি না। স্রেফ সেটআপ নিয়ে বলছি। এই যে সাকিবের নিরীহ বউ, নাসিরের নিরীহ বোন, তাসকিনের অবুঝ বাচ্চাটা অপদস্থ হলো, কারণ কী? তারা দোষ করেছে? তারা ভুল করেছে? কেন গালিটা নাসিরের ভাইকে দেয়া হলো না, কেন সাকিবের বাবাকে না, কেন তাসকিনের বাবাকে গিয়ে প্রশ্ন করা হলো না, আপনার ছেলের বাচ্চা এতো আগে কেন?

বিলিভ করুন, তাসকিন বউকে স্কিপ করে যদি কেবল বাচ্চার ছবি দিত, এতো কথা আসতো না। জনগণ তার বাচ্চা না, তার বউয়ের দিকে তাকিয়েছে, কল্পনা করেছে তারা কীভাবে “মজা” করে বাচ্চাটার জন্ম দিল। তারপর উর্বর মস্তিষ্ক ব্যবহার করে কমেন্টের জোয়ার এনেছে।
ইসলাম বলেছে, একজন নারীর দিকে একবার ভুল করে তাকানোর পর দ্বিতীয়বার তাকানো হারাম। তাহলে সাকিবের বউকে যারা পর্দা করতে বলছে, তারা গোড়াতেই কেন ইসলামের একট নীতি ভাঙবে? যে সত্যিই পর্দানুসারী, সে নিশ্চয়ই সাকিবের বউকে বারবার দেখে কমেন্ট করতে যাবে না। এরা স্রেফ সাকিবের স্ত্রীকে পাখির চোখে দেখে, এতো সুন্দর স্ত্রীকে নিয়ে সাকিব কত কী করে সেটা ভেবে রোমাঞ্চকর আফসোস করে, তারপর নিজের দেখাটাকে নিজের কাছেই হালাল করার জন্য পর্দার ওয়াজ করে বসে।

যে সামাজিক সেটআপের কথা বলছি তার অংশ আমি, আপনি, সাকিব, নাসির, তাসকিনও। আমরা সবাই যখন মেনে নিচ্ছি একটা সমাজে নারী মানেই ভোগ্য গণ্য, শারীরিক সম্পর্কে নারী কেবলই “খেলনা”… তার সমস্ত পরিচয় একজনের “মারা খাওয়ার” মধ্যেই তখন এই “যৌন সন্ত্রাসীদের” উদ্ভব কেন ঘটবে না? কীভাবে আমাদের স্ত্রী, বোন, কন্যার নিরাপত্তা আমরা আশা করি?

সামাজিক সেটআপের আরো ব্যাপার আছে। বলতে যখন বসেছি সবটাই বলে ফেলি।

আমাদের জীবনে, আমাদের মনোজগতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে কী কী জিনিষ?

১। জীবনের প্রথম পর্যায়েই আমরা ধর্মীয় এবং পারিবারিক শিক্ষা পাই।

২। একটু বড় হলে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা। শিক্ষদের আদেশ-উপদেশ।

৩। ইসলামী বক্তাদের ওয়াজ

৪। টেলিভিশন।

মোটা দাগে বলতে গেলে এসবই আমাদের চলার এবং ভাবনার পথ নির্ধারণ করে দেয়। এখন একটা একটা করে পয়েন্ট ধরে আলোচনা করি।

পরিবার আমাদের কতটা সুশিক্ষা দিচ্ছে বলুন তো? আলোচনা কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার জন্য শুধু যৌনতা নিয়েই কথা বলি। সত্যি করে বলুন তো, কতটা পরিবারের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে? কয়টা কাপল ভালোবাসা নিয়ে সংসার করছে? কয়টা বিয়ে জোর করে দেয়া? কতটা ফ্যামেলিতে স্বামী স্ত্রী নামক বস্তুকে অহরহ পেটায়?

স্রেফ তিন কবুল বলার পরই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। ন্যূনতম পর্যায়ে হলেও একটা মানসিক সম্পর্ক থাকতে হয়। যখনই একটা পরিবারে নারীর ভূমিকা হয়ে দাসীর মতো, তখনই মূলত সমস্যার শুরু। ঐ পরিবারের একটা বাচ্চা আর স্বাভাবিকভাবে বড় হতে পারবে না। যে নারীকে পেটানো যায়, ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা যায়, ইচ্ছা ফুরিয়ে গেলে মার্ডারও করা যায়; তিন কবুলের মহান পর্দায় সমাজ এ ব্যাপারে মোটামুটি নির্লিপ্তই থাকে, সেখানে একটা বাচ্চার প্রিম্যাচিউর সাইকোলজিতে নারী নেমে যায় বহু নিচে।
না, সব পরিবারেই এমন হচ্ছে তা না। কিন্তু আশেপাশে পত্র- পত্রিকায় ঘটে যাওয়া সমস্যা দেখে একটা বাচ্চা মেসেজটা সহজেই পিক করে ফেলে। নারী এই সমাজে কিচ্ছু না, স্রেফ কিচ্ছু না। সুতরাং তুমি সাকিবের বউ, নাসিরের বোন, জুকারবার্গের প্রেমিকা আর যাই হও না কেন… আমার কাছে তুমি কিস্যু না। তোমার সম্মান আমার কাছে নেই।

সেক্স এডুকেশনের অভাবের কথা শুরুতেই বলে ফেলেছি। আমাদের স্কুল- কলেজ “যৌনতা” ব্যাপারে আমাদের কিচ্ছু শেখায় না। যৌনতা কী, যৌনতার ব্যবহার কিসে, যৌনতার সুস্থ ব্যবহার কীভাবে করতে হবে, কী করে সামলে রাখতে হবে তার কোনো রকম দিক নির্দেশনা আমাদের কাছে নেই। অথচ স্কুল থেকেই সবার ভেতরে এক রাক্ষসের জন্ম হতে শুরু করে। সেটাকে কীভাবে পোষ মানাতে হবে, কেউ জানে না।

জানার যে পথ সামনে আসে সেটা ভয়ানক। এক সময় ছিল হার্ডকপি বই। এখন ইন্টারনেট, ভিডিও। এসব জিনিষ দিনের শেষে সবচেয়ে বড় যে কুশিক্ষাটা দিচ্ছে সেটা হলো প্রতিটা মেয়ের ভেতরেই ভীষণ যৌনক্ষিধে। স্কুলের শিক্ষিকা, ঘরের ভাবী, ক্লাসের বান্ধবী তো বটেই… নিজের মা, মামী, চাচী এমনকি বোন বা মা ও পর্যন্ত সেখানে নিরাপদ না। খুব বড় ভুল একটা মনোগজত গড়ে ওঠে। প্রতিটা মেয়ে, প্রতিটা নারী যৌনকাতর এই ভাবনা যে কতটা ভয়ানক সেটা ব্যাপারে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে।

সুতরাং ফলাফল কী দাঁড়াচ্ছে? আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা স্কুল যৌন শিক্ষা দিতে অপারগতা কিংবা লজ্জা পেলে শিক্ষা থেমে নেই। ভয়ানক গতিতে শিক্ষা আঘাত হানছে বিভিন্ন জায়গায়। তাতে বালির ঘরেই মতোই ভেঙে যাচ্ছে মূল্যবোধ।

স্পর্শকাতর জায়গাটাতে এবার আসি।
ইউটিউব ফেসবুকের কল্যাণে সাম্প্রতিক কিছু ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। ওয়াজের ভিডিও। কী ভয়ানক, বীভৎস বক্তব্য!

ব্যাপারটা নতুন না। আমাদের অধিকাংশ ওয়াজ মানেই একটা বড় সময়জুড়ে নারীর বদনাম, নারীর ত্রুটি, নারীর অন্যায়- করণীয় এবং পরকালে নারী কত কঠিন শাস্তি পাবে তার বর্ণনা থাকে। বক্তা পুরুষ, অডিয়েন্স পুরুষ… নারীবিদ্বেষী এসব আলোচনা তাই জমতে সময় লাগে না। আপনি আমাকে যত ইচ্ছা গালি দিতে পারেন। কিন্তু ওয়াজ মাহফিলই নারীর অবমূল্যায়ণের আতুড়ঘর, এটা অস্বীকার করতে পারবেন না।

শুধু একটা উদাহরণ দিই। আমি ম্যাচিউর হবার আগে পরে ওয়াজের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ বার শুনেছি “যে নারীর স্বামীর শারীরিক সম্পর্কের ডাকে সাথে সাথে সাড়া দিতে অনাগ্রহ দেখায়, তার উপর ফেরেশতাদের লানত পড়ে। সে সরাসরি জাহান্নামী।”

সিরিয়াসলি! একটা নারীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা না করেই এরকম জাজমেন্ট দেয়া যায়? মহিলাটি অসুস্থ হতে পারে, মানসিকভাবে তৈরি নাও থাকতে পারে। পুরুষটির নিশ্চয়ই সেখানে দায়িত্ব কর্তব্য বা ভাবনার ব্যাপার আছে। সেটাকে বিবেচনা আলোচনায় না এনে সরাসরি এমন নির্দেশ নারীকে আর স্ত্রী রাখে না, পতিতা বানিয়ে ফেলে।

এই ব্যাপারে আর বলার ইচ্ছে থাকলেও বলছি না। আমার ধারণা বংশ উদ্ধারের গালি খাওয়ার মতো যথেষ্ট অপরাধ ইতোমধ্যে করে ফেলেছি।

আসি টেলিভিশনে।
টেলিভিশন ব্যাপারে আগেই কিছু কথা বলে ফেলেছি। টেলিভিশন মিডিয়াই সম্ভবত নারীর সবচেয়ে বেশি কর্মস্থানের একটি প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু মিডিয়া বা টিভি নারীকে কতটা সম্মান দিচ্ছে?

একটা শেভিং ক্রিমের এডে কেন নারী থাকবে? পুরুষের বগলের সুগন্ধির লোভে এক ঝাঁক নারী কেন পেছন পেছন দৌঁড়াবে? সিনেমায় কোনো বিশেষ কারণ বা দরকার ছাড়া কেন নারীর নাভী দেখাতে হবে?

বোঝা যাচ্ছে না নারী কেবলই “এলিমেন্ট”। খুবই সস্তা একটা জিনিষ। বগলে সুগন্ধি মাখলেই এরা পেছন পেছন দৌঁড়ায়, সুন্দর বাইক দেখলেই কুকুরের মতো পেছনে ঝাঁপ মারে। সম্মান বাড়ছে ভাই?

কথা বলছিলাম সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশন নিয়ে। আলোচনা সঙ্গত কারণেই নারীবাদের দিকে চলে গেছে। কারণ হ্যারেজমেন্ট মানেই নারী, সেক্স মানেই অবধারিতবাবে নারীর উপস্থিতি আছে। তাই আলোচনা সেদিকে যেতে বাধ্য।

আলোচনার লাগাম টানবো। অনেক প্রশ্নের তৈরি করে ফেলেছি। আপনি বলতে পারেন নারীর অসম্মানের পেছনে দোষ কী কেবলই পুরুষের? নারীর নেই?

আছে। নারীরা নিজেদের সম্মান কিসে সেটা ব্যাপারে এখনো অবগত না। ধর্মীয় অন্ধ ভক্তি এবং নারীত্বের একান্ত কিছু ত্রুটির ভুক্তভোগী নারীরাও। ছেলের অপরাধকে অপরাধ না ভাবা, স্বামীকে দরকার ছাড়াই প্রভু ভাবা এবং আরেকটি নারীর ক্ষতিতে পুরুষের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি আনন্দিত হওয়ার প্রবণতা নারীদের মধ্যেই বেশি। তবে যত যাই বলি, পুরুষের সমান ত্রুটি অন্তত এই ক্ষেত্রে তাদের নেই। ভুক্তভোগী কিন্তু তারাই।

আর হ্যাঁ, সবখানেই সব দেশেই সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশন আছে। পুরুষের যেমন আছে, আছে নারীরও। তবে অন্যান্য দেশে ব্যাপারটা এই পর্যায়ে চলে যায় না। একটা সদ্য বাবাকে বাবা হওয়ার অপরাধের কৌফিয়ত জনতার সামনে দিতে হয়। তাদের ধর্মীয় ধরাবাধা কম। তারা সরাসরি শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্ত। যারা পারে না তারা সেক্স টয় ব্যবহার করছে। সেই জিনিষ খোলা বাজারে পাওয়া যায়, অনলাইনে অর্ডার করা যায়, ইউটিউবে রিভিও দেয়া যায়।

আমাদের “এসব কী, ওরে বাবারে” সমাজ যেহেতু পারমিশন দিচ্ছে না সুতরাং অন্য দিকে কমপেনসেট করতে পারত। বিয়েটাকে সহজ করতে পারত। সেটা না পারলে নারীকে কীভাবে এই অদম্য “যৌন সন্ত্রাসী”দের হাত থেকে বাঁচানো যায় সেই উপায় বের করত। আমাদের ধর্ম এবং ধর্মের বার্তাবাহকরা নারীকে মানুষ বিবেচনা করে আগলে রাখতে পারতো। ভার্সিটির প্রফেসর বুড়াটা ছাত্রীর পাশ আটকিয়ে ছাত্রীটাকে আনন্দ ভ্রমণে যেতে বাধ্য নাও করতে পারতো।

হচ্ছে না, হবেও না। কিচ্ছু হবে না। আমাদের এই ভারসাম্যহীন সমাজে আশা করার, আলো দেখার কোনো উপায় নেই। আজকে রাগ করে “আমি বাংলাদেশী বলে লজ্জিত” হ্যাশ ট্যাগ মারা যাবে। আজকে তাসকিনের জন্য হাজারো প্রতিবাদ করতে পারবো। তাতে পরিস্থিতি একবিন্দু বদলাবে না। সমাজে যতদিন সুস্থ যৌনশিক্ষার অভাব আর সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেটেড মানুষ থাকবে, ততদিন এমনই ঘটবে।

আমরা এই সমাজেরই অংশ। আমাদের সিস্টেমের ভেতরেই আছি। পালানোর কোনো উপায় নেই। গতকাল সাকিব, আজকে তাসকিন, পরশুদিন আমি। আমি তো না; আমার বোন কিংবা স্ত্রী চলে যাবে জনতার হাতের নাগালে। সদ্য ভূমিষ্ট সন্তান, নয় মাস কষ্ট সয়ে যাওয়া স্ত্রীর পরিতৃপ্ত- গর্বিত হাসিমুখের মতো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট পবিত্র ছবিটাকে ভুলে গিয়ে আমাকে দাঁড়াতে হবে জনতার আদালতে। জগতের সবচেয়ে কঠিন কাজ হিসেবে নিজের সন্তানের স্বীকৃতির জন্য লড়তে হবে আমাকে। বাচ্চাটি বড় হয়ে জানতে পারবে তার আগমন কতটা নোংরাভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল “যৌন সন্ত্রাসী”দের। সমস্ত জগতের প্রতি অসীম ঘৃণা নিয়ে বড় হবে সে।

এটাই হচ্ছে, এটাই হবে। আমাদের বাঁচার উপায় নেই। সত্যিই নেই। সামাজিক সিস্টেমে কেউ নির্দোষ না। আপনি, আমি কেউই না।

শেয়ার করুন: