কামরুন নাহার:
দৈনন্দিন জীবনে বন্ধু, সহকর্মী, প্রতিবেশী বা আত্মীয় হিসেবে আমাদের যাদের সাথে ওঠাবসা, চলাফেরা, তারা সবাই যে একই রকম তা নয়। এদের মধ্যে কিছু মানুষের আচরণ স্বাভাবিক, আবার কিছু মানুষের আচরণ অস্বাভাবিক। ঠিক আট- দশজনের মতো স্বাভাবিক নয় আচরণগুলো (অটিজম নয় কিন্তু)। যেমন প্রয়োজনীয় কথাটুকুও মুখ ফুটে না বলা, কারো সাথে মিথস্ক্রিয়ায় না এসে একা একা নিজের মতো থাকা, হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি, অযথাই অন্যের পেছনে লাগা, এই করে ফেলেছি, এই করে ফেলবো; একে ধরে ফেলবো, তাকে মেরে ফেলবো টাইপ আচরণ করা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভাব নিয়ে চলা, অন্যের খুঁত ধরা এই বিষয়গুলো আমাদের পরিচিত জনদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই। আমাদের পরিচিত বৃত্তে কমবেশি এরা আছেই।
শিশু থেকে শুরু করে পরিণত সব বয়সীদের মধ্যেই এই আচরণ দেখা যায়। কিন্তু কেনো? এই কেনোর উত্তরের জন্য আপনার বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দরকার নেই, কোনো গবেষণা বা বিস্তারিত পড়াশোনারও দরকার নেই। যদি আপনি খুব ভালোভাবে আপনার, আমার জীবনযাপন পদ্ধতি খেয়াল করে থাকেন তাহলেই এই কেনোর উত্তর পাবেন।
ছোটবেলায় এবং বড় বেলায়ও নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন কোন সন্তানহীন দম্পতির মধ্যে বনিবনা না হলে মানে সংসারে যদি সুখ বিরাজ না করে, স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি বিমুখ থাকেন, তাহলে দেখবেন মুরুব্বীরা একটা কথা বলেন, আর তা হলো, ‘সন্তান নাও সব ঠিক হয়ে যাবে’। এই একটা বাক্য ‘সন্তান নাও সব ঠিক হয়ে যাবে’ যে আরও কতো অসংখ্য ভুল, বেঠিক আর অসুখের কারণ, সেটা যারা ওই অবস্থায় সন্তান নিয়েছেন তারাই জানেন। এসব ক্ষেত্রে যে সন্তানটা জন্ম নেয় সে জন্ম নেয় অনাকাঙ্ক্ষিত (উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কাঙ্ক্ষিত), ভালোবাসাহীন একজন হিসেবে শুধু দুটো মানুষের মধ্যে একটা সেতু হিসেবে কাজ করার জন্য। অর্থাৎ তার জন্মটা হিসেব কষে প্রয়োজনে দেয়া হয়, খুব ভালবেসে দেয়া হয় তা নয়। না, ভালোবাসা থাকে না, সেটা বলছি না, কিন্তু প্রয়োজনটা বেশি থাকে।
এই সন্তানের দিকে তাকিয়ে অধিকাংশ দম্পতি একসাথে একই ছাদের নিচে থাকেন ঠিকই, কিন্তু সেটা ভালোবাসাহীন বেঁচে থাকা। মায়ের সমস্ত ধ্যান জ্ঞ্যান যেমন ওই সন্তান, বাবারও তাই থাকে। যে দাম্পত্য ঠিক হবার জন্য এই সন্তান, সেই দাম্পত্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর ঠিক হয় না। আপাত দৃষ্টিতে এসব দম্পতিকে দেখলে খুব সুখী দম্পতি মনে হবে, কারণ বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে এরা অনেক ধরনের ভান করেন, মানিয়ে চলেন। দাম্পত্যকে ঠিক করার জন্য এই একটি সন্তান জন্মদান আরও হাজারটা সমস্যার সৃষ্টি করে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই দম্পতিদের মধ্যে সম্পর্কের সেই টানাপোড়েনটা থেকেই যায়। বাচ্চার জন্মের পর এরা একজন হয়ে যান অমুকের মা, আর একজন অমুকের বাবা। কিন্তু এরা দুজন দুজনার হয়ে ওঠতে পারেন না। একজন সন্তানের মা হলে আর একজন সন্তানের বাবা হোন, কেউ কারো মনের মানুষ হয়ে বা প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারেন না। আর এই প্রিয়জন হয়ে না উঠতে পারাটা বাচ্চাটার ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে তোলে। তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাঁটি কখনও কখনও হাতাহাতি বাচ্চাটার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার এই টানাপোড়েনে বাচ্চাটাও অবহেলার শিকার হয়। তার শারীরিক-মানসিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত হয়। এই বাচ্চাগুলোই স্কুলে গিয়ে অন্য শিশুদের সাথে সহজে মিশতে ব্যর্থ হয়, কথা বলে না, একটু একা থাকতে পছন্দ করে, খুব সহজভাবে সবকিছুকে নিতেও পারে না, অল্পতে ভয় পায়। এদের স্কুলিংটা ভালো হলে কিছুটা সমস্যা ওরা কাটিয়ে উঠতে পারে।
আর একটা বড় সমস্যা হয়, আর তা হলো, সন্তান নেবার পর অনেকের সম্পর্ক ঠিক তো হয়ই না, বরং তারা সেপারেশন বা ডিভোর্সে চলে যান। সেটা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর সেই বাচ্চাটির জন্য। আমরা শুনেই থাকি যে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানরা সঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। এটা অনেকাংশেই সত্যি।
এই ধরনের বাচ্চাগুলো মা-বাবা উভয়ের ভালোবাসা এবং যত্নের অভাবে, সংসারে নানান ঝামেলার মধ্য দিয়ে বড় হয় এবং একই সাথে সঠিক আচরণ থেকে শুরু করে বস্তুগত অনেক কিছুর অভাবই এদের জীবনে দেখা দেয় যা পরবর্তীতে তাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে (সব বাচ্চারাই এমনভাবে বড় হয় তা বলছি না)। এই বাচ্চাগুলো বড় হয়ে ভয়াবহ রকম ‘স্যাডিস্ট’ হয়, নয়তো খুব ঠাণ্ডা মাথার, কম কথা বলা মানুষ হয় এবং এদের দ্বারা এমনসব অপরাধ সংগঠিত হয় যা অনেকের ভাবনারও বাইরে।
একটি অস্বাভাবিক পরিবেশে, অসুখী পরিবারে বেড়ে ওঠা একটা সন্তান (কোনো ধরনের মিরাকল ছাড়া) বার্ধক্যে গিয়েও অস্বাভাবিক আচরণই করবে সেটাই স্বাভাবিক (অনেকে শুধরে নিতে পারে নিজেকে)। কিন্তু এমনটা হওয়ার হাত থেকে আমরাই তাকে বাঁচাতে পারি। টানাপোড়েনের সম্পর্কে একটা সন্তান জন্মদান মানে তিনটি জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা এবং সেইসাথে আত্মীয় স্বজনকেও অশান্তির মধ্যে ফেলা।
এখন অনেকে বলবেন ডিভোর্স/সেপারেশন তো বাচ্চা জন্মের অনেক বছর পরও হয়, বা যে কোনো সময় হতে পারে – নিশ্চয়ই পারে। সেই ব্যাপারটাতে আমাদের অনেক সময় হাত থাকে না, কিন্তু অসুখী দাম্পত্যকে সুখী করার প্রয়াসে সন্তান জন্মদানের ব্যাপারটা কিন্তু আমাদের হাতে –যেটা চাইলেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।