সন্তান, সংসার ও মাতৃত্বের রকমফের

জহুরা আকসা:

কেস স্টাডি-এক: রিতা ও মিতা দুই বান্ধবী । দুইজনই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে চাকরি করছিলেন। কিন্তু মা হওয়ার পরে রিতা চাকরি চালিয়ে যেতে পারলেও মিতা আর পারেননি। রিতার বাবা-মার বাড়ি ও চাকরি স্থল একই শহরে হওয়ায় গর্ভধারণ ও পরবর্তী সময়ে তাকে তেমন কষ্ট পেতে হয়নি। খাবার-দাবার, সেবা যত্নসহ অন্যান্য ব্যাপারে সর্বদা তিনি পারিবারিক সহযোগিতা পেয়েছেন। মা হওয়ার পরেও তিনি সন্তানকে নিরাপদে তার মায়ের বাড়িতে রেখে কাজে যেতে পারেন। যেদিন খুব তাড়া থাকে, সেদিন বাড়ির সহকারি মেয়েটি ঘরের যাবতীয় কাজ শেষে তাদের সন্তানকে তার নানীর বাড়ি রেখে আসেন।

অন্যদিকে মিতার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বেশ প্রতিকূল। মা-বাবা , শ্বশুর বাড়ির লোকেরা সবাই তার কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে, মানে অন্য শহরে। কেউ যে তার বাড়িতে এসে তাকে সহযোগিতা করবে, এমন অবস্থাও নেই। গর্ভধারণ ও পরবর্তী সময়ে তাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া-চিকিৎসা কোনো কিছুই ঠিকমতো করতে পারেননি। তার সেবা যত্ন করারও কেউ ছিল না। মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে তিনি আর চাকরিতে যোগদান করতে পারেননি। ছোট সন্তানের নিরাপত্তা, সেবাযত্ন সবকিছু মাথায় রেখে তিনি এতো ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন। মিতা মনে মনে ভাবেন, তার সন্তানটা একটু বড় হলে তিনি আবার চাকরি শুরু করবেন, যদি তখন তিনি কোনো চাকরি পান তো ! কারণ একবার চাকরি ছাড়লে আবার ভালো চাকরি পাওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা কই?

এইসব কিছু মেনে নিয়ে মিতা সুখি হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রিতা তাকে সুযোগ পেলেই ইনিয়ে বিনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, “রিতা একজন সফল কর্মজীবী নারী, সে মাতৃত্বের ভার বহন করেই চাকরি করতে পারেন, তিনি অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন বলেই সবদিক সামলাতে পেরেছেন, যা অন্য কেউ (মানে মিতা) পারে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি”। মিতা মুখের উপর রিতাকে কিছু না বললেও মনে মনে ভাবেন, “যদি তারও রিতার মতো ধারের কাছে মা-বাবা, ভাই-বোন কিংবা একটা বিশ্বস্ত কাজের মানুষ থাকতো, তাহলে তিনিও চাকরি চালিয়ে যেতে পারতেন। অথচ রিতার ক্যারিয়ার ধরে রাখার পিছনে অন্যদের অবদান কখনোই সে স্বীকার করতে চায় না।

কেস স্টাডি-দুই: আমেনা ও রাবেয়া দুইজন প্রতিবেশী। আমেনার স্বামীর আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। তার বাসায় দুইটা কাজের লোক আছে। একজন তার ছোট সন্তানটিকে দেখাশোনার কাজে তাকে সাহায্য করে, অন্যজন ঘরের কাজে। আমেনাকে রাত জেগে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতেও হয় না। তার বাচ্চাকে ফিডারে অভ্যস্ত করেছেন। ঠিক সময় মতো ঘুম- খাওয়া সবাই করতে পারেন তিনি। এছাড়াও তিনি নিয়মিতভাবে পার্লার যান। কাজের লোকের সহযোগিতায় আমেনা ঘরের কাজ, সন্তান লালন-পালন করেও বেশ সুন্দর আর ফিটফাট থাকতে পারেন। সন্তানকে বুকের দুধ না দেওয়ায় তার তেমন ওজন বাড়েনি, ফিগারও ঠিক আছে।

অন্যদিকে রাবেয়ার স্বামী যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে তিনি কোনো মতে একটা কাজের লোক রেখেছেন , তাও ছুটা বুয়া ! ঘরের কাজ , বাজার করা , সন্তানের দেখাশোনা এসব তিনি একাই করেন । এতশত কাজ করে তিনি নিজের যত্ন নেওয়া দূরে কথা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া ঘুম কিছুই করতে পারেন না । বাড়তি খরোচ আর সন্তানের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সন্তানকে তিনি প্যাকেট দুধ খাওয়াননি । তার সন্তান পুরো দেড়-দুই বছর তার বুকের দুধই খেয়েছে ।এর ফলে তার শরীররে একটু মেদ হয়েছে , বুকগুলি আগের মতো নেই । নিয়মিত পার্লার যাওয়া হয় না তার।

রাবেয়া এসব কিছু তেমন একটা চিন্তা করেন না, কিন্তু প্রায়ই আমেনা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন যে, “ সন্তান লালন-পালন এবং ঘরের কাজ করেও তিনি (আমেনা) নিজেকে ঠিক ধরে রেখেছেন! তিনি আরও বলেন যে, তিনি অনেক সচেতন নারী, বিয়ে করে নিজেকে তিনি বিলিয়ে দেননি, ইত্যাদি … ইত্যাদি। এসব কথা শুনে রাবেয়ার খুব বলতে ইচ্ছে করে যে, “অমন দুটো কাজের লোক থাকলে আর স্বামীর টাকায় নিয়মিত পার্লারে গেলে তিনিও ফিটফাট থাকতে পারতেন। এসবের মধ্যে সচেতনতার কিছু নেই। টাকা থাকলে অনেকেই এসব মেনে চলতে পারেন।

কেস স্টাডি-তিন: সালমা ও জোবেদা দুইজন গার্মেন্টস কর্মী। একই বস্তিতে থাকেন। সালমার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এ নিয়ে বস্তিতে অনেক কথা হয়। সুযোগ পেলে তাকে সবাই বোঝায় যে, তার কোনো যোগ্যতা নেই বলেই তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে।

অন্যদিকে জোবেদার স্বামী তার সাথেই থাকে, কিন্তু তাকে নিয়মিত মারধর করে। জোবেদা যখন কাজে যায়, তার স্বামী তাদের সন্তানকে দেখাশোনা করে না। এসব কারণে জোবেদা তাদের সন্তানকে গ্রামে তার মায়ের কাছে রেখে এসেছেন। সন্তানের জন্য তার খুব কষ্ট লাগে। সন্তানকে তিনি বুকের দুধ দিতে পারেন না, এই নিয়ে তার খুব অপরাধবোধ হয়। তিনি খুব চান নিজের সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে। কিন্তু মদখোর স্বামীর জন্য বাড়ির কাউকে আসতেও বলতে পারেন না। জোবেদা কখনও কখনও নাইট ডিউটি করেন। ওভার টাইমের টাকাসহ জোবেদার আয় বেশ ভালো! কিন্তু তাতে কী? তার মদখোর স্বামী সব টাকা মদের পিছনে খরচ করে ফেলে। তবুও সেই স্বামী তার কাছে ভালো, মানুষের তো কোনো কথা শুনতে হয় না!

সালমার অবশ্য এই সব ঝামেলা নেই, সে তার পাশের ঘরের এক বুড়ির কাছে তার ছোট বাচ্চাটিকে রেখে কাজে যান। নিয়ম করে সকালে আর রাতে বুকের দুধ খাওয়ান। অন্য সময় তাকে ভাতের মাড় খাওয়ানো হয়। মাঝে-মধ্যে তার বাচ্চাটি অসুস্থ থাকে, বুড়ি তো আর ঠিকমতো যত্ন নিতে পারেন না। কিন্তু সালমা কাজ না করলে খাবে কী? এই চিন্তায় কাজে যেতেই হয় তাকে। তিনি কখনও নাইট ডিউটি, ওভার টাইম কিছুই করেন না। সন্তান যেদিন খুবই অসুস্থ থাকে, সেদিন সুপারভাইজারকে অনেক অনুরোধ করে ছুটি নেন, যদিও ঐ দিনের পয়সা কেটে রাখে, কিন্তু তাতে কী! চাকরিটা তো বাঁচে!

তাকে ও তার সন্তানকে ফেলে যাওয়া প্রতারক স্বামীর উপরে সালমার কোনো রাগ হয় না। বরং তার কাছ থেকে বৈধ সন্তান পেয়ে তিনি বড্ড খুশি। সারাদিন কাজ শেষে যখন তিনি ঘরে এসে সন্তানের মুখটা দেখেন, যখন তিনি সন্তানকে বুকে নিয়ে রাতে ঘুমান, তখন তার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। বস্তির সস্তা ঘরে শুয়েও দূরের আকাশ, বাইরের ঝড় … কখনো সকালের রোদ দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগে। সন্তানের মুখ দেখে দেখে নিজেকে তিনি ভীষণ সুখী মানুষ বলেই মনে করেন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.