শেখ তাসলিমা মুন:
একটি ঘটনা শেষ হতে না আরেকটি। মন বিবশ হয়ে এখন শরীর বিবশ। আট মাসের শিশুটিকে কেন এবং কোন মানসিকতায় থাকলে ধর্ষণ করার মানসিকতা জাগে?
আমাদের সমস্যার গোঁড়ায় পৌঁছুতে হবে।
কোথাও একটি বড় রকমের গড়বড় রয়েছে। নয়?
যৌন আকাঙ্খা কি কেবল পুরুষের? নারীর নেই? নারীর শরীর কি জ্বলে ওঠে না? ওঠে। কিন্তু কত পারসেন্ট নারী পুরুষকে আক্রমণ করে? কত পারসেন্ট নারী আট মাসের শিশু পুরুষের পুরুষাঙ্গে থাবা বসায়? বিষয়টি তবে কেবল যৌনতার বিষয় নয়।
বিষয়টি অপরাধ এবং বিচারহীনতার। বিচারহীনতার এ জঙ্গল কাদের দ্বারা পরিচালিত? কাদের সেবায় দেশের আইন নিবেদিত? কেন একটি ধর্ষণেরও বিচার হয় না? বিত্তবানের ছেলেরা বেঁচে যায়, আর ধর্ষণের শিকার নারী সকল দায় নিয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।
আর প্রান্তিক পর্যায়ে বিষয়টি কীভাবে মহামারীর মতো দেখা দিয়েছে?
সুবিধাবঞ্চিত, অশিক্ষিত মানুষগুলো কীভাবে এ অপরাধের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে গেছে? সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী, যৌনতা এবং নারীদেহ বিষয়ে তাদের কারা ধারণা দেয়? কারা তাদের অপরাধী করে গড়ে তুলেছে? ভেবে দেখবেন কি?
ধর্ম।
নারীদেহকে ধর্ম যেভাবে বর্ণনা করেছে, শুরুতেই পুরুষের মননে নারীদেহকে একটি নিষিদ্ধ গন্ধম করে তোলা হয়েছে। নারীদেহকে ধর্মগ্রন্থে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা হয়ে উঠেছে এক নিষিদ্ধপল্লী। এগুলো এমন একটি পর্যায়ে, ধর্মগ্রন্থ আর পর্নো বইয়ের সাথে কোনো পার্থক্য রাখেনি। ধর্মগ্রন্থের পরের ধাপই একজন কিশোরকে অপরাধী করে তোলা। নিষিদ্ধতার পাশাপাশিই অপরাধের বাস।
বাংলাদেশের কতজন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পুরুষ একটি পূর্ণাঙ্গ নারী শরীর দেখেছে? কতজন নারী একজন পুরুষের শরীর দেখেছে? বিষয়টি সেখানে। একটি পূর্ণাঙ্গ নারী শরীর দেখতে এখনও একজন মধ্যবিত্ত পুরুষকে পর্নো ছবির আশ্রয় নিতে হয়। যার প্রেক্ষিতে তার মানসেও সেক্স বিষয়ে কোন মননশীলতা গড়ে উঠছে না। সেক্স তার কাছে পর্নো ছবিতে দেখা অ্যাক্ট। যা বাস্তব জীবনে স্বাভাবিক নয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। তার সাথে বৈপরীত্যে যৌন জীবনে সে চরম অসুখী ও সহিংস হয়ে উঠছে। সে যৌন অপরাধী হয়ে উঠছে।
অথচ যৌনজীবন নারী পুরুষের জীবনের একটি সত্য সহজ পার্ট। সেটি মানুষ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শিখতে যেমন পারে না, তাকে পরিচালিতও করতে সক্ষম হয় না। এর জন্য দরকার শিক্ষা। যৌন শিক্ষা একটি জরুরি শিক্ষা। এ শিক্ষা একজন মানুষের বয়ঃসন্ধিকালেই শুরু হওয়া দরকার।
আমার ১২ বছরের ছেলে স্কুল থেকে এসে আমাকে যখন জিজ্ঞেস করলো, মা তোমার কি অন্য মেয়েদের মতো Menstruation হয়?
আমি বললাম, হ্যাঁ হয়। তুমি কোথায় জানলে?
– আমাদের স্কুলে আজ এটি পড়িয়েছে।
– এ বিষয়ে কি তুমি আর কিছু জানতে চাও?
– হু
ধীরে ধীরে তার বুঝার মতো করে আমি বিষয়টি তুলে ধরি।
যৌন শিক্ষা বলতে কেবল এটি বুঝায় না কীভাবে কোন পদ্ধতিতে যৌন-মিলন সংঘটিত হয়। যৌন শিক্ষা অর্থ নারী-পুরুষের শরীরের গঠন তার ফাংশন বিষয়ে জানা। ধারনা, তথ্য ও জ্ঞান। তথ্যর বিকল্প নেই।
গোপনে চটি বই না পড়ে বৈজ্ঞানিক শিক্ষা বড় বেশি দরকারি আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য। যা তাদের বিষয়টি সম্পর্কে কৌতূহল নিবারণই কেবল করবে না, বিষয়টি বিষয়ে নলেজেবল করবে। অহেতুক শ্বাসরুদ্ধকর ড্রামাটিকতা থেকে তাদেরকে মুক্ত করবে। তারা বুঝবে, এটি জীবনেরই একটি স্বাভাবিক অংশ। তদুপরি শরীরের ফাংশনগুলো জানলে সেটি তারা দায়িত্বশীলতার সাথে পরিচালিত করতে পারবে।
আমার ছেলে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, মা তুমি কি ব্রা পরো?
– হ্যাঁ, পরি।
-সব মেয়েরা পরে?
– হ্যাঁ, পরে।
ব্রা যে একটি নিষিদ্ধ পোশাক এবং সেটি নারীর স্তন ঢাকার কাজ করে বলে নিষিদ্ধ, কেবল এ কারণে পোশাকটি হয়ে উঠেছে যৌনতার প্রতীক। কেবল ব্রা দেখেই অনেক পুরুষের ইজাকুলেশন হয়ে যায় বিষয়টি এতোটাই fragile!
সেক্সুয়াল মুক্তি না ঘটলে সেক্সুয়াল অপরাধ কমা সম্ভব নয়। শিক্ষার মাধ্যমেই এ বিষয়ের স্বচ্ছতা তুলে ধরতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
প্রতিটি স্বাস্থ্য প্রকল্প থেকে এসব বিষয়ে ওয়ার্কশপ শুরু করতে হবে। সরকারের এ বিষয়ে পরিষ্কার প্রকল্পের অভাবে বা প্রকল্পের ব্যর্থতার কারণে ধর্মীয় নষ্ট হুজুরদের হাতে সমস্ত বিষয়টি চলে গেছে। প্রতিটি মানুষকে কামকাতর করে তুলেছে এই অর্বাচীনরা। প্রতিটি পুরুষ সন্তানকে জীবনের শুরু থেকে যৌন অপরাধী করে গড়ে তোলার সকল কাজ সম্পন্ন করে রাখছে এই ধর্মীয় লম্পটগুলো।
ধর্মের এই ইবলিশগুলো নারী ও নারীদেহ বিষয়ে এতো ঘৃণা ছড়ায় মাইকে ওয়াজে, নামাজে, মিলাদে যে নারী, নারীদেহ, যৌনতা, ঘৃণা ও সহিংসতা সমার্থক হয়ে উঠেছে আমাদের সমাজে। তাদের মনস্তত্বে নারীদেহ ঘৃণার ও ভোগের। সে ভোগ অবধারিতভাবে সহিংসতার।
নারী যোনির প্রতি তাদের যে আগ্রহ, সেখানে একটি শিশু আর প্রাপ্তবয়স্ক নারীর যোনির মধ্যকার কোনো পার্থক্য তারা হারিয়ে ফেলেছে। এর পেছনের কারণ তাদের যৌনমানস এখন সম্পূর্ণ অসুস্থ। আর এ অসুস্থতার সম্পূর্ণ কারণ আমাদের সমাজ রাষ্ট্র এবং ধর্ম।
অবদমিত যৌন জীবনের সাথে যুঝতে যুঝতে আগে দেখেছি পুরুষের ব্রথেল প্রবণতা। আজ তাকে ছাড়িয়ে যৌন অপরাধের বহুব্রীহিতা আমাদের হতবাক করে ফেলেছে।
আমরা দেখছি, মাদ্রাসার শিক্ষক বলাৎকার করছে শিক্ষার্থী শিশু বালককে, মসজিদের ইমামকে দেখছি দু বছরের শিশুকে ধর্ষণ করতে, দেখছি আট মাসের শিশু সন্তানকে হত্যা করতে, দেখছি বাবাকে তার তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করতে, শুনছি অসহায় প্রাণীকে বলাৎকার করতে। কখনও গরু, কখনও ঘোড়া বা মুরগি। এর সমস্তটাই এক যৌন বিকারগ্রস্ততা। যা একটি ভয়ানক অসুস্থতা। এ অপরাধ তার যৌনবিকারের সাথে জড়িত।
অসুস্থ যৌনতা ও তার কারণগুলো আগে উদ্ভাবন করতে হবে। তার আগে এর সমাধান করা কিছুতেই সম্ভব নয়। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে খবরগুলো আসছে। আমরা অসুস্থ হচ্ছি। আমরা ট্রল করছি। আমরা উত্তেজিত হচ্ছি। আমরা ক্রুদ্ধ হচ্ছি। কিন্তু কোন সঠিক ভূমিকা রাখতে পারছি না।
আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। করণীয় ঠিক করতে হলে এ অপরাধের শেকড় তুলে আনতে হবে। শেকড় না জানলে তা উপড়ানো কোনমতেই সম্ভব নয়।
নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে নারী ও তার শরীরের প্রতি সহিংসতা রোধ করা সম্ভব নয়।
সে ডিসকোর্স পরের পর্বে।