‘ডিভোর্সি’ হতেও যোগ্যতা লাগে

আকতার বানু আলপনা:

আমি একটি মেয়েকে মনে মনে খুব ঈর্ষা করতাম। যদিও মেয়েটিকে আমি খুব ভালো চিনতাম না। তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন যোগাযোগ বা সম্পর্কও নেই। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তাঁর সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তাতে ঈর্ষা করার মতো তাঁর অনেক কিছুই আছে। যেমন – মেয়েটি উচ্চশিক্ষিতা, চাকরিজীবী, সুন্দরী। আমার মতো টুকটাক লেখালেখিও করেন। সচেতন, মিশুক এবং ডিভোর্সি (একটি সন্তান নিয়ে তিনি একা থাকেন)।

আপনারা হয়তো ভাবছেন, “ডিভোর্সি” হওয়াটা কি কোনো যোগ্যতা নাকি? এই যোগ্যতার (!) জন্য কি কাউকে ঈর্ষা বা শ্রদ্ধা করা যায়?

যায়। ‘ডিভোর্সি’ হতেও যোগ্যতা লাগে। নিরাপত্তার জীবন ছেড়ে একা হতে সাহস লাগে, বুকের পাটা লাগে। নিজের ও সন্তানের দায় একা সামলাবার ক্ষমতা লাগে। সমাজের লোকেদের হাজার গঞ্জনা হজম করে ঘর ও অফিসের কাজ একা সামাল দিয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট মেনে নেবার মতো মনোবল লাগে। সবার সেসব থাকে না বলেই আত্মসম্মান খুইয়ে নারীরা পরাধীন, অপমানজনক জীবন পার করে। প্রমাণ দেই।

১। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর নীলুফার সুলতানার এক গবেষণায় পাওয়া গেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তাঁর বেতন তিনি নিজে তুলতে পারেন না। চেক সই করে দেন। তাঁর স্বামী টাকা তোলেন। তাঁর একাউন্টে কত টাকা আছে তা তিনি জানেন না। টাকা দিতে না চাইলে স্বামী তাঁকে নির্যাতন করেন। মানসম্মানের ভয়ে তিনি স্বামীকে তালাক দেন না।

২। আমি যে ব্লগগুলোতে লিখি, তার কোন একটিতে একজন ডাক্তার লেখিকা আছেন। তাঁর স্বামী তাঁকে মেরে তাঁর হাত ভেঙ্গে দিয়েছেন। রোজ নির্যাতন করেন। টাকা কেড়ে নেন। তবু তিনি স্বামীকে ছাড়েন না মানসম্মানের ভয়ে ও ছেলের কথা ভেবে।

৩। নায়িকা অপু নিজে যোগ্যতাসম্পন্না হবার পরেও নিজের আত্মসম্মান খুইয়ে সাকিবের দাসত্ব মেনে নিয়েছিলেন সামাজিক মর্যাদার লোভে পড়ে। তার মাশুল তাঁকে এখন দিতে হয়েছে তালাক নিয়ে। সুতরাং ক্ষমতা থাকলেও সবাই নিজের আত্মমর্যাদা রক্ষা করে স্বামীর ঘর করতে পারেন না।

৪। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বাংলাদেশের শতকরা আশিভাগ নারী নিজ গৃহে তাঁর অতি আপনজন দ্বারা নির্যাতিতা (তার মানে, মাত্র বিশভাগ স্বামীরা স্ত্রীর প্রতি সদয় আচরণ করেন)। এই আশিভাগ নারীরাও দিনের পর দিন নির্যাতন হজম করে সংসার করেন স্বামীর প্রতি সামাজিক ও আর্থিক নির্ভরশীলতার কারণে।

রোজ যৌতুকের জন্য নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, হাজার নিপীড়নসহ ঘরে বাইরে নারীর প্রতি নানা সহিংসতা প্রমাণ করে, তারা আমাদের সমাজে কতটা অনিরাপদ। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা তাঁদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন মেনে নিয়ে স্বামীর ঘর করেন তাঁদের এই আর্থ-সামাজিক, মূলত আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে।

নারীকে বেশিরভাগ পুরুষ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে দেন না। প্রায় সব পরিবারে অর্থ নিয়ন্ত্রণ করেন পুরুষরা। তাই মেয়েরা সারাজীবন পরনির্ভরশীল থেকে যান। তাঁরা বিয়ের আগে বাবার, বিয়ের পর স্বামীর এবং স্বামীর অবর্তমানে ছেলের উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হন। মেয়েদেরকে সবসময় আর্থিক দিক থেকে বঞ্চিত করা হয়। বাবার সম্পত্তিতে অংশ বা বিধবা হলে স্বামীর সম্পত্তি সবসময় ঠিকমতো দেয়া হয় না।

স্ত্রীধন, তালাকের পর খোরপোষ – বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেয়া হয় না। এমনকি বাবার দেয়া যৌতুক বা সম্পদের উপরেও স্ত্রীর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। দেনমোহরটাও বেশিরভাগ সময় স্বামীরা দেন না। কেউ কেউ মোহরানা দেন। কিন্তু সেটা কোন না কোন বিনিয়োগে খাটানো হয়, যা স্বামী নিয়ন্ত্রণ করেন। স্ত্রী উপার্জন করলেও নিজের ইচ্ছামতো স্বামী তা স্ত্রীকে খরচ করতে দেন না।

বেশিরভাগ স্বামীরা স্ত্রীর সম্পদ বা আয় নিজের মনে করেন এবং জোর করে বা কৌশলে নিজের করায়ত্তে রাখেন। স্ত্রীর উপার্জনে স্বামীর কোন হক নেই এবং স্ত্রী স্বেচ্ছায় না দিলে সেটা স্বামী নিতে পারেন না, এটা তাঁরা মানেন না। ফলে উপার্জনক্ষম নারীরাও নিজের আয় ইচ্ছামত ব্যয় করতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়।

পুরুষরা (এমনকি নারীরাও) বলবেন, “ডিভোর্স নিয়েছে মানে সে মেয়ে ভালো না। মানিয়ে চলতে পারেনি। সংসারে ঝগড়া, মতের অমিল হতেই পারে। তাই বলে স্বামী ছাড়তে হবে? একটু মানিয়ে চললে কী হয়?” কিন্তু বাস্তবতা হলো, কোন মেয়েই শখ করে স্বামী ছাড়ে না। যখন আর মানিয়ে চলা সম্ভব হয় না, তখন নিতান্ত বাধ্য হয়ে ছাড়ে। কখনও স্বামীর পরকীয়া, বহুবিবাহ, নির্যাতন, মাদকাসক্তি, অমানবিক নানা আচরণ ইত্যাদি নারীকে স্বামী ছাড়তে বাধ্য করে।

আজ সেই ডিভোর্সি মহিলার একটি খবর শুনে ঈর্ষার পরিবর্তে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিতে মনটা ভরে গেল! তাঁর একমাত্র সন্তানটি অটিস্টিক (এবং এই সন্তানকে নিয়েই তিনি তাঁর মত করে ভালো আছেন)। ফলে অফিস ও বাসার কাজ ছাড়াও সন্তানের দেখভাল করতে গিয়ে তাঁকে রোজ সীমাহীন পরিশ্রম করে টিকে থাকতে হয়। এই সন্তানের জন্যই তিনি আর বিয়েও করতে পারেননি।

দূর থেকে অনেককেই (হোক সে বিবাহিতা, একা বা যেকোনো মানুষ) অনেক সুখী মনে হয়। কিন্তু কাছে গেলে হয়তো আপনার ধারণা ভুলও হতে পারে। হয়তো দেখবেন, তাঁর বুকের ভেতরে রয়েছে দূরারোগ্য কোন কষ্টের আবাদ!!

“অনন্ত, মেহেদি পাতা দেখেছো নিশ্চয়?
উপরে সবুজ, ভেতরে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত-“………

শেয়ার করুন: