সোনিয়া জামান:
ধর্ষণ! ধর্ষণ! ধর্ষণ!!!
ধর্ষণের উল্লাস চলছে যেন দেশে!
প্রতিদিনই কোনও না কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ধর্ষণের খবর এখন নিত্য-নৈমিত্তিক একটা ঘটনা।
এতো ধর্ষণ মূলত কারা করছে? এই সমাজের পুরুষগণ। অবশ্য সব পুরুষ তো আর পুরুষ নয়, কিছু আছে মানুষ। নিজের কামপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারা মানুষগুলোই আজকাল পৌরুষত্ব ধারণ করছে বেশ! আর নারীকে তাই আজন্মকাল ধরে পৌরুষত্বের শিকার হতে হয়। সমাজে ধর্ষক বলতে সবসময় পুরুষকেই বোঝানো হয়ে থাকে। সবসময় ধর্ষণ কেন পুরুষরাই করে? তসলিমা নাসরিনের লেখা কবিতা “ঘুম ভাঙানিয়া” পড়েছি অসংখ্যবার। ধর্ষণে পুরুষদের মত্ততা দেখে তার কবিতার সেই উক্তিটাই মনে আসে বারবার- “ওরা তো মানুষ নয়, ওরা পুরুষ”।
আচ্ছা নারীরা কেন কখনও ধর্ষক হয় না? নারীরা ধর্ষন করতে অক্ষম বলে? নাকি নারীদের পৌরুষত্ব নাই বলে? অবশ্য নারীদের নারীত্ব আছে, যেটাকে সাধারণত মাতৃত্ব বলে মহিমান্বিত করা হয়ে থাকে। এই মাতৃত্বের টান প্রবল থাকার কারণেই হয়তো নারীর উপরে হওয়া সব অন্যায়-অপরাধ যুগ যুগ ধরে সয়ে যায়, এবং যদিওবা তার কাছে ক্ষমা চাওয়া হয় তবে নিমিষেই ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু তাতে কি ধর্ষণ থেমে থাকে? বরং পূর্ণ উদ্যমে আবারও পুরুষ তাকে ধর্ষণ করে যায়। ধর্ষণ করে বস্তা ভরে লাশ গুম করে দিয়ে নিজেকে পাপমুক্ত করতে চায়।
নারী নিজে এটা জানে না যে, অন্যায়ে চুপ করে থাকাটাও অন্যায়। নারী ধর্ষণ করতে চায় না, কিংবা করতে পারে না। কিন্তু কেন পারে না? ধর্ষণ করার মাঝে জাহির করবার মতো আদৌ কি কোনও কৃতিত্ব আছে? নারী ধর্ষণ না করতে পারুক, প্রতিবাদ তো করতে পারে। কিন্তু যে নারী প্রতিবাদ করার সুযোগই পায় না, তাকে কী বলবো?
চার বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে অসহায় বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে পৌরুষত্ব ধারণ করা ধ্বজাধারীদের কাছে। বখাটে, নেশাখোরদের হাতেই কেবল নয়, মসজিদের ঈমানদার মাওলানা ইমাম হুজুরদের থেকেও এই মেয়েজাত নিস্তার পাচ্ছে না। বাকি যাচ্ছে না নিজের পিতার কাছ থেকেও। যার ঔরসে জন্ম, তার হাতেই কিনা নারীকে ভোগ্য হতে হয়! ছিঃ বাপ ছিঃ! এই লজ্জা কার?
এই পুরুষদের স্বরূপ যদি এমন হয়, তবে পুরুষদের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধাবোধ ভালোবাসা কীভাবে আসবে? কীভাবে ভরসা আর আস্থায় নারী তার জীবনসঙ্গী নির্বাচন করবে? প্রেম-ভালোবাসা ওদের জন্য নয়। ওরা জানে না যে, কোনও নারীর মন ছুঁতে পারলে সে তার শরীর ছোঁয়ার অধিকার এমনিতেই দিয়ে দেয়। তাতে ধর্ষণ করবার আর দরকার পড়ে না, কিন্তু তারপরও যারা ধর্ষণ করে তারা লুইচ্চা, কামুক। লুইচ্চা কামুকদের মন নেই, প্রেম নেই। তারা ভালোবাসা চায় না, তাদের প্রেমিকারও দরকার হয় না। তারা চায় শুধু শুদ্ধ ভাষায় একটু অর্গাজম। আর এই অর্গাজমটুকু পেতেই তাদেরকে দেখা যায় বাচ্চা-বুড়া, মুরগী-ছাগল কিছুই বাদ রাখে না। নিজের কামপ্রবৃত্তিকে যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তাকে পুরুষ বলে, কিন্তু মানুষ বলা যায় না।
ধর্ষণের প্রতিবাদ করলে একদল আসে ফতোয়া নিয়ে, পোশাকের দোহাই তুলে তারা ধর্ষণটাকে বৈধ করবার প্রচেষ্টা চালায়। হাত মোজা, পা মোজা পরে থাকা পর্দানশীন বোরকা পরা মেয়ে কেন ধর্ষণের শিকার হয়? তাদের পর্দাও সহী নয় বলে? ইনিয়ে বিনিয়ে হাজারও অজুহাতে তবু ধর্ষণ করা চাই। তবে কেন এতো ফতোয়া? হয়তো ধর্ষণ করেও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। আর সে কারণেই দেখা যায় ধর্ষণ বিরোধী কর্মসূচিতে তাদের মুখে কুলুপ এটে নিষ্ক্রিয় অবস্থান। তারা ধর্ষণের প্রতিবাদে কোনও মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ আন্দোলন করতে পারে না ঠিকই, কিন্তু পোশাকের দোহাই তুলে ধর্ষণটাকে বৈধ করতে পারে।
তাদের যুক্তিতে আমার মনে হয় গরু, ঘোড়া, মুরগিও ধর্ষণের শিকার হয় শুধু সহি পর্দা করেনি বলে। নারীকে তারা তেঁতুল, তরমুজ মনে করে আর নিজেদেরকে মনে করে মাছি। কিন্তু পৌরুষত্ব ধারণকারী মাছিকুল এটা জানে না যে, মাছি শুধু তেঁতুল-তরমুজই খায় না। মাছির প্রধান খাবার হলো “গু”, যাকে ভদ্র ভাষায় বিষ্ঠা বলা হয়। তো এই বিষ্ঠাখোরদের ফতোয়ায় যখন দেখি সমাজের অনেক শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মানুষগণ গা ভাসায়, তখন নিজেকে ধর্ষিতা হতে দেয়া ছাড়া আর কী করার আছে!
আসো পুরুষ, ধর্ষণ করো আমায়। ব্লেড দিয়ে যৌনাঙ্গ কেটে কেটে আরেকটু বড় করে নাও যাতে তুমি তৃপ্তি পাও! আমি তো জানি তুমি তো মানুষ নও, তুমি তো পুরুষ!
৯০% মুসলমানের দেশে এতো ধর্ষণ করে কারা? যারা নিজেদের সংখ্যাগুরু বলে জাহির করে অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা দাবি করে, তারা ধর্ষণের দায়ভার তখন আর নিতে চায় না। আমি এই বিষয়ে বিশদ ব্যাখায় যাবো না। তবে আমি কোনও নাস্তিক-মুক্তমনা কিংবা মুক্ত চর্চাকারীদেরকে কখনও দেখিনি ধর্ষণ করতে, শুনিওনি। অথচ এদেরকেই কাফের-মুরতাদ বলে গালি দেওয়া হয়। সত্যিটা তুলে ধরলে নানা ধরনের হুমকি।
বাক স্বাধীনতা এখন সোনার হরিণ, চাইলেই মিলে না। পুরুষ নামের নোংরা কীটে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ, মানবতা আজ ভূ-লুন্ঠিত। তাইতো নারীর প্রতি সহিংস লোলুপতার ভয়াল বর্বর থাবা যেন থামছেই না।
ধর্ষণ যেরকম মহামারী আকার ধারণ করেছে, তাতে কঠিন শাস্তিই দেয়া দরকার। ধর্ষককে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলাকে আমি সমর্থন করি না। কারণ তাতে বাংলাদেশে ক্রসফায়ার সংস্কৃতি চালু হয়ে যাওয়ার পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে। আজ একজনকে মারা হয়েছে, কাল কোনও নির্দোষ ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে রেপিস্ট হিসেবে ক্রশফায়ারের মুখে পড়তে পারে। ক্রশফায়ারকে আইনের কোনও সুষ্ঠু প্রয়োগ বলে মনে করি না। তার চেয়ে বিচার ব্যবস্থা উন্নত হওয়াটা দরকার।
ধর্ষণ মামলা দ্রুত বিচার আইনে নিষ্পত্তি করতে হবে। ধর্ষণ প্রমাণে ফিঙ্গার টেস্টের মতো জঘন্য বর্বর পরীক্ষা বাতিল করে আধুনিক ফরেনসিক পরীক্ষা চালু করা হোক। ধর্ষণ করতে যারা উদ্বুদ্ধ করে, তাদেরকেও বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। ধর্ষককে কোনো অবস্থাতেই জামিন দেয়া যাবে না। কারণ আমাদের দেশে ধর্ষণ মামলার আসামী জামিনে ছাড়া পেয়ে ভিক্টিমের উপর পুনরায় অত্যাচার চালিয়েছে এরকম বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক মৃত্যুদণ্ড।
নারী সে যে নারীই নয়, সেও যে মানুষ। নারীর প্রতি যৌন বর্বরতার বিরুদ্ধে সবাই প্রতিবাদী হয়ে উঠুক, ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক সবাই। ধর্ষণের মতো বর্বরতাকে ঠেকাতে নারী পুরুষের বৈষম্যতার বেড়াজাল ভেঙে গুড়িয়ে সবাই মানুষ হয়ে উঠুক। মানবতা মুক্তি পাক।