পাহাড়ের গভীর অরণ্যে হারিয়ে যায় পূর্ণাদের কান্না

প্রজ্ঞা আহম্মদ জ্যোতি:

এক আদিবাসী বন্ধুর ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে দেখলাম, পূর্ণার মৃত ছবিটিতে ফেসবুকের তরফ থেকে ঝাপসা কভার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে,”This photo may show violent or graphic content.” এবং ”We covered this photo so you can decide if you want to see it.’’ ছবিটি আনকভার করার আর সাহস হয়নি আমার। কারণ ততক্ষণে সেই ছবির বীভৎস বর্ণনা ফেসবুকে ভাইরাল। সেই বীভৎস কথাগুলো পড়া বা শোনার পর আমার আর সাহস হয়নি ছবিটি দেখার।

আমি বারবার শিউরে উঠেছি আমি আঁতকে উঠেছি, যতবার পূর্ণার উপর সেই জঘন্য অত্যাচারের কথাগুলো ভেবেছি।
মেয়েটি ক্লাস ফোরে পড়তো,বয়স ৯/১০এর বেশি হবে না। শুনেছি যার পাপ যত বেশি তার মৃত্যুও তত জঘন্যভাবে হয়। কিন্তু কী পাপ ছিল সেই নয় বছরের ছোট্ট পূর্ণার? তার পাপ কি পাহাড়ে জন্ম নেওয়া!
২০১৮ সালের জানুয়ারী থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত মোট ১২টি পাহাড়ি ধর্ষণের কথা আমরা জেনেছি। যার মধ্যে বেশিরভাগই শিশু/কিশোরি।

হত্যাকাণ্ড, অপহরণ যেন এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিদিনের বিষয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৪৭ বছর। এখনো সেই স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি এই মানুষগুলো। কিন্তু ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তারাও অংশগ্রহণ করেছিল।
পেশাগত কারণে হোক বা বিভিন্নভাবে পাহাড়ি মানুষদের সাথে আমার সম্পর্ক আছে। বুঝতে পারি তারা বাঁচে এক চাপা ক্ষোভে। তবে এটা বুঝি মানুষগুলো খুব সরল। এখনো কানে ভাসে গত বছর রাঙামাটি থেকে ফেরার পথে যখন বাস ছাড়লো, তখন ‘যারগুই তা তা’ বলা মানুষগুলোর সেই কথাটি।

১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তি এখনও আমাদের জন্য অদেখা বস্তু। শান্তির বদলে প্রবল অশান্তিতে বাঁচে পাহাড়ের এই মানুষগুলো। তাদের নেই শান্তিতে এই স্বাধীন বাংলাদেশে বাঁচার অধিকার। তাই নিষ্পাপ পূর্ণাদের ধর্ষিত হওয়ার এই জঘন্য কাহিনীগুলো পাহাড়ের গভীর অরণ্যেই হারিয়ে যায়। আর সেখানেই অট্টহাসিতে শান্তিতে বেঁচে থাকে ধর্ষকের দুরাত্মা। তবুও বিচারের আশা নিয়ে হাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে মৌন মিছিল করে পূর্ণার ভাইবোনেরা, বন্ধুরা, সহপাঠীরা। বিচার চাইতে চাইতে একসময় নিভে যায় সেই মোমবাতিগুলো। ততক্ষণে ধর্ষিত হয় আরও একজন, দুজন, কয়েকজন পূর্ণা।

ছোট্ট পূর্ণার কথা ছিল পুতুলের জন্য কাঁদবে বা পাহাড়ে ছুটে বেড়ানোর জন্য বায়না ধরবে, তাই সে চিৎকার করবে।কিন্তু না পূর্ণা শেষবার চিৎকার করেছিল মৃত্যুর আগে মানুষরূপী হায়নাদের অত্যাচারের সময়। তার সেই চিৎকার মা শুনতে পায়নি। মা তখন ব্যস্ত ছিল পূর্ণা ভাত খাবে তাই ফসল ফলানোর জন্য।

ছোটবেলায় আমাদের পাশের বাসায় এক আদিবাসী পরিবার থাকতো। সেই বাসায় জরিনা নামের ত্রিপুরা এক মেয়ে ছিল। আমি অবাক হতাম তাদের নাম কীভাবে জরিনা হয়!

জরিনা প্রথম প্রথম আমাদের সহ্য করতে পারতো না। খেলতে চাইতো না আমাদের সাথে। তখন বুঝতে পারিনি জরিনা কেন আমাদের পছন্দ করতো না! তাই বিভিন্নভাবে তাকে খ্যাপাতাম। এই যেমন, তাদের বাসায় কলিংবেল বাজিয়ে লুকিয়ে যাওয়া, বাসায় সে একা থাকলে পিছন থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া। এভাবে এক সময় জরিনার সাথে আমাদের ভাবও হয়ে যায়।
বড় হওয়ার পর এখন বুঝি জরিনা কেন তখন আমাদের পছন্দ করতো না।

পাহাড়িদের সাথে সমতলবাসীদের ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা। কিন্তু আমরা থাকি এক দেশে। তাও আবার ৩০ লক্ষ প্রাণ এবং দুই লক্ষ মা, বোনের ধর্ষণের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশে। এই দেশে কি এই জঘন্য কাজগুলো মানায়? এতে কি আমাদের সেই ৪৭ বছর আগের অত্যাচার মিলে যায় না?

প্রজ্ঞা আহম্মদ জ্যোতি,
নাট্যকলা বিভাগ(৩য় বর্ষ)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন: