তামান্না ইসলাম:
আজ আপনাদের কিছু আলোকিত মানুষের গল্প শোনাবো।
১। আমার এক কলিগের মেয়ের বয়স যখন ২৩/২৪, তখন ওর মাথার মস্তিষ্কে একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়। মেয়েটার মস্তিষ্কের একটা অংশ অপারেশন করে কেটে ফেলে দিতে হয়। সে অনেক কিছুই করতে পারে, আবার অনেক কিছুই পারে না। মাঝে মাঝে খিঁচুনি হয়। এদেশে যদিও প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে এবং মেয়ের বাবা-মায়ের সাথে থাকাটাকে কেউ খুশি মনে নেয় না, কিন্তু সব মিলিয়ে এই মেয়েটির বা তার বাবা, মায়ের আর কোনো উপায় রইলো না। সে তাদের সঙ্গেই থাকে। ছোটখাটো কাজও করে।
একবার তার অবস্থা এমন হলো যে তার ড্রাইভিং লাইসেন্সও বাতিল হয় হয় অবস্থা। কিছুদিন আগে জানতে পারলাম সে একটি চাকরি নিয়েছে। যেখানে বয়স্ক, অসুস্থ মানুষদেরকে যত্ন নিতে হবে, তাদেরকে বাথরুম করাতে, খাওয়াতে সাহায্য করতে হবে, এমনকি ডায়াপার বা বেডপ্যান পরিবর্তন করতে হবে। যে মেয়েটি নিজেই এতো অসুস্থ, সে যখন অন্য অসুস্থ মানুষদের এমন সেবা করার স্বপ্ন দেখে, চেষ্টা করে, তখন কি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে না?
২। আমেরিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নাকি বয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। তারা নিঃসঙ্গতার কারণে আত্মহত্যা করে। শারীরিকভাবে সুস্থ। টিভি দেখে সময় কাটে না। মানুষ সামাজিক জীব। অন্য মানুষের সাথে কোনো যোগাযোগ না থাকলে, কথা বা দেখা সাক্ষাত না হলে ধীরে ধীরে তাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছা চলে যায়। তাদের মনে হয় বেঁচে থেকে কী লাভ? জীবনের প্রতি এই অনীহা থেকে তারা আত্মহত্যা করে।
সেদিন রেডিওতে এক মেয়ের কথা শুনলাম, সে ড্রাইভ করে দূর-দূরান্তের বৃদ্ধ মানুষদের বাড়ি যায়, তাদের সাথে কথা বলে, সময় কাটায়। এতে করে তাদের নিঃসঙ্গতা দূর হয়। তারা মানসিকভাবে সুস্থ থাকে। এই কাজ কিন্তু সে কোনো কিছুর বিনিময়ে করে না। একবার ভেবে দেখুন তো, সময়ের অভাবে, দূরত্বের কারণে, আপনি হয়তো আপনার বাবা বা মা যে একাকি ঘরের কোনে সময় কাটায়, যাকে আপনি সময় দিতে পারেন না, সে কতখানি নিঃসঙ্গ! সেখানে অন্য অচেনা মানুষের নিঃসঙ্গতা দূর করার দায়িত্ব নিয়েছে যে মেয়েটি, সে কতোটা মহান!
৩। চার বছরের একটি ছেলের মরণাপন্ন অবস্থা। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে তার বেঁচে থাকার আর কোনো আশাই নেই। ছেলেটি আইসিইউতে আছে। বাবা-মা মরিয়া হয়ে গেল ছেলের শেষ কটা দিন আনন্দে রাখতে। ছেলেটি ফুটবলের ভীষণ ভক্ত। বাবা, মা ডাক্তারের সহায়তায় শুধু খেলা দেখার সময়টুকু আইসিইউ থেকে বাইরে নিয়ে আসতো বাচ্চাটিকে। তার এক ভীষণ প্রিয় খেলোয়াড় ছিল। ভাগ্যক্রমে একদিন সেই খেলোয়াড়ের সাথেও দেখা করার সুযোগ হয়। শিশুটি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যেই খেলায় জয়ের পর ওই খেলোয়াড়টি টিভিতে বলে,’আমার সাথে এক মরণাপন্ন শিশুর দেখা হয়েছে। তার দুটো ইচ্ছা, এক আমার সাথে দেখা করা, আর দুই, মিকি মাউসের সাথে দেখা করা। কেউ কি দ্বিতীয়টির ব্যবস্থা করতে পারে? সাথে সাথে সহৃদয় এক ব্যক্তি তার পরিবারসহ ডিজনি ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেন। ছেলেটির মা ছেলেটিকে এটা জানানোর চার ঘণ্টা পরে ছেলেটি মারা যায়। সেই খেলোয়াড় আর ছেলেটির কথোপকথন, ওর চোখে খুশির আলো দেখে অতি বড় পাষাণেরও চোখে জল আসবে।
আমার আপনার মতো মানুষই কিন্তু প্রথম এবং দ্বিতীয় উদ্যোগটি নিতে পারি, তিন নম্বরের জন্য না হয় থাকুক সাকিব, মাশরাফি, তামিমরা।