ত্রিকালের প্রেমিক ও নারীগণ

ফারজানা শারমীন সুরভি:

রাণী যুগ.
“সম্মানিত রাজার পুত্র এবং রাজাগণ,
দয়া করে বারতাখানি শুনেন দিয়া মন।
রাজার কন্যা চন্দ্রাবতী,
রূপ যেন তার লক্ষ শশী।
কথন আমার নয়তো অতি,
এই কন্যা বিবাহে হয় যাহার মতি
আশা রাখি হবে সে বীর পুরুষ অতি,
স্বয়ংবর সভা হৈল পূর্ণ চাঁদের তিথি”।

বিষ্ণুপুরের রাজা কৃষ্ণকান্তের মতো বীর আশেপাশের দশ রাজ্যে দুর্লভ।তাই জয়মুকুট যে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে, এ ব্যাপারে প্রজা ও রাজা কিংবা রাজকন্যা কারোর-ই সন্দেহের অবকাশ ছিল না।যদিও তাঁর আরো দুই-তিনটা রাণী ছিল, তাও নতুন রাণী সংগ্রহে তাঁর কখনো অরুচি নেই।আমাদের গল্পের রাজার বয়স কম হয়নি এবং তিনি মরলে রাণী চন্দ্রাবতীকে আট-দশজন মুশকো জোয়ান শক্ত করে রাজার লাশের সাথে বেঁধে দেবে।পায়ে আমপাতা ছোঁয়াবে। ধুপ-ধুনো জ্বলবে। ঢাকিরা জোরে জোরে বাদ্য বাজাবে। আগুন চুমু খেতে খেতে একসময় কয়লা বানিয়ে দেবে চন্দ্রাবতীর এই সব ‘লক্ষ শশী’ রূপ।

তারপরও স্বয়ংবর সভায় রাজকন্যা চন্দ্রাবতী রাজা কৃষ্ণকান্তের গলায় মালা দিলো। তারা আগুনের চারপাশে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সাত জন্ম থাকার মহা প্রতিজ্ঞা করে ফেললো। সব আচার-আচরণ শেষে তারা রওনা হলো বিষ্ণুপুরের দিকে। যথানিয়মে উলুধ্বনি আর ঢাকের বাদ্যে নতুন রাণীর প্রাসাদ প্রবেশ। রাণীকে একলা ঘরে রেখে অন্দরমহলের নারীরা চলে গেলো।

আমাদের গল্পের রাণীর ধারণা ছিল, সে সুন্দরী বটে!তাকে নিয়ে কবিয়ালরা গান বাঁধে, ছবিয়ালরা ছবি আঁকে। রাজার ঝলমলে শোবার ঘরে বসে কুমারী চন্দ্রাবতী প্রতিক্ষায় ছিলো-সুন্দরের সমাগমের। প্রতিক্ষায় ছিলো-অরণ্য, আকাশ, সমুদ্র এবং রংধনুর।

যথাসময়ে অন্দরমহল থেকে রানী অবগত হলো, রাজা আজ আর প্রাসাদে আসবেন না। অন্যান্য রাতের মতো মহান রাজার আজকের রাতও কাটছে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত জলসা ঘরে। নর্তকী লালাবাঈয়ের সাথে মত্ততায়। ক্রোধে অস্থির রাণী একটা একটা করে ছুঁড়ে ফেললো গা ভরতি গহনা। ছুরি দিয়ে কেটে ফালিফালি করলো মখমলের চাদর।
লালাবাঈ!

থু করে একদলা থুতু রাণী শ্বেতপাথরের মেঝেতে ফেললো। আমাদের গল্পের রাণীর ধারণা ছিল, সে সুন্দরী বটে! অরণ্য, আকাশ, সমুদ্র, রংধনু -সবকিছু বাতাসে মিলায়। প্রাসাদের পেটে গড়াগড়ি খায় রাণী চন্দ্রাবতীর হরিণী চোখ, বরফি কাটা চিবুক, কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট, সূর্যমুখি স্তন, স্বর্ণখণ্ডের মতো নাভি ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভালোবাসার ফর্দে তাতে কখনো কম বেশি হয় না।

দাসী যুগ.
করিমুন্নেসা খানমের ধারণা ছিল, সে সুন্দরী বটে! চাঁপাফুলের মতো গায়ের রঙ, পটলচেরা চোখ, কোমর পার হয়ে হাঁটুতে গড়াগড়ি খাওয়া মেঘের মতো চুল ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য করিমুন্নেসা খানমের চৌদ্দ বছরের জীবনটা কেটেছে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে রাখতেই। জাহান্নামের আগুনের ভয় এমনি সাংঘাতিক! এমনকি আত্মীয়ারা বাড়িতে এলেও দৌড়াদৌড়ি করে পর্দা রক্ষা করতে হতো। যেনো বাঘ-ভাল্লুক ঢুকে পড়েছে বাড়িতে! কোরান শরীফ ছাড়া আর কিছু তাকে পড়তে দেয়া হয়নি কখনো।

তো যা হয় আর কী!মোহাম্মদ আবু সাবেরের সাথে একদিন করিমুন্নেসা খানমের বিয়ে হয়ে গেলো। তিনটা ‘কবুল’ করিমুন্নেসার ‘মালিক’ বানিয়ে দিলো মোহাম্মদ আবু সাবের নামক এক দাঁড়ি গোঁফওয়ালা মধ্যবয়সী লোককে। আম্মাজান পইপই করে বুঝালেন, “পরপুরুষ যেনো কখনো মুখ না দেখে করিমুন্নেসার। স্বামী যেমনই হোক, স্বামীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করতে হবে। স্বামীর প্রতি কটুক্তি করলে জিহবা হবে সত্তর গজ লম্বা! মেয়েমানুষের মুখে থাকবে তালা। উঠতে লাথি, বসতে লাথি। মুখে টুঁ শব্দ নাই। না হয় সংসারে টিকতে পারবি না।”

আমাদের গল্পের নায়িকা তাই সারাদিন দাসী বান্দীর মতো সংসার নামক সঙের বাজারে মুখ-কান বুজে তুর্কি নাচন দেয়।আর রাত দশটা নাগাদ গিয়ে ঠ্যাং ফাঁক করে ভারি মশারির মধ্যে শুয়ে অপেক্ষা করে। এক বিবমিষা জাগানিয়া অপেক্ষা। বাইরে পিলসুজের উপর টিম টিম করে প্রদীপ জ্বলতো। কাছেই থাকতো লম্বা একটা কঞ্চি। ‘মালিক’ রাত দশটার পরে আসতেন। শোবার ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে গিয়ে সেই কঞ্চি দিয়ে প্রদীপ নেভাতেন প্রথমেই। হাতড়ে হাতড়ে প্রথমে কিছুক্ষণ খামচাতেন বালিকাকে। তারপরে প্রবল বেগে ভয়ার্ত বালিকার মধ্যে প্রবেশ করে দপ্ করে ফুরিয়ে যেতেন।

করিমুন্নেসা খানমের ধারণা ছিল, সে সুন্দরী বটে! চাঁপাফুলের মত গায়ের রঙ, পটলচেরা চোখ, কোমর পার হয়ে হাঁটুতে গড়াগড়ি খাওয়া মেঘের মতো চুল ইত্যাদি ইত্যাদি অন্ধকারের পেটে গড়াগড়ি খেত।
ভালোবাসার ফর্দে তাতে কখনও কম বেশি হয় না।

নারী যুগ.
“উমম……উমম……আহ……”
“তোমার ভালো লাগছে, বাবু?”
“হুম”
“ভালো লাগছে এই আদরটা? এই আদরটার কথাই বলছিলাম তোমাকে। নতুন আদর।”
একটু থেমে অল্প অল্প হাঁপাতে থাকে নাফিস। হাঁপানোরই কথা! আর কতো! তিন দিন হলো কক্সবাজারে। হানিমুনে।সমুদ্রের মুখই দেখেনি এখনো।

এইসব শীৎকার অবশ্য নতুন নয়। দিতা আর নাফিস প্রেম করেছে চার বছর। তখনো নিয়মিত ভালোবাসার আঙ্গুল ধরে শরীর চলে আসতো। কিন্তু গত তিন দিন দাপুটে ঝড়। কনডমের হিসাব নেই। স্তুপাকারে জমছে ঘরের কোণে। দিতা এখন হুঁশে নেই। আদরে ঢুলুঢুলু। না হয় এই কনডমের পাহাড় নিয়েও একটা দারুণ কবিতা লিখে ফেলতো!

মারুফা ইসলাম দিতা লেখে। পত্রিকার জন্য গল্প, কবিতা, ফিচার। কখনো বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট। কখনো স্লোগান। রকমারি পণ্যের জিঙ্গেল। ফটাফট নামিয়ে ফেলে নাটকের চিত্রনাট্য। সবকিছুই লিখতে পারে দিতা। পেশায় আন্তর্জাতিক এনজিও-এর জেন্ডার, জাস্টিস এন্ড ডাইভারসিটি ডিভিশনের সিনিয়র সেক্টর স্পেশালিস্ট। নেশায় লেখক। অবশ্য দিতার বুক-কোমর-নিতম্বের মাপে ইন্টারেস্ট থাকলেও বউয়ের লেখালেখির ব্যাপারে নাফিস বোর ফিল করে।

নাফিস সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। দালানের মাপ ঝোঁককেই তার বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক মনে হয়। বই-টই পড়া তার কাছে সময় নষ্ট। আর দিতার গল্প-কবিতা তো খটর মটর। দিতা মাঝে মধ্যে নতুন লেখা-টেখা শোনাতে চাইলে বিরক্ত লাগে নাফিসের। অমন রসের মেয়েটা এরকম আঁতলামি করলে মানায়! কে বোঝাবে দিতাকে! হুঁ! নো ডাউট, নাফিস দিতাকে ভালোবাসে। এইটার মধ্যে কোন কনফিউশন নাই। কিন্তু কোন শালার ভাল্লাগে বউয়ের মুখে ইনটেলেকচুয়াল মার্কা কথাবার্তা! বউ থাকবে বউয়ের মতো। কিন্তু দিতা এটা বুঝলে তো! আবার বেশি কিছু বলাও যায় না।

ফোঁস করে উঠে। নারীবাদ-সমাজতন্ত্র-নাস্তিকতা মুখস্থ সব। যদিও মেয়েটা বেসিকালি ভালো, নাফিস জানে। নাফিসের প্রতি ভালোবাসাও হান্ড্রেড পারসেন্ট। কিছুটা বোকা। প্র্যাকটিকাল দুনিয়া সম্পর্কে আইডিয়া কম। এই যে নাফিস মাসে কয়েকবার বুজ পার্টি করে। দিতা হ্যাস নো আইডিয়া! এমনই বেকুব। যদিও নাফিস মদ-গাঁজা-সিগারেটে অভ্যস্ত, কিন্তু এডিক্টেড না। এইগুলা আজকাল সবাই খায়। দিতাকে এইটা কে বোঝাবে? তার আবার শুচিবায়ুর শেষ নেই। মদ-সিগারেট নো নো। অন্য মেয়েদের দিকে তাকালে চোখ গেলে দিবো-ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলি অবশ্য ভালোই লাগে নাফিসের। যতোই লিখুক আর টো টো করুক, দিতার মোরাল খুবই ফাইন। আরে! বউদের মোরাল ফাইন থাকাটা খুবই জরুরি। দিতাকে সে ভালোবাসে। বিয়ে করেছে। আর কী চাই দিতার?

দিতার ধারণা ছিলো, সে ভাগ্যবতী। ভালোবাসার রঙ্গিন পাখি তার হাতের তালুতে বসে গান গায় প্রতি ভোরে। ধ্যুত্! এতো সহজ সব কিছু! এখানে লাল নীল ফিতাওয়ালা আধুনিকতা নামের মোড়ক দেখে নারী ভাবে, “পিঠে আমার মস্ত ডানা!” প্রেমিকের অন্তরে সেই আদিম পুরুষ, জানতে পারে না ভালোবাসার মায়ায় সম্মোহিত নারী। পুরুষালি দখলদারিত্ব এখন সোনালি মুখোশ পরিহিত প্রেমিক রাজপুত্র। ব্যবহৃত কনডমের নিচে গড়াগড়ি খায় একজন কবি, তার জাদুর আঙ্গুল, কল্পনার জাহাজ, মননের দিঘী ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভালোবাসার ফর্দে তাতে কখনো কম বেশি হয় না।

পরিশিষ্ট
বহুদিন পূর্বে এক অন্ধ ত্রিকালদর্শী আমার সামনে এসে অচল মুদ্রা রেখে অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী করেছিল, “অসুখী হবি এবং অসুখী করবি তুই!”
প্রেম নামের এক আজব ডুগডুগি আছে না? তার তালে তালে নাচার সৌভাগ্য কি আর সবার হয়? ত্রিকালের নারীগণও পায়নি আজব ডুগডুগির সন্ধান।

শেয়ার করুন: