আপনাকে বলছি: সমস্ত শাশুড়ি এবং শ্বশুরকে…

কাজরী বসু:

বয়েস হয়েছে আপনার যথেষ্ট। চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলছেন ক্রমশ। অনিবার্যভাবে নিজের জীবনসঙ্গীকেও হারিয়েছেন বেশ ক বছর হলো। একটু সেবাযত্নের দরকার ছিল। কিন্তু কেউ করার নেই। থাকার মধ্যে আপনার একমাত্র ছেলে আর তার বৌ। তারা প্রতি পদে আপনাকে অবজ্ঞা করছে। কোনো মায়া-মমতা নেই আপনার প্রতি। অসহায় আপনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ব্যাঙ্কে টাকা আছে, তুলতে যাবেন সেই ক্ষমতাও নেই। বেঁচে থাকা শুধুমাত্র ছেলে আর তার বৌয়ের ভরসায়। ভাবছেন কী করে কাটাবেন বাকি জীবনটা! হয়তো বৃদ্ধাশ্রমে যাবার কথাও ভাবছেন।
সে যেতেই পারেন, আপনার ইচ্ছে। কিন্তু ক্ষোভের আগুনে আপনি পুড়তেই থাকবেন। শান্তিতে তো আর থাকতে পারবেন না।

আচ্ছা, কেন তাদের এই আচরণ কিছু কি বুঝছেন? আপনারই তো আপনজন এরা। বুঝছেন না। সবই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, তাই তো!

আচ্ছা, একবার ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে কেমন হয়? সেই অনেকদিন আগের কথা…

আচ্ছা, এমন কি কখনো হয়েছে আপনার পুত্রবধূ গ্যাসে ভাত বসিয়ে টিভিতে সিরিয়াল দেখতে গিয়ে ভুলে বসে আছে? কিংবা ধরুন নতুন বিয়ের পর রাত জাগার কারণে উঠতে উঠতে তার খুব বেলা হয়ে গেল! অথবা বান্ধবীদের গেট টুগেদারে গিয়ে ফিরতে ফিরতে একদিন খুব দেরি হয়ে গেল, ততক্ষণে পাড়া শুনশান …

হয়েছে নিশ্চয়ই, এগুলো হয়েই থাকে। প্রশ্নটা তা নিয়ে নয়। প্রশ্নটা হলো আপনার প্রতিক্রিয়া নিয়ে। আপনি কি হাসিমুখে লজ্জিত মেয়েটিকে বলেছেন, আচ্ছা ঠিক আছে, কী এমন হলো, চিন্তা করো না! আর আপনার চোখে সস্নেহ প্রশ্রয় দেখে আপনার পুত্রবধূ মনে মনে আপনাকে ভালোইবেসে ফেললো!

না কি বিরক্তিতে কুঁচকে উঠলো আপনার ভুরু, গম্ভীর হয়ে গেলেন, বৌকে ঠারে ঠোরে কথা শোনালেন, আর বৌ যে কতখানি খারাপ আর নির্লজ্জ আর দায়িত্বজ্ঞানহীন তার বিস্তারিত বর্ণনা করে ছেলেকে নালিশ ঠুকলেন!
বলছি যে, এই দুরকম আচরণের বিপরীত প্রতিক্রিয়াও কিন্তু দুরকমই হবে, এইটা মাথায় রাখবেন।

একটা কথা আপনি ভুলে গেলেও সেই মেয়েটি কখনো কিন্তু ভোলেনি যে তার আজন্মের চেনা পরিবেশ ভুলে সবকিছু ছেড়ে তাকেই আসতে হয়েছে, তাই বরং তারই কিছুটা প্রশ্রয় পাবার কথা!

আচ্ছা মনে করুন তো, কয়েক বছর আগেই যে আপনার বৌমার বাবার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিল, কিংবা তার মায়ের গল ব্লাডার অপারেশন, যে কোনো কিছুই হতে পারে, আপনার পুত্র আর পুত্রবধূকে কি বলেছিলেন কয়েকটা দিন পুত্রের শ্বশুরবাড়িতে থেকে তাদের সাহায্য করতে? কিংবা বলেছিলেন কি, কটা দিন পুত্রবধূর মা বাবাকে আপনাদের বাড়িতে এনে সেবাযত্ন করতে?

না, তাঁরা এমন প্রস্তাবে রাজী নাও হতে পারেন, আপনার বৌমার মা বাবা বলেই তাঁদের আত্মসম্মান নেই, এমনটা ভাবার কারণ নেই, কিন্তু আপনি বলেছিলেন কি? আপনাদের প্রতি আর বৌমার পরিবারের প্রতি উভয়ের দায়িত্ব কিন্তু একই হবার কথা, আপনার বৌমাও হয়তো একই সন্তান।

বলেছিলেন, না কি উল্টে কদিন শ্বশুরবাড়ির প্রতি কর্তব্যের গাফিলতির অভিযোগে মেয়েটিকে কথা শুনিয়েছিলেন?
মনে করুন। কিন্তু যদি প্রথমটা হয়, তাহলে বর্তমানে যা হচ্ছে, তা একেবারেই হবার কথা নয়, সেটা হতে পারে দ্বিতীয়টি হয়ে থাকলে তবেই।

মনে কিন্তু আপনাকেই করতে হবে, কারণ এর উত্তর আপনিই শুধু জানেন। প্রতিবেশীর কাছে বৌ এর নামে নিন্দেমন্দ করার আগেই এর উত্তরটা আপনাকে মনে করতেই হবে।
মনে করুন সেই সময়ের কথা, যখন আপনি দাপুটে গৃহিণী। স্বামী সংসার নিয়ে আনন্দে দিন কাটানো মোটামুটি সুস্থ একজন মানুষ। পুত্রবধূর প্রতি আপনার প্রতিটি ব্যবহার মনে করে দেখুন। এমন কথা তাকে কি কখনো বলেছিলেন যাতে সে এমনটা ভাবতে বাধ্য হয়, এক মাঘে শীত যায় না! বলেছিলেন কি!
বলেছিলেন মনে হয়। স্মৃতি কি বিশ্বাসঘাতকতা করছে?

সত্যি করে বলুন তো, ভালোবেসেছেন বৌমাকে? মন থেকে? যেমন আপনি আপনার বোনের মেয়েটিকে ভালোবাসেন?সে তার স্বামীর কাছে অপমানিত হলে যেমন তার পাশে দাঁড়িয়ে মনোবল বাড়ান, তেমনি কি আপনার পুত্র পুত্রবধূর ক্ষেত্রেও করেন?

ভালোবাসা, স্নেহ হলো ম্যাজিক। ম্যাজিক অবিশ্বাস্যকেও বিশ্বাস্য বানিয়ে দেয়। ভালোবাসা হলো সেই মন্ত্র যা উচ্চারণ করলে পাথরও গলে যায়। ভালোবাসায় পরম শত্রুও বন্ধু হয়। হয় না? আপনি তো প্রাজ্ঞ! আপনাকে কি এটাও বুঝিয়ে বলতে হবে?

আসলে আপনার তো মনেই ছিল না যে একদিন আপনি বৃদ্ধ হবেন, একদিন আপনার শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসবে! একদিন আপনার জীবনসঙ্গী হয়তো বা থাকবেন না! আপনিও একদিন পরনির্ভরশীল হবেন!
এই মনে না রাখার ফল তো আজ আপনাকে পেতে হবেই। ছেলে-ছেলে বৌ কেউই সেই দিনগুলো হয়তো ভুলে যায়নি।মনে মনে হয়তো ভেবেছে, একদিন আমাদেরও দিন আসবে!

সব ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া থাকে, এ কথা কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্য।
তার তুমুল জ্বরের সময় আপনি আপনার পুত্রবধূকে যদি রাত জেগে জলপট্টি দিয়ে বুকে আগলে রেখেছেন কখনো, আপনি কি তার আত্মীয়ের বিপদে পাশে থেকে রাত্রি জেগেছেন তার সঙ্গে কখনো, আপনার পুত্রবধূর বাল্যবন্ধুদের বাড়িতে ডেকে মন থেকে আদরযত্ন করেছেন কখনো,আপনার ছেলে যদি অন্যায় করে আপনি পুত্রবধূকেই সমর্থন করেছেন কখনো…????

এমন আরও অনেক কিছু যা দিনের আলোর মতো আপনার স্নেহকে স্পষ্ট করে তুলেছে…
সে আপনাকে এই ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবেই। যদি না দেয় তাহলে সে মানুষ নয়। সেক্ষেত্রে আপনার পক্ষেই সম্ভব ছিল না তার সঙ্গে এতোগুলো দিন কাটানো। মানুষ তো মানুষের সঙ্গেই থাকতে পারে। অমানুষের সঙ্গে নয়।
ভালোবাসুন। পুত্রবধূকে মেয়ে ভাবতে হবে না। সঙ্গী ভাবুন। একজন মানুষ হিসেবেই ভালোবাসুন। ভালোবাসা একরকমের বুমেরাং, যে ফিরে আসে প্রতি আক্রমণের জন্য নয়। প্রতি আদরের জন্য।

আর না ভালোবাসলে না বাসুন। সেক্ষেত্রে আপনার বৃদ্ধাশ্রমের অপশন তো রইলোই। নিঃসন্তানও তো হয় মানুষ। কতজনের সন্তান প্রবাসী! উভয়পক্ষ চাইলেও একত্রবাস সম্ভব নয়। তারা যা করে আপনি তাই করবেন। তবে হ্যাঁ, সেক্ষেত্রে পুত্র আর পুত্রবধূকে দোষারোপ করে কাঁদুনি গাওয়া কিন্তু চলবে না।

তবে ভালোবাসা চাইলে ভালোবাসতেই হবে। ভালোবেসেই দেখুন। আপনার বৃদ্ধ বয়েস অন্যদের ঈর্ষার কারণ হবে।
সকলেই আমরা মানুষ। ভালোবাসলে ভালোবাসা ফিরিয়ে দেব।
আর উল্টোটা হলে? উল্টোটা হবে।

ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

শেয়ার করুন: