ফেমিনিস্ট ট্রেনিং এর ফাঁকে ফাঁকে-২

মারজিয়া প্রভা:

মাত্র ইয়োগা ক্লাস সেরে রুমে এলাম। ২০১৩ এর পর মাসলের উপর আর অত্যাচার করিনি৷ আজ ৫ বছর পর এই ধকল শরীর কতদিন নিতে পারবে কে জানে! আমি রুমমেটকে বললাম, ‘কাল কীভাবে যাবো! পায়ের শিরা তো ব্যাথায় মারা যাচ্ছে!’ আনা বলে, ‘হেহ, কাল কেমনে করবা ভাবতেছ! আরো ৩০ দিন বাকি ইয়ার! আমি সেই শুনে কম্বল গায়ে শুয়ে আছি।’

ফ্লুয়েন্ট ইংরেজি তেমন সবসময় আসেও না। ইন্ডিয়ানদের সাথে হিন্দি বাংলা ইংরেজি মিশায়ে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলি৷ মারাঠি একজন আছে, অঞ্জলি। উনি কালকে আমাকে শেখালেন, মারাঠিতে ‘আমি’কথাটা ‘মাঝা’ বলে। প্রথমদিন দিদি, আপু বলছিলাম সবাইকে। অভ্যাস। নাশতাশিয়া, আমাদের কোর্স কো অর্ডিনেটর, এসে বলল, ‘নো দিদি, নো আপু। কল মি অনলি নাশতাশিয়া। ‘ তাই সই।

কাল কমলাজির সংগে প্রথম ট্রেইনিং সেশন ছিল। আমাদের প্রদীপ আর একটা রাজস্থানি দোপাট্টা গিফট দেওয়া হলো। এই দোপাট্টা আবার ভেবে বসবেন না বুক ঢাকতে! এই দোপাট্টা উত্তরীয় হিসেবেই দিয়েছে। পুরুষ মেন্টরকেও দিয়েছে। প্রদীপের কাহিনীটা মজার। একে অপরের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবো আর নিজেদের ইন্ট্রুডিউস করবো। সবাই সবার কাজ নিয়ে বলল। আমি জাস্ট পথের ইশকুল আর প্যাড প্রোগ্রাম নিয়ে কথা বললাম। বলার পরে দেখলাম নেপালে উষা এখানে মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে কাজ করে। আমাদের দুইজনকে শ্রীলংকান একজন ডক্টর আপু ডেকে বললো, তিনিও তার দেশে এই ধরনের প্রোগ্রাম করতে চান। আমার রুমে আসবেন কথা বলতে।

কাল সেশন ছিল জেন্ডার আর সেক্স বিষয়ক ডিফারেন্স নিয়ে৷ ছোট কাগজে লিখতে বললো, জেন্ডার বলতে কী বুঝি! নয় জন ভুল উত্তর দিয়েছিল। বাকিদের কনসেপ্ট এবং আমি নিজেও লিখেছিলাম, The role defined by society upon one’s sexual identification. কমলা জি বলল বেসিক ঠিক আছে। কিন্তু এইটা খালি রোল হবে না। রোল, রেসপন্সিবল, ল্যাংগুয়েজ, বিহেভিয়ার, এটিটিউড সব হবে! জেন্ডারই তো আসলে সব। জেন্ডারই তো ঠিক করে দিচ্ছে একটা মেয়ে কি পরবে, একটা ছেল কীভাবে ব্যবহার করবে!

পৃথিবীতে কেউ কারো মতন না। আমাদের হাত, পা, মাথা, জীন সব আলাদা। কারো এক না। বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন তো এজন্যই এতো অথেন্টিক! যে একের আংগুল এর ছাপ আরেকজনের মতো হবে না। যেখানে প্রকৃতি এতো ডাইভারসিটি দিয়েছে, অথচ আমরা তাকে বাইনারিতে ফেলে দিয়েছি। এতো বৈচিত্র‍্যকে দুইভাগে ভাগ করেছি, ০ আর ১, পুরুষ আর নারী। এবং বলছি প্লিজ সেই অনুযায়ী ব্যবহার করো।

কোনো ছেলে শাড়ি পরলে, আজ তাকে ট্রান্সজেন্ডার নামে একটা ক্যাটাগরিতে ফেলছি। অথচ এসব কোনো ইস্যুই হতো না যদি না আমরা বাইনারিতে তাদের না ফেলতাম।

সেক্স ইজ নট আওয়ার চয়েজ। আমি ছেলে হবো না মেয়ে হবো এইটা প্রকৃতিপ্রদত্ত। আমার সেক্স অর্গান পেনিস হবে, না ভ্যাজাইনা হবে, ঠিক করে দিবে প্রকৃতি। কিন্তু ভ্যাজাইনা থাকলে আমাকে নমনীয় হতে হবে, কালারফুল সাজতে হবে, ঘরের কাজ করতে হবে, হাসা যাবে না, নিম্নস্বরে কথা বলতে হবে এইটা সোসাইটির তৈরি। আর তাই জেন্ডার ইজ সোশ্যাল কনস্ট্রাকচার। নট বাই ন্যাচারাল।

যে শিশু মাত্র জন্মালো তার সেক্স অর্গান রুমাল দিয়ে ঢেকে দেন, ১০০ পারসেন্ট সিউর থাকেন কেউ ছেলেমেয়ে বুঝবে না। অথচ দ্যাখেন, এই সেক্স অর্গান দুনিয়া কামাল করে দিল, ঝড় এনে দিল কিভাবে কে জানে! পেনিস শাসন করছে ভ্যাজাইনাকে! কেন কে জানে!

বাট এই বেলা ভাবছেন, এই হয়ে আসা জেন্ডার কন্সট্রাকচার বদলাবো কী করে! জেন্ডার রোল একদিনে বদলে যেতে পারে! রোহিংগা রিফিউজিদের দিকে তাকান। যে মহিলারা সাত হাত আবায়া দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখতো, আজ তারা ঠেলাঠেলি করে ত্রাণ নিচ্ছে। কাজ করছে একসংগে। জেন্ডার রোল বদলে যাচ্ছে। যে ছেলে কোনদিন রাঁধতে পারতো না, রান্নাকে মেয়ে মানুষের কাজ জানতো, বিদেশ গেলে ঠিকই রান্না করে খাচ্ছে। শুধু রান্নাই না, ঘরের সমস্ত কাজ করছে। জেন্ডার রোল বদলে যাচ্ছে।

তাই এই জেন্ডার কন্সট্রাকচার আপনিই বদলাতে পারেন, ইউ ক্যান চেঞ্জ দিজ সোসাইটি। ইটজ ইওর চয়েজ। সেক্সের মতো কনস্ট্যান্ট নহে এটি!

চার পাঁচ বছর আগে কমলাজির একটা রিসার্চের কথা বলে আজ শেষ করছি। ব্রেকফাস্ট ইজ কলিং মি। ব্রা নিয়ে ছিল রিসার্চটা। ৯৫% ব্রা কটন না, র‍্যাশ হয়! তবুও মেয়েরা কেন পরে? পরে স্তন ঝুলন্ত হওয়া থেকে বাঁচতে, যাতে স্তন টাইট থাকলে তাকে ইয়াং লাগে। পুরুষতন্ত্র মেয়েদের উজ্জীবিত যৌবন ধরে রাখতে বলে, আর তাই যত ইয়াং আর টাইট ত্বকের যে নারী, তত পুরুষতন্ত্র তাকে ভালোবাসে। সায়েন্স রিসার্চ বলে, আর্টিফিশ্যালি কোন ঝুলন্ত বা স্যাগিং স্তনকে আটকে রাখতে চাইলে, উলটা কেস হয়। পরে আরো ঝুলে যায়। আমি ভাবলাম ঝোলা স্তন সৌন্দর্য হবে না কেন! ঠিক তখনই অনলাইনে দেখলাম, সারা বিশ্বে এই অন্তর্বাস বিক্রির সংখ্যা কত! কত ব্র‍্যান্ড আর কত ক্যাটাগরি। হি হি, ব্রা না পরলে ওদের ব্যবসা চলবে?

পুরুষতন্ত্র আর মার্কেট ইকোনমি (পুঁজিবাদ) ভাই ভাই! আর কোন কথা নাই!

ব্রা ছাইড়া ঘুরতে কাল থেকে মহা আনন্দ পাচ্ছি! বাংলাদেশে আমি ব্রা ছাইড়া ঘর থেকে বের হবো শুনলে আমার আম্মা হার্ট আ্যাটাক করে বসে থাকবে। এক মাস অন্তত এইসব প্যাট্রিয়ার্কির ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকি।

#Sangat
#23th_Feminist_Capacity_Building_Up_Course
#Day_2

শেয়ার করুন: