ভাঙা পরিবারের সাতকাহন, দুমুখো সমাজের প্রতিফলন

সারা বুশরা দ্যুতি:

*মা বাপের ঠিক নাই সে আবার কথা বলতে আসছে।
-ক্লাস সেভেনে পড়া শেফাকে এই কথা শুনতে হয়েছিল তারই এক সহপাঠীর মুখে। কারণ? তার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে।

*যে মেয়ের মা-বাপ দশটা করে বিয়ে করে, সে যতো সুন্দরীই হোক, কোনো লাভ নাই। বিয়ের সময় ছেলে পক্ষ ফ্যামিলি দেখবে, রূপ ধুয়ে পানি খাবে না।
– সদ্য এইচএসসি দেয়া শেফাকে উদ্দেশ্য করে এই কথা বলা হয়েছিল; কারণ ততদিনে তার মা-বাবা দুজনই নতুন করে সংসার শুরু করেছে।

* যেই মাইয়ার মা হাঁটুর বয়সী পোলারে ফাঁসায়ে বিয়ে করে, তার তো চরিত্রের ঠিক নাই। এমন মায়ের মেয়েরে কোন ছেলে বিয়ে করবে?
-তেইশ বছরের শেফাকে এই কথা শুনতে হয়েছিল কারণ তার মায়ের স্বামী মায়ের থেকে বয়সে বেশ অনেকটা ছোট ছিল।

*তোমার মা বাবাকে বলো বাড়িঘর, ফ্ল্যাট বা জমি যাই আছে, সেটা এখনই তোমার নামে লিখে দিতে। তাহলে পাত্রপক্ষ ভাববে মেয়ে পুরাপুরি ফেলনা না, তোমার পায়ের তলার মাটি শক্ত হবে।
– শিক্ষিত ও গুণী হওয়ার পরও শেফার বিয়ের সময় এক শুভাকাঙ্খী শেফাকে এই কথা বলেছিলেন, কারণ সমাজের মানুষ মেয়েদের শিক্ষার চেয়েও তার সম্পত্তিকে তার যোগ্যতা মনে করে…।

* আমাদের সংসারে ঢুকেই সংসার ভাঙার তাল করতেসে, ফ্যামিলি থেকে এই শিক্ষাই তো পাইসে, এজন্যই বলসিলাম ব্রোকেন ফ্যামিলি মেয়েরে বিয়ে করিস না।
-ননদের অন্যায় কথার প্রতিবাদ করার জন্য এই বাক্য স্বামীর সামনেই শেফাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল।

*তোমার মতো এরকম ডিগ্রেডেড ফ্যামিলির মেয়েকে যে ঘরের বৌ করে আনসি, এইটা তো তোমার বিরাট ভাগ্য। নাহলে আমার ছেলের জন্য বহুত মন্ত্রী মিনিস্টারের ঘরের প্রস্তাব ছিল।
সেই বুঝে কথা বলো আমার সাথে।
– শাশুড়ির ইচ্ছামতো না চলার কারণে এই কথা শেফাকে প্রায়ই শুনতে হয়।

এই নতুন যুগে শিক্ষিত মানুষজন যেখানে নিজেদের আধুনিক বলে দাবি করা শিখেছে, সেখানে এখনও মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে এই তালাক এবং তালাক হওয়া ঘরের সন্তানকে স্বাভাবিকভাবে দেখার মানসিকতা তৈরি হয়নি। তাদেরকে যেন একটু আলাদাভাবে দেখতেই হবে আমাদের।

আমরা অনেকেই বলার সময় বড় মুখ করে বলি, ‘ডিভোর্স একটা দুর্ঘটনা, এরকম হতেই পারে, অনেক সময় সবাই সব কিছু মানিয়ে নিতে পারে না, জোর করে নিজেকে কষ্ট দিয়ে সংসার করার চেয়ে তালাক নিয়ে যার যার মতো স্বাধীন জীবনযাপন করা একদিক দিয়ে ঠিকই আছে। সব মানুষের নিজেকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়ার অধিকার আছে। একটা বিয়ে টিকেনি তো কী হয়েছে? আবার বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করা দোষের কিছু না। এসবকে খারাপ চোখে দেখার মতো সংকীর্ণ আমরা নই ইত্যাদি ইত্যাদি।’

এই যদি সংকীর্ণ না হওয়ার নমুনা হয়, তবে সংকীর্ণ হলে কী অবস্থা হতো একটু ভেবে দেখুন তো!

প্রতিটি মানুষের জীবন আলাদা। কারও কৃতকর্মের জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়তো। তাহলে মা-বাবার জন্য সন্তান কেন সারা জীবন শাস্তি পাবে? বিশেষ করে মেয়ে সন্তান? ছেলেদের ক্ষেত্রে কিন্তু এতোটা সমস্যা হয় না। কিন্তু মেয়েদের তো মাফ নেই… পান থেকে চুন খসলেই যেখানে মেয়েদের গায়ে কলঙ্ক লাগে, সেখানে পরিবারের ইতিহাসে এরকম একটা ঘটনা থোড়াই না করে দেখা যায়! সেও কি হয় নাকি আবার?

আমি একজনকে চিনতাম রুবা (ছদ্মনাম), সে প্রায়ই খুব আহলাদ করে বলতো, তার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছে দেখে তার কষ্ট হলেও আরেকদিকে খুব লাভ হয়েছে। কারণ তার আত্মীয় স্বজনরা সবাই তাকে এখন এক্সট্রা আদর করে, এক্সট্রা এটেনশন দেয়। আর সবাই তাকে ভীষণ প্যাম্পার করে।

বাবার কাছে যখন থাকতে যায় বাবা তার সব শখ ইচ্ছা পূরণ করে, আবার যখন মা’র সংসারে যায় তখন মাও তার জন্য সাধের বাইরে গিয়ে করে। কাজেই ব্রোকেন পরিবারের মেয়ে হওয়ার দুঃখ সে আরেকদিকে পুষিয়ে নেয়। বহুদিন পরে মেয়েটি বলেছিলো জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে তার মনে হয়েছে তাকে যে সবাই একটু বেশি কেয়ার করতো, প্রশ্রয় দিতো, এটা হয়তো ভালোবাসার চেয়ে করুণা বেশি ছিল।

নিশ্চয়ই আপনজনেরা ভাবতো আহা বেচারি দুঃখী, সারাজীবন তো কষ্টে কষ্টেই কাটবে, আমরা একটু নাহয় বেশি আদর করে দেই। একথা বলার সময় তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে দেখেছিলাম। বাবা মায়ের ঘটনার জন্য তার মনের মধ্যে প্রেম, বিয়ে এসব নিয়ে একটা ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল। তার পরিবার থেকে যখন তাকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিলো তখন পাত্র পক্ষ এমন কথাও নাকি বলেছে যে এই মেয়ে থাকে সৎমার কাছে, আমাদের ছেলে তো তাহলে শাশুড়ির আদর, জামাই খাতির এগুলা কিছুই পাবে না। এখানে ছেলে বিয়ে দিলে লস।

সব আদর, সব খাতির, সব সম্মান তো শুধু ছেলেদের এক চেটিয়া অধিকার! তারা কেন লস করবে জীবনে কোনকিছুতে? মেয়েদের লোকসান নিয়ে ভ্রুক্ষেপ করার সময় কি কারো আছে?

এখানে একজন শেফা বা রুবা নয়…. আরও বহু মেয়ে এরকম মানসিক যাতনা সহ্য করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়….কথা শোনা ব্যাপারটা এতোটাই স্বাভাবিক হয়ে যায় যে তারা মুখ ফুটে বেশিরভাগ সময় বলতেও পারে না যে, ”আমার কী দোষ? আমি কেন এসব শুনবো? আমি তো এসব কোনো কিছুর জন্যই দায়ী না। সব কথায় আমার মা বাবার ডিভোর্স বা তাদের আবার বিয়ে এসব রেফারেন্স টেনে এনে আমাকে জব্দ করার প্রচেষ্টা অবান্তর ও হাস্যকর। তাদের জীবন তাদের, আমারটা আমার। ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে হওয়াকে আমি নিজের দুর্বলতা মনে করি না, কারণ আমি জানি আমার কোনো খুঁত নেই। আমি নিজেকে নিয়ে গর্বিত। আপনি/আপনারা চাইলেও আমাকে ছোট করতে পারবেন না, কখনোই না।’

এখনও যদি এভাবে বলতে পারা না যায়, তো আর কবে? সমাজের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মানুষগুলোর প্রতি তাচ্ছিল্যের একটা হাসি হেসে বলা প্রয়োজন যারা ব্রোকেন ফ্যামিলিকে ডিগ্রেডেড ফ্যামিলি হিসেবে অভিহিত করেন, তারা নিজেরাই আসলে হীন ও নিচু। তারাই সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত সমাজে বাসের অযোগ্য। নয় কি?

বেডফোর্ডশায়ার, ইংল্যান্ড

শেয়ার করুন: