নারীর ক্ষমতায়ন কতোটুকু প্রায়োগিক?

সৌরভ দেবনাথ:

সিমোন দ্য বোভেয়ার বলেছেন,
“কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে।”
এই কথাটা আমাদের সমাজের জন্য, আমাদের তৈরি করা সমাজ ব্যবস্থার জন্য অনেকখানি সত্য। আমরা আমাদের চারপাশের বলয়কে এমনভাবে সাজিয়েছি, যেখানে শুধুই পুরুষ রাজত্ব করবে, পুরুষই নির্ধারণ করবে সামগ্রিক ব্যবস্থা এমনকি একজন নারীর জীবনব্যবস্থাও।

নারীর ক্ষমতায়ন শুধুমাত্র নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক চাকরির সুযোগ এবং শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আরো বিশাল একটা কনসেপ্ট; এর পরিধি আরো ব্যাপক। সবার প্রথমে একজন নারীকে ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, এটা বৈষম্য দূরীকরণের প্রথম পাঠ। নারীর সামাজিক অবস্থান শক্ত করার জন্য নারীর নিজের সিদ্ধান্ত নারীকেই নিতে দেয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সকল প্রেক্ষাপটের ঊর্দ্ধে গিয়েও নারীর সিদ্ধান্তের স্বীকৃতি দিতে না পারা অব্দি আমরা কখনোই নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা সম অধিকারের কথা বলতে পারি না।

একজন নারী যখন তার জীবনের যেকোনো সিদ্ধান্ত কোনোরকম সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে গ্রহণ করতে পারবে, তখনই আমরা বলতে পারবো এ দেশে কিংবা এ সমাজে নারী এবং পুরুষের অধিকার সমান। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাবো, নারী সবসময়ই কোনো না কোনো পুরুষের ওপর নির্ভর করে বাঁচে তা হোক সে বাবা, কাকা, ভাই, স্বামী কিংবা প্রেমিক। এই মানসিকতা একজন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নারীর ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই।

তো নারীর নির্ভরতার পুরুষেরা নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, ব্যক্তিগত সকল বিষয়েই অধিকার আরোপ করে; এটা পুরুষের পুরুষালী ব্যবহার যতোটুকু নয়, তার চেয়ে বেশি সমাজ ব্যবস্থার দোষ। পুরুষ মনে করে এটাই নিয়ম, এভাবেই হবে৷ পুরুষ নারীর প্রভুত্ব করবে।

কিন্তু সত্যিকার অর্থে, একজন মানুষ কখনোই আরেকজন মানুষের প্রভু হতে পারে না। একজন পুরুষ যেভাবে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে, একজন নারীরও সেই অধিকার রয়েছে এবং এই অধিকার প্রত্যেকটা মানু্ষ জন্মগতভাবেই লাভ করে। একজন নারী মেধায়, মননে, সৃষ্টিশীলতায় একজন পুরুষকে ছাড়িয়ে গেলেও শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে তার সম্ভাবনার অনেক দ্বারই বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ করে দেয়া হয়।

কিন্তু আমরা দেখি, আমাদের সমাজে নারীকে শিশুকাল থেকেই নারী হয়ে ওঠার পাঠ দেয়া হয়। নারীকে শেখানো হয় নারী কোমল হবে, নিচু স্বরে কথা বলবে, নারী পারিবারিক সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করবে না, নারীকে সবসময় স্যাক্রিফাইস করতে হবে নিজের ইচ্ছের সাথে। নারীকে শেখানো হয় পুরুষ ব্যতীত তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই, নির্দিষ্ট সময় অব্দি নারীর মালিকানা তার পিতার এবং এরপর সেই মালিকানা হস্তান্তরিত হয়ে যাবে তার স্বামীর কাছে, এরপর পুত্র, তারপর পৌত্র…..

এভাবেই নারীর জীবন আবর্তিত হতে থাকবে পুরুষের দ্বারা?
এখনো একজন নারী তার জীবনসাথী নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে না। ভালোবাসার মানুষের হাত ছেড়ে দিতে হয় পারিবারিক এবং সামাজিক সিদ্ধান্তের কাছে হেরে গিয়ে।

এই ব্যাপারগুলো একটা মেয়ে শিশুর মাথায় শৈশব থেকেই এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যে পরবর্তীতে সেই মেয়ে শিশুটির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের পরও তার বোধোদয় হয় না। এর কারণ, তার মানসিকতা শিশুকাল থেকেই পুরুষতান্ত্রিকতা দ্বারা খুব শক্তভাবে প্রভাবিত৷ এজন্য একজন পরিণত নারীও নিজেকে পুরুষ ব্যতীত অসম্পূর্ণ, অনিরাপদ এবং অকেজো মনে করেন। তিনি কখনোই নিজের স্বীয় ব্যক্তিসত্ত্বাকে উপলব্ধি করতে পারেন না। তিনি সবসময় মনে করেন এই যে, তিনি এক কিংবা একাধিক পুরুষের গচ্ছিত সম্পদ এবং সেই সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা, সংরক্ষণ, ব্যয় এবং ব্যবহারও পুরুষই করবে। এই ধারণা নারীকে মানুষ থেকে তথাকথিত নারীতে পরিণত করে এবং নারী মেনে নিতে থাকে তার জীবনের ওপর, তার সিদ্ধান্তের ওপর পুরুষের অযৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ।

পুরুষের এই অযৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ নারীর সৃজনশীলতা ধ্বংস করে দেয়, ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করে, নারীর নিজেকে পুরুষের চাইতেও উৎকৃষ্ট প্রমাণ করার সুযোগ কেড়ে নেয়, আর নারীকে আবদ্ধ করে ফেলে বদ্ধ প্রকোষ্ঠে।

আমি খুব চাই…
নারী বেরিয়ে আসুক বদ্ধ প্রকোষ্ঠ থেকে, পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হোক সমাজ পরিবর্তনে, নারী হোক বিদ্রোহী-বিপ্লবী, নারী হোক ব্যক্তিত্ব, নারী হোক নারীর আগেও মানুষ।।

লেখক পরিচিতি: ছাত্র, (সম্মান-বিবিএ)

শেয়ার করুন: