তৃতীয় বিশ্বের বাংলাদেশে ‘নারীবাদ’ সংকট

সাদিয়া রহমান:

বর্তমানে পথে ঘাটে চলতে ফিরতে, উঠতে বসতে যেই কথাটা সবচেয়ে বেশি শোনা যায় সেটা হলো, “নারীবাদ নষ্ট হয়ে গেছে”। অনেককে প্রশ্ন করে যেসব উত্তর কমবেশি জরিপের মাধ্যমে উঠে এসেছে তা দুই প্রকার। একপ্রকার “কিন্তু” ওয়ালা। নারীবাদ খুব সুন্দর একটা উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছিলো, কিন্তু এইসব সো-কলড নারীবাদীরা এটা নষ্ট করে দিয়েছে। দ্বিতীয় প্রকারের মতবাদ বরং একটু প্রশান্তিদায়ক। এদের লুকোচুরি নাই। সরাসরি কথা নারীবাদ পছন্দ না, তাই এটার পক্ষপাতি না।

দ্বিতীয় প্রকারের মানুষজন নিরাপদ। এদের মাঝে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলার ব্যাপার নেই। যার যা মনে হয় হতে পারে, কিন্তু মেয়েদের কাজ ঘরের কাজ অথবা মেয়েদের আসল কাজ ঘরের কাজ। তাই ওসব গালভরা এটা ওটা “বাদ” পোষায় না। এরা নিরাপদ। জরুরি নয় যে সবার সাথে সব মতবাদ মিলতে হবে। সবার সব বিশ্বাস করতে হবে। তারা যা মানেন তা তারা পালন করেন। হিপোক্রিসি নাই।

প্রথম ধরনের মানুষ খুবই বিপদজনক। এরা প্রথমেই সব বাতিল করে দিবে না। এরা জাল বিছিয়ে ভিতরে ঢুকে ইনিয়ে বিনিয়ে জাল কেটে থাকে। এদের নিজেদের মনের মাঝে নারীবাদের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। খুব লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সেই সংজ্ঞাগুলো বেশ সুবিধাবাদী সংজ্ঞা। এর বাইরে গেলেই কিভাবে নারীবাদ নারীবাদীরা নষ্ট করছে এটা নিয়ে মুখে ফেনা তুলে গালি দিতে থাকে। জরুরি নয় যে এই কাজটা যারা করে তারা শুধু পুরুষ হয়ে থাকবেন। এই তালিকা থেকে নারীরা কোনো অংশে কম যান না।

কীভাবে সোকল্ড ফেমিনিস্টরা নারীবাদের মতো এতো সুন্দর বিষয়কে নষ্ট করছে? এক, পুরুষ বিদ্বেষী মতবাদ ছড়িয়ে। দুই, নারীবাদের নামে যাবতীয় বেয়াদবি, বেলেল্লাপনাকে উস্কানি দিয়ে।

প্রথমে নারীবাদ কী সেটা যদি বলতে চাওয়া হয় তবে বলে রাখতে হয় নারীবাদের সংজ্ঞা জনে জনে ভিন্ন। তবে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশে যেইখানে প্রতিটা টং দোকানে যাবতীয় রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান পাওয়া গেলেও রাজনৈতিক মতাদর্শ জানতে চাইলে অন্তত ৭০ ভাগ মানুষ বুক ঠুকে বলে উঠবে, “আমি রাজনীতি পছন্দ করি না” অর্থাৎ ইংরেজিতে গর্বিতভাবে “এপলিটিক্যাল”; সেইরকম একটা দেশে যদি বলা হয়, নারীবাদ একটা রাজনৈতিক ভাবনা বা এর সাথে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক রাজনীতি গভীরভাবে জড়িত, তাহলে শুধু হিতে বিপরীতই হবে হয়তো। তাই সোজা বাংলায় নারীবাদ এমন একটি মতবাদ বলা যেতে পারে যা প্রাথমিকভাবে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

আরেকটু ভেঙে বললে লিঙ্গভেদে অধিকারে কোনো ভেদাভেদ হবে না হোক তা সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অধিকার। অর্থাৎ সমাজে একটা ছেলে নিরাপদে চলতে পারলে যতদিন পর্যন্ত মেয়রাও সমপরিমাণ নিরাপত্তা না পাচ্ছে ততদিন লড়াই চলবে।
একই কাজের জন্য সমপরিমাণ বেতন অথবা টিপ্পনি বিহীন প্রমোশন। টিপ্পনীবিহীন প্রমোশন বুঝেন তো, নাকি? টিপ্পনীবিহীন প্রমোশন হলো মেয়েদের যোগ্যতার স্বীকৃতি। মেয়েদের উন্নতিতে কোনো পুরুষকে ঘিরে বাজে ইঙ্গিত না করে তাঁর যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দান করা। বাসে সংরক্ষিত ছয়/নয়টা সিট প্রদান করে খুব সুবিধা দিয়ে ফেলেছি এমন মনে না করে প্রত্যেকটা মেয়ে যেনো স্বস্তির সাথে বাসে ভীড়ের মাঝেও দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে পারে, সেই নিশ্চয়তা প্রদান করা।

এখন দেখা যাক নারীবাদীরা পুরুষ বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে কীভাবে! পুরুষরা গায়ে হাত দেয়, পুরুষরা ধর্ষণ করে, পুরুষরা মানসিকভাবে নির্যাতন করে এগুলো কোনোটাই নতুন না। কিছু কিছু মেয়ের গলা অস্বাভাবিক বড় যারা খুব সাহস করে এই নিষিদ্ধ (ঠিক কেনো নিষিদ্ধ তা যৌক্তিকভাবে স্পষ্ট না) কথাগুলো বলে ফেলেছে।
যারা কথাগুলো বলেছে, হয়তো তারা শুরুতে নারীবাদীই ছিলো না। শুধুমাত্র সহ্য করতে না পেরে বলেছে। হয়তো তাদের নিত্যদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ছেলেদের সামগ্রিকভাবে খারাপও বলেছে। এই হয়ে গেছে অপরাধ! এই যে সত্তুরভাগ মানুষ বুক ঠুকে বলেন, “রাজনীতি নোংরা জিনিস পছন্দ করি না”, আপনারা রাজনীতি বিদ্বেষ ছড়ান না? রাজনীতি ছাড়া মানুষ বা দেশ চলে? একজন নির্যাতিত ব্যক্তি যদি ক্ষোভ, হতাশা মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে একটা মন্তব্য করে, আপনিও একই কাজ করলে পার্থক্য কী থাকলো? অবশ্য এসব ব্যাপারে ভাবনার চল মনে হয় এইখানে নেই।

বেগম রোকেয়াকে আরাধ্য ভাবলেও যেই মুহুর্তে মানুষ জানবে ঊনি উৎপীড়ন এড়াতে কাল্পনিকভাবে পুরুষকে মুর্দানায় আটকাতে চেয়েছিলেন, সেই মুহূর্তে হয়তো অনেকের আরাধনা থেমে যাবে।

দ্বিতীয়টা হলো, বেয়াদবি আর বেলাল্লাপনা। বেয়াদবি বেলেল্লাপনার বিশাল লিস্ট আছে। সেগুলোর মধ্যে আছে মেয়েদের ঘরে বাইরে বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি বা অন্য বড় মানুষের সাথে ন্যায়-অন্যায় নিয়ে মুখে মুখে তর্ক করা, পোশাকের স্বাধীনতা চাওয়া অথবা জিন্স টপ্স পড়া, ওড়নাবিহীন থাকা, চুল কেটে ফেলা, মদ-সিগারেট খাওয়া (কেউ বলেনি মদ সিগারেট খাওয়া ক্ষমতায়নের প্রতীক, আপত্তি শুধু এতেই যে এগুলো শুধু মেয়েদের জন্য খারাপ হিসেবে দেখা, এবং তা নিয়ে গালিগালাজ করা), সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা এবং ইত্যাদি।

একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করলেও নারীবাদে এখনো সেকেন্ড ওয়েভ পার করেনি। মাত্র আট-দশ পাতা নারীবাদ পড়লেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যেতে হয়। সারা বিশ্বেই কত রকম লড়াই করে নারীরা নিজেদের স্থান আদায় করেছে। কী অদ্ভুত কথা যে নাগরিক হিসেবে ভোট দেবার জন্যও নাকি নারীদের প্রায় একশো বছর আন্দোলন করতে হয়েছে পশ্চিমে। ১৮৯৩ বা ১৯২০ সালের আগে নারীর ছিলো না ভোট দেবার অধিকার, অর্থাৎ নাগরিক হিসেবে তারা ছিলো অস্তিত্বহীন। এরপর কত কিছু হয়ে গেলো!

নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর কথা বলার অধিকার পাওয়া গেলো। সমাজে নিজেদের অবস্থান নিয়ে সচেতনতা তৈরি হলো। ঊনবিংশ শতাব্দীর ম্যারি ওলস্টোন ক্র্যাফট এর পথ ধরেই হয়তো ভার্জিনিয়া উলফ, সিমোন দি বোভোয়্যাররা কথা বললেন। বললেন নারীকে সামাজিক শৃংখলে ধরে রাখার রাজনীতির কথা।
ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বাইরে বের হওয়া হলো। সেকেন্ড ওয়েভ আসলো। নারীরা নিজেরা নিজেদের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব চাইলেন। এবারে চাইলেন নিজেদের শরীরের অধিকার। যা দিয়ে এতোকাল তাদের শোশণ করা হয়েছিলো তাই তারা শক্তি মনে করলেন। নারী শরীর সর্বস্বতা অথবা শরীরের বিছিন্নতার সিদ্ধান্ত শুধু নিজেদের করে চাইলেন। নিজেদের জরায়ুর অধিকার নিজের বলে দাবি করলেন। নিজেদের ভাষা নিয়ে ভাবলেন। নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাবলেন। নিজেদের ইতিহাস নিজেরা পুনরুদ্ধার করার কথা ভাবলেন। নিজেদের ইতিহাস নিজেরা লিখতে চাইলেন। সেই লেখার ভাষা নিজেদের মতো করে অলংকরণ করতে চাইলেন। তারা গালি দিবেন না ভালোবেসে মিষ্টি কথাতে ভাব প্রকাশ করবেন, তা নিজেদের সিদ্ধান্তে হবে বলে মনে করলেন।
সেই ওয়েভ থেকে আরেকটা ওয়েভে পদার্পণ করা হলো। সেইখানে অনেকেই মনে করলেন, সমতা নারীরা অর্জন করে ফেলেছে, এখন আরও নতুন কিছু ভাবতে হবে। লিঙ্গভিত্তিক পড়াশুনা শুরু হলো। বৈচিত্র্য এলো সেইখানেও।

আর তৃতীয় বিশ্বের দেশ বাংলাদেশে এখনও নারীদের জরায়ুর দাবি তো চূলোয় যাক, ছেলে বন্ধু বদল হলেও সেই মেয়ে বেশ্যা-মাগী হয়ে যায়। নিজের অভিজ্ঞতা? রাস্তায় হ্যারাজড হওয়ার কথা বলতে গেলেও সে খারাপ মেয়ে, বেশ্যা, মাগী হয়। স্বামী কাজ করে না, তাই বউকে কাজ করতে হয়? সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে? কীসের অর্থনৈতিক মুক্তি? ঐ মেয়ে তো খারাপ মেয়ে, বেশ্যা, মাগী। ওড়না নাই? চুল ছোটো? ঢং? সমস্যা যাই হোক, সমাধান মেয়েরা বেশ্যা মাগী।

দুনিয়া এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখনো মেয়েদের পোশাকে ঝুলে আছে। বিশ্ব এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখনো সেকেন্ড ওয়েভ পার করেনি। করবেই বা কেনো? ওসব পশ্চিমা জিনিস বাংলাদেশিরা নেয় না। ইনফিনিটি ওয়ার? না ওসব বিনোদনের বিষয় টানা ঠিক হবে না। সেগুলো বিনোদন, তাই গ্রহণ করা যায়। তাই বলে গলা উচিয়ে ধর্ষণের কথা বলা কিন্তু সংস্কৃতির সাথে যায় না! তাই ওসব কথা তোলা থাক আপাতত। কেননা এদেশের মেয়েদের এখনো বহুদিন আতংক নিয়ে দিনে দুপুরে বাসে উঠতে হবে, আর আতংক নিয়ে সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরতে হবে।

শেয়ার করুন: