সুপ্রীতি ধর:
চিঠিটা আমার রক্তে ভেজা, হৃদয়ক্ষরণের সেই রক্ত, ছিঁড়েও গেছে বার বার লেখায়। তারপরও লিখে যাই। যখন একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আমাকেই সন্দেহ প্রকাশ করে, তখন চিঠিটা মনের ভেতর থেকে বের করে বার বার পড়ি, আর চোখ মুছি। ভিতরটা কষ্টে দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
আমাদের পরিবারের একাত্তর শুধুমাত্র একটি নির্দ্দিষ্ট বছরেই শেষ হয়নি। আমার মায়ের একাত্তর ছিল জীবনভর, যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন। বলতেনও। যখনই বিপদের মুখে কুলকিনারা পেতাম না, মা বলতো, ‘ধরে নে, এটা তোর একাত্তর’। এভাবেই আমরা একাত্তরকে ধারণ করেছি। সারাটা জীবন দিয়ে। কোনদিন কথায়, ব্যবহারে, চলনে-বলনে একাত্তরচ্যুত হইনি। এ এক কঠিন আদর্শ আমাদের জন্য। যে কারণে অসভ্যতা, অশ্লীলতা, গালিগালাজের উত্তর আমরা দিতে পারি না। দেশের জন্য, দশের জন্য কিছু একটা করার স্পৃহা সবসময় জাগ্রত থাকে। এতো সেই আদর্শই, তাই না?
সবার ছোট সন্তান ছিলাম বলে অভিমানটা বড় বেশি। মাঝে মাঝেই মনে হয়, কী এমন হতো তিরিশ লাখের মধ্যে একজন পিতা বেঁচে থাকলে! আর সেই পিতা যদি আমারই বাবুজী হতো! আমার কল্পনায় বাবুজী আছে, স্মৃতিতে নেই। তবে সারা জীবন ধরে বাবুজীকে অনুভব করেছি আমি।
আমার যত দুর্বলতা, যত খামতি, যত না পাওয়া, সব ওই একজনকে না পাওয়ার কারণেই।
নিচের চিঠিটি তিন বছর আগে এই দিনে লেখা। তখন সরকারেরই অনলাইনজীবী গালিবাজ গ্রুপ আমার ওপর হামলে পড়েছিল তাদের নোংরা আর কদর্য ভাষা নিয়ে। আর বিশিষ্ট সুশীল, বুদ্ধিজীবী, রবীন্দ্রপ্রেমীরা তখন দূর থেকে দেখেছেন সেই হামলা, কেউ এগিয়ে আসেনি ওদের থামাতে। অথচ তাদের নিয়েই সেই মানুষগুলোর উঠাবসা, পথচলা। তারাই নাকি তাদের ‘সমমনা’।
চিঠিটি আবার উল্লেখ করছি এখানে –
প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, আজ ১৬ই মে আমার বাবুজী (বাবা) মধুসূদন ধরের অন্তর্ধানের দিন। না, তিনি গৌতম বুদ্ধের মতোন সংসারত্যাগী হয়ে চলে যাননি, তাঁকে ডেকে নিয়ে গেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। গ্রামের বাড়িতে তখন শহুরে আত্মীয়দের ঢল, সবাই প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের এখানে। তাদের যাতে কোনো অমঙ্গল না হয়, সেজন্যই বাবা নির্দ্বিধায় চলে গিয়েছিলেন পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে। ১৯৭১ সালের এই দিনটি থেকে আমরা চার ভাইবোন, আমার মা, ঠাকুরমা কেউই তাদের প্রিয় মানুষটিকে আর দেখতে পাইনি।
বাবার একটা পোশাকি নাম আছে, যা আমাদের সার্টিফিকেট আর পাসপোর্টে শোভা পায়। কিন্তু মধুসূদন ধর নামেই এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন। সবার প্রিয় ‘মধুদা’ ছিলেন তিনি। কী সামাজিকতায়, কী রাজনীতিতে, কী খেলাধুলায়, কী সাংগঠনিক দক্ষতায় সবখানেই তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। ফুটবল, ক্রিকেটে বাবার নাম চেনাজানা সবার। এটাও হয়তো কাল হয়েছিল একাত্তরে।
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন, আপনার কষ্ট আমরা যারা হারিয়েছি, তারাই বেশি অনুভব করি। কারণ যার যায় সেই জানে কী যায়! কিন্তু তাই বলে আমার বাবার যাওয়াটা কিন্তু কম নয় কোনো অংশেই। পুরো পরিবার বিধ্বস্ত হয়ে যায়। আমার বড়বোনের বয়স তখন ১৯, তারপরের দাদা ১৮, ছোটদাদা ১৩ আর আমি কোলে। ধারণা করতে পারেন, কী অসীম মানসিক ক্ষমতা থাকলেই মা সেদিন সমস্ত শোক পাশে সরিয়ে আমাদের আগলে নিয়ে শরণার্থী শিবির হয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতে!
প্রধানমন্ত্রী, আপনি চোখ বন্ধ করে একটিবার একটু ভাবুন আমার মায়ের সেই সময়কার মানসিক ভঙ্গুরতা, একইসাথে ঋজুতার কথাও। আর ভাবুন আমার বাবার কথা। জানি না কত কষ্ট দিয়ে তাঁকে মারা হয়েছে, কত নির্যাতন তাঁকে সইতে হয়েছে। কিছুই জানি না। শুধু জানি, বাবা আমার শেষমূহূর্তে খেতে চেয়েছিলেন পুরনো ভৃত্য পাঞ্জর চাচার কাছে। সেই চাচা এক টুকরো পাউরুটি কিনে দিতে পারেননি স্টেশনে। বাবা আমার খিদে পেটে নিয়েই যাত্রা করেছিল অনন্তের উদ্দেশে। আর পাঞ্জর কাকাও জীবনভর একথা মনে করে কেঁদে গেছেন।
মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, আমরা কিন্তু থেকে যেতে পারতাম ভারতে। থাকিনি। যে কারণে বাবা আমার সাতচল্লিশে দেশ ছাড়েনি, আমরাও ফিরে এসেছি এই মাটিরই টানে। (আমরাও বার বার ফিরে আসি এই দেশেরই টানে)। বাবাহীন সেই সংসারে আমাদের চারজনকে নিয়ে মা তার সামান্য চাকরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নতুন যুদ্ধে। এই যুদ্ধটা কিন্তু আপনার অপরিচিত। কারণ কোনদিন না খেয়ে থাকার কষ্ট, না পরার কষ্ট আপনি পাননি। আপনাদের সেই প্রাচুর্য ছিল। আমরা শূন্য থেকে শুরু করেছি। সম্বল একটাই আমাদের। মেধা। মা সেখানেই জয়ী হয়েছেন। আমরা বড় হয়েছি কারও আনুকূল্য, দয়াদাক্ষিণ্য ছাড়াই, প্রতিকূল পরিবেশের সাথে প্রতি মূহূর্তে লড়াই করেই। যা এখনও করছি।
আপনাকে আরও একটা কথা জানাই। আমার মা-বাবা দুজনই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, করতেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। তাদেরই সময়ে সুভাষ বোস ময়মনসিংহের গৌরীপুর এসেছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে বাবা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেন এবং প্রচারণায় অংশ নেন। গৌরীপুর স্টেশনে আপনার বাবার সেই প্রচারণা অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম বাবার কোলে চড়ে (এসবই শোনা কথা)। বাবা এর মাশুল দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে।
প্রধানমন্ত্রী, আমরা কিন্তু কিছু চাইনি আপনার কাছে কোনদিন। শহীদের মর্যাদাও আমার বাবা পাননি। তাতে কী? তাতে কী তাঁর অবদান ক্ষুন্ন হয়েছে? আমরা তার সন্তানরা তো জানি, ওই যে পতাকা আজ পতপত করে উড়ে স্বাধীন বাংলাদেশে, সেখানে আমার বাবার রক্তও মিশে আছে।
আজ এতো কথা কেন বলছি জানেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! বলছি কষ্ট থেকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর আগে থেকেই যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছি। এখনও রাস্তায় থাকি। এজন্য মাশুলও দিয়ে চলেছি। গণমাধ্যমে বিরাগভাজন হয়েছি, চাকরি হারিয়েছি।
আপনার প্রশাসনের ভুল পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছি। সমালোচনা মানেই আপনার বিরোধিতা নয়, এটা আপনার চারপাশে থাকা চাটুকাররা বোঝে না। কারণ ভুলটুকু না শোধরানো হলে এই দেশের পতাকা, যে পতাকা মানে আমার বাবা, সে কখনও আমাকে ক্ষমা করবে না। আমি ওই পতাকার দিকে তাকিয়েই রাস্তায় নামি, কলম ধরি। সেটা আপনার বিরুদ্ধে হলেও। কারণ, আপোস আমার রক্তে নেই। ওই পতাকা আমাকে আপোস করতে দেয় না।
আজ খুব দু:খ নিয়ে বলছি, আপনি যাদের কাছের মানুষ ভাবেন, তাদেরই কিছুজন আমাকে অশ্লীলভাবে হামলা করেছে অনলাইনে। এই ভাষা প্রকাশের নয়। আমার বাবাকে আপনারা শহীদ বলুন আর না্ই বলুন, তাতে তাঁর অবদান ক্ষুন্ন হয় না। এরকম অসাধারণ, বিপ্লবী বাবা-মায়ের সন্তানকে ওরা অনলাইনে যখন অশ্লীল খিস্তিখেউড় করে, ধর্ষণ করে, আমার মেয়েকেও ওরা রেহাই দেয় না, তখন সব অভিমান আমার আপনার ওপরই হয়। আপনি তাহলে আমাদের কিসের নেত্রী?
প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমার বা আমাদের ধন-সম্পদ চাওয়ার নেই। সম্মানের সাথে বাঁচতে চাই। গত কয়েকদিনে সাইবার সন্ত্রাসের মাধ্যমে যে অন্যায় হয়েছে আমার ওপর এবং আমার পরবর্তী প্রজন্মের ওপর, আপনি তার বিচার করবেন, এটাই আমার চাওয়া। আমার কাছে স্বাধীনতা মানেই বাবার রক্তে রঞ্জিত একটি দেশের পতাকা। আমার প্রেম, আমার দ্রোহ, আমার প্রতিবাদ সব ওই এক পতাকাকে ঘিরেই…….
উপরের কথাগুলো লিখতে গিয়ে গলাটা ধরে এলো আমার, মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী। দেশপ্রেম কোনো অংশেই আপনার চেয়ে কম নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে অনেক বেশিই। যখন আমি ‘আমার সোনার বাংলা’ বলি, তখন আমার বাবা-মা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে থাকেন। সেখানেই আমার শক্তি।
ফুটনোট:
বাবাকে হারানোর পর আমরা যে দেশে ফিরে এসেছিলাম, শুধু তাই নয়। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর যখন পরিবারের অন্য আত্মীয়রা একের পর এক দেশ ছেড়ে যাচ্ছিল, তখনও আমার বাবা মাটি কামড়ে পড়েছিলেন এখানেই। আমরা তাঁর তখনকার কিছু চিঠি সম্প্রতি পেয়েছি, মাকে লেখা (তখনও তাদের বিয়ে হয়নি)। এটা প্রেমপত্র ছিল না মোটেও। বরং ইতিহাসের ক্ষুদ্র দলিল বলা চলে। কেন বাবা দেশ ছাড়বে না, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে সেই চিঠিতে। অথচ আজ আমাকে দেশ ছাড়তে হয় শুধুমাত্র একটু বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু কেন?