“অর্থ” এক বিশেষ শিশু, আমার ভাই

রুমানা রশিদ রুমি:

অর্থ আমার খালাতো ভাই, এক বিশেষ শিশু। ওর জন্মদিনে ওকে কখনও শুভেচ্ছা জানানো হয়নি। চারপাশে ফুলেরা ফুটে থাকে তা বোঝার মতো আগ্রহ ওর নেই। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসর্ডার (এএসডি) আছে ওর।

ওর বাবা-মা, এমনকি আমরা চারপাশের আত্মীয়-স্বজন কখনোই এটা শুনতে প্রস্তুত ছিলাম না। আজ থেকে প্রায় ১৮/১৯ বছর আগে ওর যখন জন্ম হয়, বাংলাদেশে খুব কম সংখ্যক মানুষ অটিজম সম্পর্কে জানতো। মিরপুরের সিআরপিতে পাঁচ বছরের অনার্স কোর্সে মাত্র পাঁচটি সিট ছিল। যারা পাশ করে বের হতেন সেই থেরাপিস্টরা সিআরপিতেই জয়েন করতেন। আর সিআরপিতে থেরাপি দিতে সিডিউল পাওয়া খুব কষ্টকর ছিল। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা ছিল তাদের কাছে না গেলে বোঝা যেত না শিশুটি আসলে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসর্ডার (এএসডি) গ্রস্থ। অন্য ডাক্তাররা প্রতিবন্ধী শিশুদের সাথে অটিজমকে গুলিয়ে ফেলতেন।

আড়াই মাসের অর্থকে গোসল করানোর সময় ওর ঘাড় শক্ত হয় না দেখে খালা বার বার সবাইকে জানাতো। প্রথম মা হবার অভিজ্ঞতা, তাই অনেক কিছুই ছিল তার অজানা। মা-খালা-নানীরা বলতেন, ঠিক হয়ে যাবে। বুকের দুধ খাবার সময় ছেলে তার দুধ খেত ঠিকই, কিন্তু ছিল না আই কন্টাক্ট। ভাবলেন চোখের সমস্যা। চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি কিছুটা আন্দাজ করলেও সরাসরি কিছু বলেননি। পাঠালেন ঢাকার শ্যামলীতে শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে। আর কিছু থেরাপি দিলেন। কিন্তু তিন মাসের আগে সিডিউল পাওয়া গেল না।

নতুন মা হওয়ার ধকলে খালা আর গরজ করলেন না। সবার ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ কথায় আশ্বস্ত হয়ে থাকলেন। সাত মাসের মাথায় অর্থের খুব ঠাণ্ডা লাগলো। যে চিকিৎসকের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো, তিনি বেশ রুঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন –

“আপনার ছেলে তো প্রতিবন্ধী। এ ধরনের বাচ্চাদের প্রায়ই ঠাণ্ডা লাগবে। এর তো কোনো ভবিষ্যত নাই।” খালা যে বড় রকমের আঘাত সেদিন পেয়েছিলেন, তাতে প্রায় সাতদিন শুধু কেঁদেছেন। ছেলেকে নিয়ে চারপাশের অনিশ্চিত জীবন তাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। ছেলেকে তো আর মেরে ফেলতে পারবেন না। পত্রিকায় এমন কতো খবর আসে। ভয়ে কুঁকড়ে ওঠেন। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে অর্থকে খাওয়ানো, কিছু ধরতে শেখানো, এসব করতে থাকেন। কিন্তু ও কিছু ধরতে চাইতো না। শুধু হাত দুটো নিয়ে খেলতো নিজের মনে। প্রকাশ করতে পারতো না নিজেকে। একটু বড় হতে হতে তার আরও কিছু পরিবর্তন হতে থাকলো। অস্বাভাবিক চিৎকার করতো, ডাক দিলে সাড়া দিতো, কিন্তু কিছু করতে বললে তা করার নির্দেশ রিসিভ করতো না। সামাজিক এডাপটিবিলিটি ছিল না বললেই চলে।

খালা শিশু বিকাশ কেন্দ্রে যোগাযোগ করেন। এবার মিললো সিডিউল। কিন্তো ততদিনে অর্থ প্রায় সাড়ে তিন বছরের। প্রথম দিন চিকিৎসক বললেন, পরেরদিন হাজবেন্ডসহ আসবেন। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনকে কাউন্সেলিং করেন। সিআরপি থেকে তিন দিনের স্পেশাল স্পিচ থেরাপি নিতে বলেন এবং অর্থকে স্কুলে ভর্তি করাতে বলেন। কিন্তু সিআরপির সিডিউল আর মেলে না। নানান ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হতো। তাই নিজেই স্পেশাল এডুকেশন এর ওপর পড়াশোনা শুরু করলেন। বিএড সমমানের কোর্স করলেন। নিজের হাতে মানিকগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করলেন অটিস্টিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী পুন:র্বাসন নিবাস। যাতে তার অবর্তমানে অর্থকে দেখাশোনার জন্য অন্তত লোক থাকে।

পড়াশোনা করে তিনি জেনেছেন অকুপেশনাল থেরাপি আর স্পিচ থেরাপি এই অটিজম স্পেকট্রাম ডিসর্ডার (এএসডি) এর জন্য একমাত্র কার্যকরি। এর মধ্যে অকুপেশনাল থেরাপি তার বাচ্চার সবদিকে অগ্রগতি ঘটাবে –
১/সোশ্যাল,
২/কালচারাল,
৩/ফিজিক্যাল
৪/কগনেটিভ
৫/এডুকেশনাল
মোট কথা সবদিকের উন্নতি হবে অর্থের।

সবচেয়ে বেশি বিপদ হতে থাকলো যখন অর্থ বয়ো:সন্ধিকালে পৌছালো তখন। প্রায়ই জামা –প্যান্ট খুলে নেংটো হয়ে ঘুরতো। ওকে যদি ধমক দিয়ে বলা হতো কখনো কথা শুনেছে, কখনো শোনেনি। গোপনাঙ্গকে সারাক্ষণই নাড়ছে। বকা দিলে বুঝতো এটা ভালো কাজ নয়, লজ্জার। কিন্তু কাজটা থেকে বিরত থাকতো না।

অকুপেশনাল থেরাপি পাবার পর সে সারাক্ষণই কোন না কোন কাজের অধীনে থাকে। একটা রুটিন মাফিক জীবনে তাকে আবদ্ধ করা হয়। থেরাপিস্ট তাকে নানান কাজে ব্যস্ত করিয়ে দেন। এতে করে অর্থের চিৎকার করা কমেছে। এখন সে নিজে হাতে টয়লেটের কাজ শেষে নিজেকে পরিষ্কার করা শিখছে। গোসল করতে গায়ে পানি ঢালতে পারে। হাতে মুঠো করে কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে। জামা-কাপড় পড়তে পারে। এই যে নিজের কাজটুকু নিজে করতে শিখছে এটাই অনেক বড় বিষয়।

এখন বাংলাদেশে অটিজম শিশুর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, যা খুবই আশংকাজনক, তেমনি আশার কথা যে এ নিয়ে সচেতনতাও বাড়ছে। সুবিধা বাড়ছে। যেমন চিকিৎসক মহলে, তেমনি অভিভাবক মহলেও। অর্থের ক্ষেত্রে হয়তো অল্প সময়েই ডিজঅর্ডারটা ধরা পড়লে যথাসময়ে সামাজিক খাপ খাওয়ানো ওর জন্য আরও সহজ হতো। এখন ডাক্তাররাও আরও সচেতন হয়েছেন। শুধু অর্থের জন্য হয়তো সব একটু দেরিতে হয়েছে। ও চারপাশের ফুটে থাকা আরও কতগুলো ফুলের মতো দিনে দিনে প্রস্ফুটিত হোক এ কামনা রইলো।

আর প্রত্যাশা রইলো যে সকল মা একটি বিশেষ শিশুর পরিচর্যা করছেন, তারা মানসিক মনোবলটুকু যেন না হারান। তারা আসলে ঠিক রক্তমাংসের মা নন, তারা একেকজন দেবী, সর্বংসহা। এতা ধৈর্য নিয়ে তারা এসব শিশুর দেখভাল করেন যে, শ্রদ্ধায় আপনাতেই আনত হয় মাথা। সেইসব মায়েদের মনের শক্তিতে চারপাশে প্রতিদিন ফুটুক এক একটি ফুল।

(অটিজম নিয়ে অন্যদেরও লেখার আহ্বান রইলো)

শেয়ার করুন: