বিপন্ন ‘বিষমকামিতা’

তামান্না ঝুমু:

লুলু মাস্টার্স শেষ করলো। চাকরি-বাকরি খুঁজছে। পলাশ নামে একটা ছেলের সাথে ভাব আছে ওর। ওরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লুলুর মা দুইজন, মানে ওর মায়েরা সমকামী কাপল। মায়েদের একজন স্পার্ম ব্যাংক থেকে স্পার্ম নিয়ে লুলুকে গর্ভে ধারণ করেছে। ওর মায়েরা একজনও ওর এই প্রেমের সম্পর্ক ও বিয়ের সিদ্ধান্তে খুশি না। এ-ব্যাপারে তাদের চরম আপত্তি।

লুলু সেদিন মায়েদের জোর গলায় জানিয়ে দিয়েছে, বিয়ে করতে হলে পলাশকেই করবো, ওকে ভালোবাসি আমি। মায়েরা দুজনই তাদের গলায় দ্বিগুণ জোর দিয়ে বলে, তুই একটা ছেলেকে বিয়ে করবি বললেই হলো? আমরা সমকামী, আর তুই আমাদেরই মেয়ে হয়ে হবি বিষমকামী, তা আমরা মেনে নেবো? সমাজ কী বলবে? রাষ্ট্র কী বলবে? ধর্ম কী বলবে? আমাদের মানসম্মান কিছু কি আর থাকবে? আমরা সবার কাছে কী জবাব দেবো? তোকে জন্ম দিলাম, এত খরচ আর এত কষ্ট করে লালনপালন করলাম, লেখাপড়া শেখালাম, তা কি বিষমকামী হবার জন্য? আমাদের নাক কাটানোর জন্য?
লুলু বলে, সমকামিতা বিষমকামিতা যার যার ব্যাপার। সবার যৌনাভ্যাস এক হবে নাকি? এই যে তোমরা সমকামী তাতে তো আমার কোনো সমস্যা নেই! আমি তো তাকে মানহানিকর মনে করি না। এ নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগি না। তোমাদেরকে বিষমকামী হয়ে যাবার জন্য চাপ দিই না। তবে তোমরা কেন এমন করছ আমার সাথে? আমার বিষমকামিতা কেন তোমাদের সমস্যা, তোমাদের সমকামিতা যদি আমার সমস্যা না হয়?

এবার মায়েরা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। হায় হায়, সাক্ষাত শত্রু পেটে ধরেছিলাম এতো কষ্ট করে। শত্রু পালন করেছি এতো খরচ করে।

লুলু বলে, ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখো মায়েরা, সমকামিতা যেমন কোনো অপরাধ নয়, তেমনি বিষমকামিতাও কোনো অপরাধ নয়। এক মা উঠে মারমুখি হয়ে বলে, ভাবাভাবি নাই, আরেকবার যদি কোনো ছেলেকে বিয়ে করার কথা মনে মনেও ভেবে থাকিস তো তোর দাঁত উপড়ায়ে ফেলবো, বেয়াদব নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার!

আরেক মা লাফ দিয়ে বলে, দাঁত অবশ্যই উপড়ানো হবে তোর। প্লাসটা কই গেলো, প্লাস প্লাস! সে মনোযোগ দিয়ে প্লাস খুঁজতে থাকে। অন্য মা কাঁচি নিয়ে আসে। বলে, আজ তোর চুল সব কেটে দেবো। আমাদের নাক কাটানোর পাঁয়তারা করেছিস তো কোনো ছেলেকে বিয়ে করে? তার আগে তোর চুল ছেঁটে দিচ্ছি। এ-বলে সে লুলুর লম্বা লম্বা চুলগুলি ক্যাচ ক্যাচ করে কাটতে শুরু করে। লুলু হাতাহাতি করে। মাকে নিবৃত্ত করতে চায় ওর চুল কাটা থেকে। কত শখের চুল ওর! অন্য মা এসে লুলুর হাত দুটি ধরে রাখে শক্ত করে। লুলু আর পেরে ওঠে না। মায়েরা দুজনে মিলে ওর দীঘল কালো চুলগুলি ছেঁটে দেয়। লুলু হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।

এ মায়েরা কত আদরযত্নেই না মানুষ করেছে লুলুকে। কতো আদরে ওর চুল আঁচড়ে দিয়েছে দুজনে। আজ শুধু ওর বিষমকামিতার জন্যই ওর সাথে এমন বাজে ব্যবহার করছে! ও যেন ওর মায়েদেরকে চিনতে পারে না। এরা পুরো অন্যমানুষ হয়ে গেছে আজ ওর কাছে। লুলু রাতে কিছু না খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। মায়েরা ওকে সাধে না। লুলু ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ও মায়েরা ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে মাঝেমাঝে। আজ যে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেল কেঁদে কেঁদে, কেউ ওর খোঁজ পর্যন্ত নিলো না।

মায়েরাও খেলো না রাতে। দুঃখে অপমানে ওদের বুক ফেটে যেতে চায়। এতো যত্ন আর কষ্ট করে লুলুকে ওরা পেলেছে। সেই মেয়ে আজ দিচ্ছে এই প্রতিদান! সমকামী মায়েদের মেয়ে হবে বিষমকামী! এ কী মেনে নেবার কথা? ছি ছি ছি! একটা মেয়ে কীভাবে একটা ছেলের সাথে যৌনতায় লিপ্ত হবে? ছি! ভাবলেই তো ঘেন্নায় গা গুলিয়ে আসে। একটা মেয়ে যৌন সম্পর্ক করতে পারে শুধুই একটা মেয়ের সাথে, কোনো ছেলের সাথে কিছুতেই নয়। তেমনি একটা ছেলেও যৌন সম্পর্ক করতে পারে, বিয়ে করতে পারে একটা ছেলেকে, কোনো মেয়েকে নয়। এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম, সমাজের নিয়ম, রাষ্ট্রের নিয়ম!

পরদিন সকালে লুলুকে ওরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে জোর করে। পথে পথে লুলু অনেক চেষ্টা করেছে পালিয়ে যেতে। পারেনি। দুজন দুপাশ থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে ওকে গাড়িতে। লুলু বলছে, আমার তো কোনো অসুখ করেনি, আমাকে ডাক্তারের কাছে কেন নিয়ে যাচ্ছো?

মায়েরা বলছে, তুই মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছিস, তাই তো মেয়ে হয়ে কোনো ছেলেকে বিয়ে করার মতো জঘন্য চিন্তা করতে পারছিস। তোর চিকিৎসা দরকার। লুলু বলে, তোমরা অসুস্থ, আমি নই। বিষমকামিতা কোনো অসুখ নয়, যেমন সমকামিতা নয়। তোমরা দুজনেই সমকামী, সমকামী সঙ্গী বেছে নিয়েছো। তোমাদেরকে যদি জোর করে কোনো ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হতো, তোমরা কি সুখি হতে তাতে? তোমরা কি পারতে নিজের মন ও শরীরের পছন্দের বিরুদ্ধে কোনো বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সাথে মিলিত হতে? তাতে তোমাদের যৌনজীবন কি সুস্থ হতো? সুখের হতো? তোমাদের জীবন কি সুখের হতো?

মায়েরা এবার গাড়িতেই দুইপাশ থেকে লুলুকে চড়চাপড় ও কিলঘুষি মারতে আরম্ভ করে। বেয়াদব অসভ্য মেয়ে কোথাকার! আমাদের মানসম্মান ধূলিসাৎ করবি? লুলুকে মেরে কাহিল করে ফেলে মায়েরা। কাহিল অবস্থায় লুলুকে নিয়ে ঢোকে ওরা ডাক্তার আলেয়া বানুর অফিসে।

আলেয়া বানু বিষমকামিতা দমনের উপর উচ্চডিগ্রী লাভ করেছে। ভিজিটিং কার্ডে তার নাম লেখা আছে, ডাক্তার আলেয়া বানু বিদ, মানে বিষমকামিতা দমক। মায়েরা ডাক্তারের কাছে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করে বললো, আমাদেরকে বাঁচান, ডাক্তার। ডাক্তার বললো, এটা তো কোনো ব্যাপারই না আমার জন্য! তুড়ি মেরে বললো, এরকম কত হাজার পাগল আমি এভাবেই সুস্থ করে দিয়েছি। ওকে কিছু থেরাপি দিতে হবে শারীরিক ও মানসিক। তাতেই ঠিক হয়ে যাবে। পাগলামি পালাবার পথ পাবে না। সমকামীদের সন্তানেরা হবে সমকামী, এটাই সমাজের নিয়ম। লুলু বলে, সমাজের নিয়মগুলি কে বানিয়েছে? বানিয়েছে সমাজের গুটিকয় ক্ষমতাধর সমাজপতি ওদের পছন্দানুযায়ী। নিয়ম বানানোর সময় ওরা সবাইকে জিজ্ঞেস করেনি, মতামত নেয়নি সবার। একজনের পছন্দ জোর করে সবাই উপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়, অগণতান্ত্রিক।

ডাক্তার বলে মাথায় হাত দিয়ে, এ-মেয়ের অবস্থা তো বেজায় খারাপ! এর চিকিৎসা একটু যত্ন নিয়ে করতে হবে। শুরু হয় লুলুর চিকিৎসা। ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয় ওর শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, মানসিক শকও দেওয়া হয় নানাভাবে। মাসের পর মাস চলতে থাকে এরকম। লুলু প্রথম প্রথম বলে ডাক্তারকে, আমার প্রেম-ভালোবাসা আমার যৌন-জীবন আমার পছন্দমতো হবে। আপনি তাতে নাক গলানোর কে? আপনার যৌনজীবনে তো আমি নাক গলাইনি!

ডাক্তার বলে, বুঝেছি, তোমার চিকিৎসা আরো ভালোভাবে করতে হবে। শকের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হয় লুলুর। লুলু নির্জীব হয়ে যায়। তার আর কথা বলার অবস্থা থাকে না। যে যা বলে তাতেই লুলু কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে আস্তে মাথা কাত করে ফেলে। ডাক্তার আলেয়া বানু বিদ লুলুর মায়েদের বললো, লুলু একেবারেই সুস্থ হয়ে গেছে এখন। দেখেছেন, কেমন শান্তশিষ্ট ভাল মেয়ে হয়ে গেছে ও! মায়েরা দেখলো, আসলেই তো, ঘটনা তো সত্যি। কী বেয়াদব মেয়ে কেমন ভদ্র, ভালো হয়ে গেছে।

ডাক্তার আলেয়ার মেয়ে নিনির সাথে লুলুর বিয়ে ঠিক হলো। নিনিরও একই রকম অবস্থা ছিল। একটা ছেলের প্রেমে পড়েছিল না বুঝে। পরে ওর মা-ই চিকিৎসা করে সেই বিষমকামিতার ভূত-ভিবিষ্যৎ সব তাড়িয়ে দিয়েছে সফলতার সাথে। নিনিও এখন শুধু ভালো মেয়ের মতো একটুখানি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মাথা কাত করে দেয় কিছু জিজ্ঞেস করলে। বিয়ের কথা ওদের মায়েরা ওদেরকে জানালো। ওরা দুজনেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মাথা কাত করে দিলো। এই তো রাজি আমাদের লক্ষ্মী মেয়েরা বিয়েতে! অনেক ধুমধাম করে ওদের বিয়ে হলো। এলাকায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল এই মায়েদের। সবাই তো প্রশংসায় পঞ্চাশমুখ। বিপথগামী ছেলেমেয়েদের এভাবেই তো শায়েস্তা করতে হয়, এরাই তো প্রকৃত অভিভাবক! লুলু আর নিনি এখন পরস্পরের জীবনসঙ্গী। পরস্পরের দিকে ওরা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তারপর মাথা কাত করে দেয়। কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই ওদের।

ওদিকে লুলুর প্রাক্তন প্রেমিক পলাশেরও একই অবস্থা। ওর বাবারাও সমকামী কাপল। পলাশ ওদের দত্তক ছেলে। না বুঝে কু রিপুর বশবর্তী হয়ে একটু বিষমকামী মনোভাব জেগে উঠেছিল আর কী অবুঝ যুবক মনে! বাসায় দুই বাবা মিলে ভালোভাবে পিটিয়ে এবং থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে ভালোভাবে থেরাপি দিয়ে এক্কেবারে সোজা করে ফেলেছে তাকে। ঠিকঠাক করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে পূবপাড়ার কুদ্দুসের সাথে। কুদ্দুসের মাথায়ও একসময় বিষমকামিতার ভূত চেপেছিল। তাও না বুঝে আর কী! ওর সমকামী মায়েরাও ওর জন্য একই ব্যবস্থা নিয়ে ভালো করে ফেলেছে ওকে। পলাশ আর কুদ্দুসও খুব সুখে শান্তিতে সংসার করছে এখন। কোনো ঝগড়াবিবাদ নাই, শুধু ফ্যালফ্যাল আর মাথা কাত। কোনো সমস্যা নাই। এবার তো ওরা দুজনে মিলে তাবলীগে গেছে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.