একটি হত্যাপূর্ব জবানবন্দি

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী:

মাথার উপর যতো হুমকি ঝুলছে কখন খুন হয়ে যাই তার ঠিক নেই। চারদিকের যে পরিস্থিতি চলছে তাতে কার কাছে নিরাপত্তা আশা করবো? আর এমন আবেদন করলে হয়তো দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আস্থাহীনতার অপরাধে অপরাধীও হয়ে যেতে পারি।

তার চেয়ে বরং প্রস্তুতি নিয়েই রাখি খুন হওয়ার। সে খুন ঘরের ভেতর হতে পারি, রাস্তায় হতে পারি, হাটে-বাজারে হতে পারি, কাজের ক্ষেত্রসহ যেকোনো স্থানে হতে পারি। সে খুন প্রকাশ্যে হোক আর গোপনে, কেউ যে সাক্ষী দিতে সাহস পাবে না, সেটাও আমি নিশ্চিত। শুধু তদন্তের নামে নিরীহ কেউ যেন শাস্তি না পায়, বা নির্দোষ কেউ যেন হয়রানি না হয় তার একটা বন্দোবস্ত করে রাখার জন্যই এই জবানবন্দি!

খুন হলে পুলিশ সহজে যা খুঁজবে, আমি নারী বলে আমার বিবাহ বহির্ভুত কারো সাথে ঘনিষ্ঠতা আছে কিনা, সেটা কোনো প্রেম-বা পরকীয়া কিনা, বর্তমান বা অতীত স্বামী সম্পর্কের কেউ আছে কিনা, তার সাথে সম্পর্ক কেমন ইত্যাদি! এমন কোনো কাহিনী বানানো গেলে খুব সহজ হবে বিশ্বাসযোগ্য একটি সফল তদন্তের।

পুলিশের এই সহজ হত্যাকারী প্রমাণের পন্থাকে আমি আগাম নস্যাত করে দিয়ে বলে রাখতে চাই, এমন কেউ আমাকে কখনও খুন করবে না। কারণ আমি কখনও কারও স্বাধীনতায় বাদ সাধিনি, কারও স্বাধীনতায় আমারও কোন বাঁধা নেই। আমি জীবিত কী মৃত, তাতে কারও কিছু আসে যায় না। তাই খুন করার প্রশ্নই উঠে না।

আমার জমিজমি বা সম্পত্তি, সোনা-দানা নাই বললেই চলে, যা নিয়ে কারও সাথে বিরোধেরও সম্ভাবনা নেই। আমার বাসায় কোন কিছুতেই তালা লাগানো থাকে না। কাজের লোক চাইলে সবগুলো লকার খুলে তিনবার করে রোজ দেখতেও পারে। তাই আমাকে হত্যা করে কিছু চুরি করার প্রশ্নই নেই।

প্রতিবেশীদের সাথেও আমার কোনো বিরোধ নেই। আমার ডায়রিয়া হলে প্রতিবেশীর ঘর থেকেই জাউভাত রান্না করে আমার জন্য আমার প্রতিবেশী নিয়ে আসে। আমার জন্য ডাক্তার ডাকা, ঔষধ আনাটাও প্রতিবেশী নিজ দায়িত্বে করে। পেশাগতভাবেও আমি আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি দেখি না। জেলার একমাত্র নারী সাংবাদিক হিসেবে অন্য সাংবাদিকরা আমাকে নিয়ে নিশ্চিত থাকে যে আমি কারো পদ-পদবী বা জায়গা দখলে কখনও যাবো না। তাদের কেউ কেউ আমাকে এতোটাই সহায়তা করে যে দূরের কোনো এসাইনমেন্ট হলে আমার হয়ে আলাদা করে কাজটা করে দেয়। যাতে আমাকে কষ্ট করে আবার যেতে না হয়। কাজেই তারা কখনই আমাকে খুন করবে না।

কেউ আমার কাছে কখনই দাবি করতে পারবে না আমি কারো কাছে ধার বা লোন নিয়েছি। আমার কাছে যারা বিভিন্ন সময় সাধ্যের অতিরিক্ত ধার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি, আমি তাদের কাছে কোনদিন তা দাবি করিনি। কাজেই অর্থ সংক্রান্ত কোনো বিরোধে আমাকে হত্যা করতে কেউ আসবে না।

আমার ছেলে-মেয়েরও পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, তারা যাকে পছন্দ করবে তার সাথেই তাদের বিয়ে দেয়া হবে। আমার ছেলে-মেয়েদের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে তারা স্বাধীন। কাজেই আমার ছেলে-মেয়ে কখনই আমার জন্য কোনো চাপ বোধ করবে না।

তবুও আমি যে কোনো মুহুর্তে খুন হয়ে যেতে পারি। পুলিশ যেন আমার বর্ণনার মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে কল্পকাহিনীর ভিলেন বানাতে না পারে, তাদের যেন কোন হয়রানি না করে।

আমার খুনিকে ধরতে ও বিচার করার দাবি করার মতোও কোনো সাহসী হিম্মতওয়ালা কেউ নাও থাকতে পারে। এমনকি মামলা করারও কেউ নাও থাকতে পারে। কারণ আমার আত্মীয়-পরিজন আমার মতোই জানে, মামলা করে কিছুই হবে না। বছরের পর বছর কোর্টে ঘোরাঘুরি করে জুতার তলা ক্ষয় না করে তারা সেই টাকা মুচিকে দিয়ে নিজেদের দুই ঠোঁট সেলাই করে নেবে, দুই চোখ খুঁচিয়ে অন্ধ করে ফেলবে, দুই কান সিমেন্ট পুরে বন্ধ করে নেবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.