আমাদের সেইসব দিনগুলি …

লুতফুন নাহার লতা:

এই ছবিতে আমরা যারা, তারা সবাই ক্যাম্পাসের কবিতা গল্পের মানুষ। লেখালেখি করে মাল্য ভূষিত হয়েছিলাম মনে হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যখন ছিলাম, সময়টা তখন এমনই ছিল যে ক্লাসের শেষে চাইলেই আমরা কবিতা পাঠের আসর জমিয়ে বসতাম। শহীদুল্লাহ কলাভবন বা মমতাজ উদ্দিন কলাভবনের অথবা বাণিজ্য ভবনের সামনের খোলা মাঠে হতো আমাদের আবৃত্তি কর্মশালা, গল্প, নাটক, কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। নিজের লেখা থেকে পাঠ করার পর তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা সমালোচনা চলতো, আর সেইসব আনন্দঘন আড্ডায় চা সিঙাড়া খাওয়া আর আলাপচারিতা ছিল অনিবার্য।

সবাই ছিলাম যেন একমায়ের সন্তান। মতিহারের। ভাইবোনের মতো ছিলাম আমরা। ছেলেরা আমাদের সকল কাজে মমতা নিয়ে এগিয়ে আসতো। বই দিয়ে নোট দিয়ে সাহায্য করত আমাদের, আবার আমরাও ওদের নোট লিখে দিয়ে ওদেরকে বই দিয়ে ক্লাসের পড়ার লিস্ট দিয়ে সাহায্য করেছি সানন্দে। কোনদিন মনে হয়নি বাড়ি ছেড়ে, ভাইবোন মা বাবা ছেড়ে আমরা এখানে এসেছি পড়তে, কিন্তু আমাদের কেউ নেই। আমাদের ভাইয়েরা সকল সময় আমাদের বড় শক্তি হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। সিনিয়র ক্লাসের ছাত্ররাও স্নেহ করতেন আর ছোটরা শ্রদ্ধা।


আমাদের মেয়েদের হল থেকে বাসস্ট্যান্ড ছিল একটু দূরে। আমরা যেতাম শহরে ছোটখাটো কেনাকাটা করতে বাসে করে, যখন শহর থেকে ফিরতাম মাঝে মাঝেই বাস দেরি করে ফেলতো, তখন দেখতাম আড্ডা শেষে আমাদের বন্ধুরা হলে ফিরছে, ওরা কিন্তু ঘরে না ফিরে আমাদেরকে আমাদের হলের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতো। মমতা আর শ্রদ্ধায় মেশা ছিল আমাদের সম্পর্কগুলো।

আমাদেরকে কেউ কোনদিন মন্দ বলেনি। মেয়েরা বা ছেলেদের কাউকে অশালীন পোষাক পরতে দেখিনি। শাড়ি, শালোয়ার কামিজ বা কেউ কেউ জিন্স, প্যান্ট সার্ট পরত। ছেলেরা প্যান্ট শার্ট, জিন্স, ফতুয়া, পাঞ্জাবি পাজামা এসব পরতো, কিন্তু হিজাব বা বোরকা পরতে দেখিনি কাউকে কোনদিন, অথচ প্রতিটি হলে অনেক মেয়েই নামাজ পড়তো, শবেবরাত বা শবেকদরের রাতে আমরা সারা রাত নামাজ পড়তাম প্রতিযোগিতা করে, কে কত রাকাত নামাজ পড়তে পারি, রোজার সময় কেউ যদি পড়াশোনার জন্যে হলে থাকতো তো তাদের বেশীর ভাগই রোজা রাখতো। তখন সবাই মিলে একসাথে বসে ইফতার করতাম, কে কোন ধর্মের তা নিয়ে ভাবিনি, আমাদের একটাই পরিচয় ছিল আমরা সতীর্থ বন্ধু। তখন বিপার বা মুঠোফোন ছিল না, রোজার সময় সেহরি খাবার জন্যে ঘুম ভেঙে উঠতাম, দূরে ছেলেদের হলের ওরা ডিং ডিং ডিং ডিং করে থালা বাটি বাজাত, সেই শব্দে। পরদিন সেই নিয়ে হাসাহাসি করে আমতলাগুলো গরম করে তুলতাম আমরা।

সকল ধর্মের, সকল এলাকার ছেলেমেয়েরা আমরা একসাথে পড়তাম, কোনদিন কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ কেউ করেছে বলেও দেখিনি। মানুষ হিসেবে আমাদের সবার প্রতি ছিল সবার অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। একে অপরের সুখে দুখে আমরা কেঁদেছি হেসেছি। অনার্স ফাইনালের সময় আমাদের বন্ধু ইয়াসমিন গুল, যাকে আমরা যুঁই বলে ডাকতাম যে আমার স্কুল জীবন থেকে নিকট বন্ধু ছিল, একসাথে স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ি দিতে চেয়েছিলাম, কিডনির সমস্যায় অসুস্থ হয়ে সে যখন আর পরীক্ষা শেষ করতে পারলো না, চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় চলে গেল, তখন ওর এই ক্ষতির জন্যে চোখের জল ফেলেনি আমাদের মধ্যে এমন কেউ বোধ হয় ছিল না। মায়া আর মমতার বন্ধনে বাঁধা ছিলাম আমরা সেকথা লেখা আছে মতিহারের বেগুনি জারুলের পাতায় পাতায়।

হলের মেয়েরা কিন্তু রাজনীতির সাথেও যুক্ত থেকেছে। জাসদ, বাসদ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ইত্যাদি, তবে সেটা তাদের নিজের ইচ্ছেয় তারা যুক্ত থেকেছে। তারা মিছিল মিটিংও কম করেনি, কিন্তু কেউ তাদের জোর করেছে বলে শুনিনি। আমাদের হলে ছিল দুই নেত্রী। আকবরি আকতার নাগমা আপা আর ডেইজি আপা। দেখা হলে হাসি বিনিময় ছাড়া তারা কোনদিন আমাদেরকে কিছু বলেছে বলেও মনে পড়ে না।

একবার নাগমা আপা আমার রুমে এসে প্রচুর কবিতা ও গল্পের বই দেখে বলেছিলেন ‘তুমি বাংলায় পড়! আমি ভেবেছিলাম ম্যানেজমেন্ট! তা ক্লাসের বই টই পড়ো তো? ভাল ছাত্রী হলে কিন্তু দায়িত্বটাও বড়। খুব ভালো রেজাল্ট করা চাই তোমার!’

হলের ছাত্রীদের সাথে নেত্রীদের দুর্ব্যবহার তো দূরের কথা, মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে শুনতে পেতাম ডেইজি আপার খালি গলার গান। সে গান ভেসে আসছে মন্নুজান হলের এক্সটেনশন বিল্ডিং থেকে উত্তরের বাতাস বয়ে – ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই— মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই—‘ সেই গান নিশুতি রাতের কান্না হয়ে বুকের ভেতরটাতে হু হু করে উঠতো। আমার খুলনা, আমার রূপসা, আমার ফেলে আসা নিমফুল, বাড়ির আঙিনা ছেড়ে চোখের জলে ভেসে যেতো।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.