স্বপ্নের চেয়েও বড় যখন মানুষের মন

ইলা ফাহমি:

এক কলিগ এসে বললেন-‘আপু, একটা অনুরোধ ছিলো। আগামী মাসে আমার বাসায় দাওয়াত, আমার আকদ। আসলে খুশি হবো। যদিও আমাদের বাসাটা ছোট, ভাঙা। আপনাদের সবার খুব কষ্ট হবে।’ ওনাকে বসালাম পাশে, বললাম-‘শোনেন, বাসা ভাঙা বলে আপনার কষ্ট পাবার কিছু নেই। বরং আপনার গর্ব করার কথা যে আপনি সেই ভাঙা বাসা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে অনেক স্ট্রাগল করে এ পর্যায়ে এসেছেন এবং অনেক পাকা দালানের মানুষের সাথে একই চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছেন। এ নিয়ে লজ্জিত হবার কিছু নেই।’

সরকারি চাকুরে বাবা, গৃহিণী মা আর চার বোনের নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারের কথা মনে পড়ছে। আমরা ঢাকায় আসি ১৯৯৬ সালে, বাবার চাকরি সূত্রে। তখন আমার বয়স সাত। হাজারীবাগে ছোট্ট দুইরুমের একতলা বাসা, সামনে পাকা ছোট্ট উঠোন, কল পাড়, বাথরুম। তখনো এপার্টমেন্ট কালচার বোধহয় বিকশিতও হয়নি৷ বাবার অল্প আয়ের বড় অংশ চলে গেছে চার সন্তানের পড়াশোনার খরচে। আমার মা স্বপ্নবাজ নারী যার স্বপ্ন দেখার তাড়না আমাকে অপটিমিস্টিক স্বপ্নবাজ বানিয়েছে। মা তার কন্যা সন্তানদের বিবাহিত সংসারী দেখবার আগে স্বাবলম্বী দেখতে চেয়েছিলেন। এজন্য জীবনের পুরোটা খেটেছেন আমাদের পেছনে।

সেই ছোট্টঘরে আমরা ছয়জন এঁটে গিয়েছিলাম অনায়াসে। পুরানো বাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে ফাটলধরা দেয়াল জুড়ে আমাদের স্বপ্নরা সকাল-বিকাল খেলা করতো। আম্মা তাগাদা দিতেন পড়াশোনার, ফাঁকি দিলে মাঝে-মধ্যে কান্নাকাটি করতেন আর বলতেন-‘এতো কষ্ট কার জন্য করতাছি!’ তিনি বোধহয় স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারতেন না আমরা স্বাবলম্বী হবো না।

আমাদের গল্পের বই পড়ার নেশা ছিলো। আম্মা একটা চিপস বা আইসক্রিম খাওয়ার টাকা না দিলেও বই কেনার টাকা দিতেন সাধ্যমতো। বইমেলায় নিজে সাথে নিয়ে ঘুরতেন, বই কিনে দিতেন আর ফুচকা খেতেন আমাদের নিয়ে। আর বাবা সরলভোলা মানুষ, তিনি টাকা কামাই করতেন, রাত জেগে তাস খেলে বাড়ি ফিরতেন, সন্ধ্যায় কলিগদের সাথে আড্ডা দিতেন, ফেইল করে লুকিয়ে তার কাছে রেজাল্ট কার্ড নিয়ে গেলে প্রশ্রয় দিয়ে সাইন করে দিতেন আম্মাকে না জানিয়ে৷ এখন যখন চিন্তা করি তখন কেবলই মনে হয়- আমি আমার মায়ের স্বপ্নের সমান বড়।

বাবা যখন রিটায়ার করলেন, মনে আছে, দু’পদের বেশি তরকারি আমরা খেতাম না, কখনো এক পদ। বাসায় গরুর মাংস রান্না হত সপ্তাহে একবার, প্রকারান্তে দু’সপ্তাহে একবার। সেই স্বল্প আয়ে আমার মা কিভাবে চালিয়ে নিয়েছিলেন? এখন নিজে সংসার হ্যান্ডেল করতে গিয়ে অবাক হই, আম্মার জন্য বুকে উথালপাতাল কান্না জমে। আমাদের জামা আম্মা গজ কাপড় কিনে সেলাই করতেন নিজে। ঈদ বাদে সারাবছরে খুব প্রয়োজন না হলে জামাকাপড় কেনার কথা চিন্তাই করতাম না।

আমাদের বড় বড় দামী স্বজনেরা খুব বেশি কাজে আসেননি, আম্মা আসতেও দেননি, আত্মসম্মান তার তুঙ্গে ছিলো। তার আত্মসম্মান এতোই যে এখনো টাকা পাঠাতে দেরি হলে ছোটবোনকে দিয়ে বলান, নিজে মুখ ফুটে বলেন না। হায় মা, একটা ব্রিলিয়ান্ট জীবন শুধু আমাদের পেছনেই খরচ করে দিলে! অর্থ খরচ করলে ফেরত আসে, জীবন খরচ করে কীভাবে ফেরত আসবে? আমার মাঝে-মধ্যে আম্মাকে আবার জন্ম দিয়ে কলেজ পাশ করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে ইচ্ছে করে, আম্মাকে একটা স্বাধীন জীবনের স্বাদ দিতে ইচ্ছে করে।

কারেন্ট চলে গেলে ছাদের সিঁড়িতে বসে আমরা পড়াশোনা করতাম, স্ট্রিটলাইট ছিলো, ঠাণ্ডা বাতাস ছিলো। সেই স্ট্রিটলাইটের আলোয় ইংরেজি বইয়ের ফাঁকে প্যারাগ্রাফ, ট্রান্সলেশন আর টেন্সের লাইনে লাইনে তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ রানা হাসিমুখে উঁকি দিত। আমি ভাঙা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ওদের সাথে ক্যালিফোর্নিয়া ঘুরে বেড়াতাম। এক জীবনে স্বপ্ন দেখেছি পাইলট হবো, এরপর পুলিশ এসে ভর করেছিলো, আরো অনেককিছুর পর এখন কেবলই মনে হয়- দুনিয়াটা ঘুরে দেখাই একমাত্র স্বপ্ন। আব্বার উড়নচণ্ডি বৈশিষ্ট্য আবার এখানে রক্তচাড়া দেয়।

আমার বন্ধুবান্ধব কাউকে বাসায় আনতে আমার কখনো লজ্জা লাগেনি। কারণ সবসময়ই মনে হয়েছে যারা আমার বন্ধু হবে তারা আমার সবকিছুরই বন্ধু হবে, না হলে নাই। আম্মা মাঝেমধ্যে রাগ করতেন, বলতেন-‘ওদের যে নিয়ে আসিস, তোর বাসায় বসার জায়গা আছে?’ আমি বন্ধু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে সিনিয়র বড়ভাই কাউকেই কখনো বাসায় আনতে হ্যাজিটেট ফিল করিনি।

আমাদের পিতার স্বল্প আয়, আমাদের ভাঙা বাসা সবসময় আমাদের স্বপ্নের কাছে মলিন থেকেছে৷ লাঞ্চের ফাঁকে কলিগের সাথে নিজের জীবনের গল্প করছিলাম, তিনি সজল চোখে তাকিয়ে ছিলেন। আমি ভালো কাউন্সেলর নই, তবে শেষে এটুকু বললাম-‘ভালো বাড়ি বা জামাকাপড় নিয়ে লজ্জা পাবার কিছু নেই, মানুষ হতে না পারাটা লজ্জা!’

শেয়ার করুন: