শাহপরী দ্বীপের ‘পরী’দের নিয়তি-১

ফাহমি ইলা:

‘তোমরা আসছো অনেক দূর থেকে। তারপরেও তোমরা আমাদের বন্ধু। কারণ তোমরাও নারী’—সানোয়ারা বেগম (ছদ্মনাম)।

বাংলাদেশের মানচিত্রের সর্ব দক্ষিণের শেষবিন্দুটির দিকে যদি কেউ চোখ রাখেন সেখানে একটি নাম পাবেন- শাহপরীর দ্বীপ। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় সাবরাং ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড এটি। এই ওয়ার্ডের ছোট্ট একটি পাড়ায় যাবার সুযোগ হয়েছিলো গতকাল; প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য না, গিয়েছিলাম অফিশিয়াল কাজে।

অনেকের মতে, সম্রাট শাহ সুজার ‘শাহ’ আর তাঁর স্ত্রী পরীবানুর ‘পরী’ মিলিয়ে নামকরণ হয়েছিল এই দ্বীপের- শাহপরী। অথচ পুরো রাস্তায় কোন ‘পরী’ চোখে পড়লো না, দোকান-পাট ক্ষেতে সর্বত্র শুধু ‘শাহ’দের ছড়াছড়ি, ‘পরী’রা স্থান পেয়েছে অন্দরে! গাড়ির ভেতরে দু’একজন নারী যদিবা চোখে পড়েছে, তবে তারা বোধহয় বেরিয়েছেন কোন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। রাস্তার অবস্থা এতোই ভয়াবহ যে গাড়ি রেখে লোকাল সিএনজিতে প্রায় তিন কিলোমিটার যেতে হয়। রাস্তা ভেঙ্গে চৌচির, কয়েক জায়গায় দুটো সিএনজি যাবার জায়গাও নেই, প্রচণ্ড এবড়োথেবড়ো এবং ঝুঁকিপূর্ণ। যেতে যেতে ভাবছিলাম এ পথেই প্রতিদিন কত মানুষেরই যাতায়াত করতে হয়! কিন্তু তখনো জানি না এ পথেই অনেকের মৃত্যুও লেখা আছে! প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপিপাসুদের কান পর্যন্ত হয়তো সে মৃত্যুর আর্তনাদ পৌছায় না।

ছোট একটি কুঁড়েঘর, চারপাশে বিখ্যাত একটি বিদেশি এনজিওর লোগো লাগানো প্লাষ্টিক দিয়ে দেয়াল তৈরি করে ঘরটিকে আড়াল করবার চেষ্টা। ঘরের ভেতরে মাদুর পাতা, তাতে পনের ষোলজন বিভিন্ন বয়সী নারী বসা, প্রায় প্রত্যেকের কোলে ছোটশিশু। একটা ‘উইম্যান সেশন’ চলবে আগামী দেড়ঘন্টা। ভেতরে গিয়ে বসতেই নিজেরা কথা বলতে শুরু করলেন, হাসাহাসি চলছে। সাথে বিদেশী থাকবার কারনে তারা বেশ মজা পাচ্ছিলেন। সারাবছর বিভিন্নভাবে যুদ্ধ করা এই মানুষগুলোর এন্টারটেইনমেন্ট এটুকুই হয়তো। ওদের কথা বুঝি কিন্তু বলবার অভ্যাস নেই বলে চুপচাপ শুনছিলাম। এখানে প্রায় শতভাগ নারী কোন না কোন নির্যাতনের শিকার। শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন কিংবা আর্থিক নির্যাতনের ক্যাটাগরি তাদের জানা নেই কিন্তু তাদের মুখের কথায় উঠে আসে সব এক এক করে।

** এখানে পেশা বলতে মাছ ধরা, সেই মাছ বাছা, লবনের মাঠে কাজ করা, গবাদীপশু পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসা। নারীরা কেউ কেউ মাছ বাছার কাজ করেন দিনচুক্তিতে ২০০ টাকায়। কিন্তু বেশিরভাগ নারীর সাথে অর্থের কোন সম্পৃক্ততা নেই। পুরুষেরা কাজ করে টাকা আনেন, বাজার করেন; তারা ঘরের কাজ করেন, সন্তান লালনপালন করেন। এদের চাহিদা বলতে পেটের ভাত, শরীরের কাপড়, ঘুমানোর জায়গা আর স্বামীর পরিচয়।

** এখানে মাদকব্যবসা তুঙ্গে। পুরুষেরা মাদক সেবন করে ঘরে ফিরে স্ত্রীদের যেকোন কারcB পেটায়- এটা একটি নিত্য এবং স্বাভাবিক ঘটনা। বইয়ের ভাষায় ‘ম্যারিটাল রেইপ’ শব্দটা এদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, অভিজ্ঞতাটি নয়! প্রতিনিয়ত স্বামীর শারীরিক ইচ্ছে পূরণ করাকে এরা মনে করেন ‘দায়িত্ব’। অথচ এরা অসুস্থ হতে পারেন না, ইচ্ছে অনিচ্ছে অনেক পরের ব্যাপার! কখনো স্বামীর কথামতো না চললে শারীরিক নির্যাতন চলে, কিংবা স্বামী হয়তো দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে বৌ নিয়ে হাজির হয়। একজন নারী বললেন-‘কে চায় এত ঝামেলার। তার চেয়ে যা বলে তাই করা ভালো’।

** প্রতিটি ঘরেই শিশুর সংখ্যা নিম্নে ৪/৫, ঊর্ধ্বে ১৪/১৫। একজন নারী জানালেন তার সন্তান আটজন। সাতজন মেয়ের পরে একটি ছেলে হয়েছে বলে স্বামী ক্ষান্ত দিয়েছে, প্রতিটির বয়সের ফারাক একবছর করে। তথাকথিত চিন্তাধারায় যা হয়- একেকটি ছেলেসন্তান একেকটি আর্নিং সোর্স; একেকটি মেয়েসন্তান একেকটি বার্ডেন, টাকা খরচের ডিপো, অন্যের ঘরে গিয়ে সন্তান উৎপাদনের সোর্স! পরপর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন একজন নারীর বোন। অত্যন্ত ক্ষুব্ধ স্বরে তিনি জানান-‘আমার বোন খুবই অসুস্থ ছিলো, রোগা হয়ে যাচ্ছিলো। বাচ্চাগুলো দুধ পর্যন্ত পাচ্ছিলো না। তারপরেও যখন বাচ্চা হলো, মারা গেলো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারিনি।‘

** বাল্যবিয়ে এখানে শতভাগের কাছাকাছি। মেয়ের বয়স তের কী চৌদ্দ হলেই তারা বিয়ে দিয়ে দেন। কেননা ‘বয়ঃসন্ধি পার হওয়া মেয়েটি যেকোন সময় কোন দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে’ এ ভয়ে তাদের দিন কাটাতে হয়। তাছাড়া মেয়ের বয়স যত কম, ভালো বিয়ে হবার সম্ভাবনাও নাকি তত বেশি থাকে। কখনো কখনো তারা ‘তিন স্ত্রী বর্তমান থাকা বিবাহিত পুরুষ’টির কাছেও মেয়ের বিয়ে দেন, কেননা সেখানে তার মেয়ের ভাতকাপড়ের যোগান হবে, নিরাপদ থাকবে।

** এলাকায় একটিও হাসপাতাল নেই। এ কথা শুনে প্রথম যে চিন্তা মাথা এলো- তাহলে অসুস্থ হলে কিংবা জরুরী মুহুর্তে যেমন গর্ভবতী নারীদের কী অবস্থা হয়? উত্তরে জানা গেলো প্রায় তের কিলোমিটার দূরে টেকনাফে নিয়ে যেতে হয়। যে এবড়োথেবড়ো পথে এলাম এই পথে! এবং যেসব নারীদের সন্তান জন্মের সময় হাসপাতালে নিতে হয় তাদের অনেকেই পথেই মারা যান, প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে গর্ভপাত হয় কিংবা সন্তান বাঁচলেও মাকে বাঁচানো যায় না।

** এলাকায় সরকারি স্কুল আছে একটি। তবে অধিকাংশ শিশু স্কুলে যায় না। পড়াশোনা আসলে ঠিক কী কাজে আসবে তারা বুঝতে পারেন না! বয়স হলে ছেলেটা মাছ ধরতে যাবে, ক্ষেতখামার করবে, ব্যবসা করবে আর মেয়েটার বিয়ে হবে, বাচ্চা হবে, ঘরসংসার করবে, ‘এর জন্য আবার শিক্ষার কী দরকার?’ এখানে প্রায় পনের-বিশ বছর ধরে বাস করা রোহিঙ্গা পিতামাতার শিশুটির স্কুলে ভর্তির কোন অধিকার আদৌ নেই।

আর কদিন পর শুরু হবে বর্ষাকাল। বন্যার পানি এদের ঘরের মেঝে পর্যন্ত চলে আসবে। উঁচু মাচা করে তাতে দিন পার করতে হবে তাদের। নৌকা ব্যতিত যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা থাকবে না তখন। ক’বছর আগেও এখানে কোন সাইক্লোন সেন্টারও ছিলো না। বর্তমান সাইক্লোন সেন্টারটির ধারণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ৬০০, জনসংখ্যা তার দশগুণ। বাকিরা এসময়ে টেকনাফ চলে যাবেন হয়তো।

ওপরের তথ্যগুলো তাদের মুখ থেকে পাওয়া। এদের মুখ থেকে শোনা আরেকটি বাক্য হলো- ‘এটাই আমাদের নিয়তি।‘ মানুষ যেকোন কিছু সইতে সইতে যখন অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং তার সামনে আর কোন সমাধান থাকে না তখন সেটা হয় ‘নিয়তি’! অথচ নিয়তির দোহাই দিয়ে তারা দিনের পর দিন সহ্য করে যাচ্ছেন সর্বোচ্চ কষ্ট।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত নিত্য দুর্যোগের সাথে লড়াই করতে করতে এদের পিতৃতান্ত্রিক দুর্যোগের মত মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সাথেও লড়তে হয় প্রতিটা দিন। এদের স্বপ্ন এখন ভাতকাপড় আর মাথা গোঁজার ঠাইয়ে এসে ঠেকেছে। ব্যাসিক নিড বলতে বাকি যে দুটো পদ আছে মানে শিক্ষা আর চিকিৎসা, সে পদ এখন তাদের কাছে বিলাসিতা। নারীরা বইয়ের ভাষায় সর্বোচ্চ ‘ভালনারেবল’ অবস্থায় বসবাস করছেন। অথচ এরাই একটা দুটো ‘উইম্যান সেশন’র পর আজ বুঝতে পারছেন শারীরিক নির্যাতন কোনভাবেই তাদের নিয়তি না, বাল্যবিবাহ ঠিক কতটা খারাপ একটা কন্যাশিশুর জন্য, বহুবিবাহের ফলে ঠিক কি কি অশান্তি তৈরি হচ্ছে, নারীদের কি কি করার আছে, তারা কিভাবে এক হতে পারেন সমস্যার মোকাবিলা করতে পারেন।

সম্প্রতি একজন নারী তার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন শারীরিক নির্যাতনের। এলাকার কম্যুনিটি লিডারদের মধ্যস্ততায় মিমাংসা হলেও তার স্বামী আবারও পূর্বের অবস্থায় ফেরত গেছে। একহাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে নারীটি বলছিলেন- ‘যখন মারে তখন হুঁশ থাকে না। হুঁশ থাকবে কিভাবে? নেশা করে আসে আর আমার আর আমার বাচ্চার গায়ে হাত তোলে। মাঝেমাঝে বাচ্চার সামনেই শারীরিক সম্পর্ক শুরু করতে চায়। বাঁধা দিলে আবার মার শুরু করে।‘

এর সমাধান কী? সাধারণত সমাধান আসে শিক্ষিত সাহায্যকারীর মাথা থেকে। টেকসই সমাধানের কথা চিন্তা করে নারীদের বলা হলো- যেহেতু আপনারা জানেন আপনাদের কি অবস্থায় দিন কাটাতে হয়, আপনারা এও জানেন কি কি খারাপ আর কি কি ভালো। তাহলে আপনারাই সমাধান দিন। ঠিক কি করলে আপনারা ভালো থাকতে পারবেন, সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবেন?’ তারা নির্বিকার তাকিয়ে থাকেন। সমাধান হতে পারে এটাও যেনো তাদের কাছে অবাস্তব! অবশ্য তারা চান পুরুষদের সাথেও বসে তাদের সাথে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করা হোক, এলাকায় একটি হাসপাতাল হোক, কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক তাহলে বাল্যবিয়ে বন্ধ হবে এবং আরো অনেক কিছু। কিন্তু তারা সমাধান খুঁজে পান না। দীর্ঘদিন অন্ধকারে থাকতে থাকতে যেনো বোধশূন্য অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

লিখতে লিখতে অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। কোনভাবে গোছাতে পারছি না। ওদের এতো চরম অগোছালো দুঃসহ জীবনের গল্প কীভাবে গুছিয়ে লেখা সম্ভব জানি না। ঘরের দাওয়ায় বসে থাকা নারীটির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি ওখানে কোন স্বপ্ন নেই, কোন আশা নেই। তার নির্বিকার চাহনি বুকে শেলের মতো বিঁধছিল, ওখানে কোন ব্যথাও নেই। আর বারবার মনে পড়ছিল একজনের কথা-‘তোমরা আসছো অনেক দূর থেকে। তারপরেও তোমরা আমাদের বন্ধু। কারণ তোমরাও নারী’।

এতো দুঃসহ জীবন যাপন না করলেও পৃথিবীর কোথাও না কোথাও এমন নারী পাওয়া যাবে, যে কিনা প্রতিনিয়ত পিতৃতন্ত্রের ছোবলে আহত হয়, ব্যথায় নীল হয়, সয়ে সয়ে ‘নিয়তি’কে মেনে নেয়। হয়তো কোনদিন ফের জন্মানোর সুযোগ পেলে এরা কখনো নারী হয়ে জন্মাতে চাইবে না। এক জীবনের দুঃসহ কষ্ট স্মৃতির পুনরাবৃত্তি কে বা চায়!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.