কনের ছোট বোন বা প্রেমিকার বান্ধবীকেই বেশি পছন্দ যাদের!

মাকসুদা লিসা:

ঘটনা (১)-

নীরা ও মীরা আপন দু’বোন। ঠিক পিঠাপিঠি বয়সের বলা যায় না। দু’জনের বয়সের ব্যবধান তিন বছর। তবে দুজনের মধ্যে বেশ ভাব। একে অপরের ছায়া সঙ্গী। উভয়ের ভালবাসা ও আন্তরিকতা যেমন বেশি, আবার খুনসুটিও লেগেই থাকে। দু’বোনের ঝগড়া মেটাতে তাদের ‘মা’ গুলবাহারকে বেশ তটস্থ থাকতে হয়। একবার রাগ অভিমান হলে সেটার রেশ থাকে কয়েকদিন। দু’বোনের কথা বন্ধ থাকে। আবার মেঘ কেটে গেলে সেই আগের মতো। সব ঠিকঠাক।

নীরা বড়। মীরা ছোট। নীরা ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বিএ ভর্তি হবার অপেক্ষায়। মীরা স্কুলের গণ্ডি পার হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বয়সে বড় হলেও নীরা’র দৈহিক গড়ন ছোট খাটো, হাল্কা পাতলা। নীরা’র গায়ের রঙ বেশ উজ্জল। এদিকে বয়সের তুলনায় মীরার দৈহিক গড়ন বেশ ভালো। চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব আছে। নীরা’র মতো উজ্জ্বল ত্বক নয়। শ্যামবর্ণ। ঠিক কালোও বলা যায় না। তবে একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব আছে। ফলে নীরা’র চেয়ে মীরাকেই বেশ ভালো লাগে দেখতে।

বড় মেয়ের বিয়ের জন্য মা গুলবাহার গোপনে, আড়ালে পাত্রের সন্ধান চালাচ্ছেন। নিকটস্থ আত্মীয়-স্বজনকে জানিয়ে রেখেছেন ভালো পাত্রের সন্ধান পেলে খবর দিতে।

দুই মেয়েকে বাসায় আরবী পড়াতে আসেন একজন বয়স্ক পরহেজগার মহিলা। যার কাছে গুলবাহারও শুদ্ধভাবে আরবী পড়েছেন। নীরা, মীরাদের জন্মের আগে। আরবী শিক্ষিকা দুই পাড়ায় বেশ কয়েকবাড়িতে মহিলাদের আরবী পড়ান। এটাই তার পেশা। যার সুবাদে অনেকের অন্দর মহলের খোঁজখবর থাকে শোভার মা’র (আরবী শিক্ষিকা) কাছে। পাশাপাশি ঘটকের কাজ করে কিছুটা উপরি উপার্জনের চেষ্টা করেন। নিজের দাবিদাওয়া নেই। কোন কেস (বিয়ে) ফিট হয়ে গেলে, পাত্র-পাত্রীর পক্ষ থেকে উপঢৌকন পেয়ে থাকেন।

গুলবাহার বলে রেখেছেন, ভাল সম্ভ্রান্ত পরিবারের কোনো পাত্রের সন্ধান পেলে জানাতে।
শোভার মা বেশ অনেকদিন পর এক পাত্রের সন্ধান আনলেন। পাত্র জাপানে থাকেন। শিক্ষিত। ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি আছে। ছেলে বিয়ে করার জন্য দেশে এসেছেন। বিয়ে করে ফিরে যাবেন। ছেলের বড় বোন মেয়ে দেখতে চেয়েছেন। গুলবাহার বুদ্ধি করে বাসায় আমন্ত্রণ না জানিয়ে বলে দিলেন, মার্কেটে কেনা-কাটার ছলে দেখা সাক্ষাৎ হবার কথা। গুলবাহার দু’মেয়েকে পাঠালেন আরবী শিক্ষিকার সংগে।

পাত্রের বড় বোন ছেলের সাথে এসেছেন। প্রবাসি, আধুনিক ছেলে। বেশ লম্বা চওড়া। সুদর্শন।
সৌজন্যমূলক কথা হলো। পাত্রের বোনই বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন। পড়াশোনা কোথায় করছে, সাথে যে এসেছে সে কি বান্ধুবী না অন্য কেউ? ইত্যাদি ইত্যাদি। মিনিট দশেকের কথাবার্তা চললো। এরপর বিদায় নিয়ে ফিরে এলেন। ঘটক শোভার মা বেশ আশাবাদী ছিলেন। নীরা দেখতে শুনতে ভালো। ঠাণ্ডা মেজাজের। পাত্রের অপছন্দ হবার কোনো কারণ নেই। গুলবাহারকে আগেই বলে রেখেছিলেন, এবার একটা বেশ দামি শাড়ি তার চাই। নীরাদের পরিবারের বেশ নামডাক আছে। ঢাকার মতো জায়গায় বেশ কয়েকটা বাড়ি তাদের। এমন পাত্রী সহজে কেউ হাতছাড়া করে না।

দেখা সাক্ষাতের পর বেশকিছু দিন কেটে গেল। কোন খবর আসছে না। গুলবাহার শোভার মাকে খবর পাঠালেন বাসায় আসার জন্য। সে আসছে না অনেকদিন। অবশেষে শোভার মা শুকনো মুখ করে আসলেন। গুলবাহার জানতে চাইলেন, পাত্রপক্ষের মেয়ে পছন্দ হয়েছে কিনা? শোভার মা বেদনার্ত কন্ঠে যা জানালেন, তার সারমর্ম হচ্ছে- পাত্রের (ছেলের) ছোট বোন মীরাকে পছন্দ হয়েছে। নীরাকে পছন্দ করেনি ছেলের বড় বোন। বড় মেয়ের বয়স নাকি বেশি। এমন কথা শুনে গুলবাহারের তো মাথায় হাত। বলে কী? বড় বোন দেখতে এসে ছোট বোনকে পছন্দ! এটা কী কথা!

আর বয়স বেশি মানে। মাত্র তার মেয়েটা ইন্টারে পড়ছে! মেয়েটা শুনলে কতো কষ্ট পাবে। কতভাবে বুঝিয়ে মেয়েকে পাঠিয়েছেন পাত্র পক্ষের সঙ্গে দেখা করার জন্য। মেয়েটা তার লাজুক হলেও সোজাসাপ্টা কথা বলে। বেশ সহজ সরল।
ঘটক ফটকে কেন জেনো অনীহা নীরা’র। এতো ঘটা করে দেখাদেখি তার মোটেও ভালো লাগে না। মায়ের এতো আগ্রহ দেখে না করতে পারেনি। বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের মান রেখেছে।

গুলবাহার ভাবছেন এটা কী হলো! শোভার মা দেখার আগে বেশ আশ্বস্ত করেছিলেন। পাত্রের বড় বোন পাত্রের লোকাল গার্জিয়ান। নীরাদের পরিবারের নাম-ডাক শুনে বেশ আগ্রহী ছিলেন। তার ছোট ভাইয়ের সম্বন্ধ এখানেই করাবেন।
শোভার মা’র কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন গুলবাহার। বড় মেয়ে রেখে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিবেন। কীভাবে? মেয়েটা তার কতো যত্ন করে সেজেগুজে গেছে পাত্র দেখতে।

যাবার আগে মেয়ের মুখটা বেশ ভালো করে দেখছিলেন গুলবাহার। বাহ! মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে। কতো মায়াবী লাগছে দেখতে। মনে হচ্ছিলো, বাড়তি একটা সৌন্দর্য ঝিলিক খেলে যাচ্ছিলো মেয়েটার চেহারায়।
মা তো মা। মায়েরা সব বুঝেন। মেয়ে সরাসরি কিছু না বললেও হাবেভাবে বুঝেছেন। পাত্রকে ভালোই পছন্দ হয়েছে নীরার।

দেখা হবার পথ থেকে নিজের সৌন্দর্যের প্রতি বাড়তি যত্ন নিতে দেখে গুলবাহার মুখ লুকিয়ে হাসতেন।
সেই মেয়েটাকে এখন কীভাবে জানাবেন, তাকে পাত্র পছন্দ করেনি। করেছে তার ছোট বোনকে!
গুলবাহারের এখন নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কেন যে তিনি মীরাকে সঙ্গে দিয়েছিলেন! মনটা তখন থেকেই খচখচ করছিলো। কোন ভুল করেননি তো! আদতে তাই হলো। এমন ভুলের মাশুল দিতে হবে বেচারি মেয়েটাকে। মনটাই ভেঙ্গে যাবে। নীরা’র মন জানে মা গুলবাহার। মেয়েটা বড্ড অভিমানী। অল্পতেই চোখের জল-নাকের জল এক করে ছাড়ে। এই মেয়েকে কীভাবে সামলাবেন তিনি!

ঘটনা (২)
রোজি ও রাফিয়া দুই বন্ধু। একই পাড়ায় বসবাস। একই স্কুলের সহপাঠী তারা। স্কুল পেরিয়ে এখন একই কলেজে পড়ছে। মলির পাশের বসায় এক সুদর্শন পুরুষ বসবাস করেন। ঠিক মেস বলা যায় না। তিন ভাই মিলে একটি ছোট একতলা বাড়িতে ভাড়া থাকছেন। রোজিরা বসবাস করে তিনতলা বাসায় দ্বিতীয় তলায়। বাসার বারান্দায় দাঁড়ালেই সেই চমৎকার সুদর্শন পুরুষটিকে (জুয়েল) দেখতে পায় পাশের একতলা বাসায় খোলা বারান্দায়। এভাবেই চোখে চোখে দেখা। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে রোজি ও জুয়েলের হৃদয়ের স্পন্দন। ছোট, ছোট চিরকুটে লেখা চিঠি ছুঁড়ে চলে প্রেমের বাক্যলাপ। দুজনের মনের আকুতি। একদিন সামনা সামনি দেখা হবে। কথা হবে। কিন্তু কোথায় দেখা হবে? রোজি দূরে কোথাও যেতে নারাজ। পরিবারের মান-সম্মানের ভয়। কখন কে দেখে ফেলে। তাই বন্ধু রাফিয়াকে জানালো মনের কথা।
দু’বন্ধু মিলে এক ফন্দি করে। রাফিয়া তার নিজ বাসায় জানালো তার বন্ধু রোজির বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। সামনের কয়েকমাস পরেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। এই মুহূর্তে রোজির বাড়িতে পাত্রের যাওয়াটা শোভন দেখায় না। তাই রাফিয়ার বাড়িতে এক নজর দেখার জন্য আসছেন।
বন্ধুর উপকার হবে। হবে দুই মনের মিলন।

এমনটা ভেবে রাফিয়া এই মিথ্যাটুকু বলতে সাহস পায়। কিন্তু কে জানতো বন্ধু’র প্রেমিক প্রথমবার দেখা করতে এসেই তার দিকে কুনজর দিবে! হাবেভাবে জানাবে রাফিয়াকে পছন্দ তার। গুণকীর্তন করতে শুরু করবে রাফিয়ার। মুগ্ধ নয়নে রাফিয়াকে দেখবে। বন্ধু’র সামনেই প্রশংসার ফুলঝুরি ফুটিয়ে জুয়েল বলছে- ‘তুমি অনেক স্মাট, তোমার সাথে আগে দেখা হলেই ভাল হতো’।
রাফিয়া আড়চোখে বান্ধু রোজির দিকে তাকায়। বেচারির মুখ অন্ধকার।
রাফিয়ার বুঝতে বাকি থাকে না। দেখতে সুদর্শন হলেও জুয়েল আসলে একজন লোভী প্রেমিক। আর যাই হোক, যে প্রেমিক এতোদিনের পরিচয়ের পর, প্রথম দেখা করতে এসেই বান্ধবীকে পছন্দ করে ফেলে, সে লোক আর যাই হোক, ভাল মনের মানুষ নয়। সুন্দর মনের নয়।
বন্ধু’র মনে যে কষ্ট। ব্যথা। রাফিয়া অনুভব করতে পারছে। তাই এই অপ্রীতিকর কথাবার্তা আড়াল করতে রাফিয়া সরে যায় সামনে থেকে।

ঘটনা (৩)
মিথিলা ও শ্রাবণের পরিচয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। প্রায়ই তারা ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করেন। দুজনের কেউ বিয়ে করেননি। কথা হয় জীবন, দর্শন, সাহিত্য ও নানা বিষয় নিয়ে। শ্রাবণের খুব আগ্রহ মিথিলার সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্কে জড়াবেন। কার কেমন পাত্র-পাত্রী পছন্দ শেয়ার করেন। নানাভাবে সেকথা মিথিলাকে বোঝালোর চেষ্টা করছেন। মিথিলা সবই বুঝে। কিন্তু এড়িয়ে যায়। শ্রাবণ বিয়ে করার জন্য তাড়া দেয়। বলে- ‘সময় নষ্ট করছো কেনো? বিয়ে করো’।
মিথিলাও বলে, আপনি করছেন না কেনো? আপনার জন্য পাত্রী দেখছি’।
দুজনের হৃদ্যতা বাড়ে। মিথিলা বুঝে, সে রাজি হলেই শ্রাবণ তাকে বিয়ে করতে দেরি করবে না।
মিথিলা একদিন ফেসবুকে তার সহকর্মীদের সঙ্গে তোলা একটি ছবি পোস্ট দিলো। সে ছবিতে চারজনের তিনজন নারী ও একজন পুরুষ। যথারীতি লাইক দেন শ্রাবণ। অল্প সময় পর মিথিলাকে ইনবক্সে নক দেয়। জানতে চায়- ছবিতে ডান পাশের মেয়েটা কে?
মিথিলাও মজা করে বলে- কেন? পছন্দ হয়েছে?
শ্রাবণ সাথে সাথে প্রতি উত্তর দেয়, হ্যাঁ, পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা দেখতে খুব মিষ্টি।
মিথিলার মনটাই খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপ নিয়েই ফিরতি প্রশ্ন করে,’তাকে কি বলবো?’
শ্রাবণ বলে, ‘আবার জিগায়! জানিয়ে দাও তাকে’।

বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায় মিথিলায় মন। বুকের ভেতরে একটা কষ্ট অনুভব করে। যে মানুষটা এতোদিন তাকে নানাভাবে প্রপোজ করছে, ভাললাগার কথা বোঝাচ্ছে নানাভাবে, সেই কিনা, একটি ছবি দেখে, তার সহকর্মীকে জানাতে বলছে, ভাল লাগার কথা! যদি বুঝতো, মিথিলার সামনে তার যে একটা ভাল ও সৎ মানুষের ছবি ভেসে উঠেছিল, এই এক কথায়, মনের দেয়াল থেকে ছবির ফ্রেমটি খুলে পড়ে চুরমার হয়ে যায়।

পুরুষ বোঝে না নারীর মন, পুরুষ বোঝে না নারীর মনের ক্রন্দন!
পুরুষ মানুষের মন বোঝা দায়। কাকে রেখে কার সঙ্গে সম্পর্ক করবে তা তারা নিজেই হয়তো ঠিক করতে পারে না। দোদুল্যমান মন। কাছের মানুষকে রেখে দূরে হাত বাড়ায়। মনের হিসাব বুঝে না। কষ্ট বুঝে না। ভাব বুঝে না।
কোন মায়ের কষ্ট বুঝতে পারে না। আর বুঝতে পারে না বলেই বিয়ের পাত্রী দেখতে এসে পাত্রীর ছোট বোনকে পছন্দ করে ফেলেন।
প্রেমিক তার প্রেমিকার মনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন না। পারেননা বলেই প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে এসে প্রেমিকার বান্ধবীকে প্রপোজ করে বসেন।
যার সঙ্গে জীবনের নানা দিক নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা শেয়ার হচ্ছে, হৃদয়ের ব্যকুলতা জানাচ্ছেন।
তার সহকর্মীর ছবি দেখে তাকেই জানাতে বলেছেন, তার ভাললাগার কথা!

পুরুষ হছে বহুরূপী। ক্ষণে ক্ষণে রুপ পাল্টায়। মন পাল্টায়। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেন। দ্বিধাগ্রস্ত। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেন। পরের জিনিসের প্রতি লোভটা বেশিই থাকে তাদের।

লেখক:
মাকসুদা লিসা
সিনিয়র সাংবাদিক
সাবেক খেলোয়াড়, সদস্য (ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি)

শেয়ার করুন: