মায়ের লড়াইয়ে সন্তানরা সাক্ষী হয়, সবাই সাথী হয় না

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী:

ঘরে কোনো খাবার ছিল না সেদিন রাতে। হাতেও কোনো টাকা নেই। ঘরে আলোও নাই। সন্ধ্যা হওয়ার পর পর বাচ্চাদের নিয়ে বিছানায় শুয়েছিলাম। বিকেলে বিদ্যুত অফিসের লোক এসে বাসার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে গেছে। পাঁচ মাস বিদ্যুত বিল পরিশোধ হয়নি। বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ানোর টিচার এসে অন্ধকার ঘরে বসতে না পেরে ফিরে যাচ্ছিল। আমি মোমবাতি লাগিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু বাচ্চারাও পড়তে চাচ্ছিল না। টিচার ফিরে যেতে যেতে বলছিল, গত দুই মাস ধরে তাকে টাকা দেয়া হয়নি। যদি পারি যেন ব্যবস্থা করে দেই। বললাম, চেষ্টা করছি ২/১ দিনের মধ্যে।

টিচার ফিরে যাওয়ার পর বাচ্চারা খাবার চাচ্ছিল। দুপুরে সামান্য একটু খাবার দু’জনকে ভাগ করে মুখে তুলে খাইযেছি। রাতের চুলা জ্বলেনি। চাল, ডাল, নুন, মরিচ কিছুই নাই। বাচ্চাদের বললাম, তোমরা ঘুমাও। তোমাদের বাবা বাজার করে বাসায় ফিরবে। রান্না করে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তোমাদের খাওয়াবো। ছেলেটি বিছানার এক কোণে চুপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেলো। ছোট মেয়েটি ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকলো অনেকক্ষণ। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

আমি অপেক্ষা করছি। ওদের বাবা গত দুই রাতে বাসায় ফেরেনি। দুদিন পর আজ সকালে আমি মেয়েকে সাথে নিয়ে ওদের বাবার কলিগের বাড়ি খুঁজে বের করে তার সাথে দেখা করেছিলাম। সব শুনে তিনি বললেন, ‘শুনেছি সে জুয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু তাকে অফিস টাইমে অফিসে আসতে দেখি। সন্ধ্যার আগে বেরিয়েও যায়। বাসায় যে ফেরে না, তা তো জানি না। ঠিক আছে, আজ তাকে বলবো বাসায় ফিরতে।’ আমি তাকে অনুরোধ করে শুধু বলেছিলাম, আমি যে আপনার সাথে দেখা করে খোঁজ নিতে এসেছি, দয়া করে তাকে বুঝতে দেবেন না। তিনিও কথা দিয়েছিলেন।

রাত ১২টার কিছু পরে ওদের বাবা খালি হাতেই বাসায় ফিরলেন। অন্ধকারে দরজা খুলে দিলাম। কাপড়-চোপড় থেকে ঘাম ও সিগারেটের ধোঁয়ার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে ঘরময়। কোনো কথা না বলে ম্যাচ জ্বালিয়ে আলনা থেকে নিজের লুঙ্গিটা হাতে নিয়ে তিনি বাথরুমে চলে গেলেন। আমিও মোমবাতি না জ্বালিয়ে বাচ্চাদের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। বুঝলাম তিনি গোসল সেরে পাশের ঘরে গিয়ে শুলেন।

আমি কোনো উপার্জন করি না। তখনও নিজের পড়ালেখা শেষ করতে পারিনি। নবম শ্রেণিতে বিয়ে হয়। আর এসএসসি পরীক্ষার আগেই সন্তান। সন্তান সামলিয়ে কোন রকমে পড়ালেখাটা চালাই। হাতে কখনই টাকা থাকে না।

আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে বালিশে। আমি কোনো শব্দ করার চেষ্টা করছি না। তবুও নিঃশ্বাসের শব্দেই ছেলেটি জেগে গেলো। ‘আম্মু, বাতি জ্বালাও, পানি খাবো।’ আমি অন্ধকারে উঠতে গিয়ে মেয়ের শরীরে হাত লেগে সেও উঠে বসলো। বলল, ‘ভাত খাবো।’ আমি বাতি জ্বালিয়ে দু’জনকে বাথরুম করিয়ে বিছানায় নিয়ে এলাম। এর পর ঘরে থাকা এক প্যাকেট স্যালাইন গ্লাসের পানিতে ঢেলে দিয়ে ওদের খেতে দিলাম। ওরা কেউ স্যালাইন খেতে পারতো না। আজ দুজনই খেয়ে নিলো। আমি নিজে একগ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ওরা আর কোনো কথা না বলে ঘুমিয়ে গেল। আমি জেগে জেগে ভাবতে থাকলাম সারারাত।

পরদিন সকালে ওদের বাবা বাচ্চাদের জন্য হোটেল থেকে পরোটা-ডাল কিনে বাসায় দিয়ে অফিসে চলে গেলেন। সংসারের কোনো হাল তাকে জানাতে আমার রুচিতে কুলালো না। আমি শুধু চুপ হয়ে রইলাম।

কিছুক্ষণ পর আব্বা এলেন বাসায়। আব্বা তখন প্রতি সপ্তাহেই বাসায় আসতেন। আজ আমি কেমন লজ্জা পাচ্ছিলাম তাকে আপ্যায়ন করতে পারছিলাম না বলে। একসময় তিনিই বললেন, ঘরের ফ্যানটা ছাড়তো মা। গরমে অস্থির লাগছে। আমি হাতপাখা নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, বিদ্যুত নাই আব্বা। তিনি বললেন, কতক্ষণ ধরে নাই? এবার বললাম, গতকাল বিকেলে লাইন কেটে দিয়ে গেছে বিদ্যুত অফিসের লোকজন।
সব শুনে তিনি বললেন, জামাই তো চারদিন আগে আমাদের বাড়িতে গেছে। আমার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে এসেছে। সে টাকা কী করেছে তুই জানিস না?
না, আব্বা। তিনি সেদিনের পর তিন দিন পরে গতরাতে বাসায় ফিরেছে। ঘরে কোনো খাবার নাই। একটা টাকাও নাই। বাচ্চাদের গতরাতে না খেয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। আজও কোনো খাবার নাই। সকালে পরোটা কিনে দিয়ে চলে গেছে। আমি এখনো চুলা জ্বালাতে পারিনি।

সব শুনে আব্বা বাজারে গেলেন। চাল, তেল, নুন, গরুর মাংস, মাছ কিনে আনলেন। আমি রান্না করে আব্বাসহ বাচ্চাদের নিয়ে খেলাম। খেয়ে আব্বা অপেক্ষা করতে থাকলেন।

সেদিন রাত ৯ টায় তিনি ফিরলেন। আব্বা আমাকে তাড়া দিতে থাকলেন তার কাপড় এগিয়ে দিতে, খাবার এগিয়ে দিতে। আমি টেবিলে খাবার লাগিয়ে দিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে বসলাম। আব্বা তাকে সাথে নিয়ে খেতে বসলেন। জোর করে পাতে তুলে দিলেন। কুশল জানতে চাইলেন। এসময় মোমবাতিও শেষ হয়ে গেলো।
তিনি যেন হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ঘরে আর কোনো মোমবাতি নাই? মোমবাতি কি জ্বালায়, না এমনি এমনি খায়?
আব্বার তখনও খাওয়া হয়নি, বাচ্চারাও অন্ধকারে, তবুও আমার পাশের ঘর থেকে আসতে দেরি দেখে আব্বা বললেন, জামাই, বিদ্যুতের লাইন কেটে দিলো কেন? এবার তিনি নিজে উঠে মোমবাতি লাগাতে লাগাতে বললেন, বিদ্যুত অফিস নিশ্চয় কোনো ভুল করেছে। না হলে লাইন কাটতেই পারে না। হাতে অনেক কাজের চাপ। নইলে আজকেই গিয়ে ওদের ধমকে দিয়ে আসতাম।

আব্বা কী বিশ্বাস করলো, করলো না, বুঝতে পারলাম না। বাচ্চারা খেয়ে পাশের ঘরে চলে গেলো। আব্বা তাকে বললেন, টাকা দিয়ে কী করলেন, বাবা? ঘরে তো কোনো খরচ নাই। ওরা না খেয়ে পড়ে আছে। আমি এসে বাজার করেছি। এমন হয় কেন? এতো ভালো চাকরি করেন বাবা, সংকট তো হওয়ার কথা না।

তিনি এবার পুরোপুরি অস্বীকার করে বসলেন সবকিছু। ‘আমি তো জানি না ঘরে খাবার নাই। আমাকে বলতে হবে না? আমাকে না বলে আপনাকে এভাবে বলতে গেছে। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সে নিজে সংসারী নয়। তার জন্য আমার যতো সমস্যা।’

আব্বা আর কথা বাড়ালেন না। হাত ধুয়ে উঠে বিছানায় গেলেন। তিনি পিছে পিছে গিয়ে আব্বার বিছানার মশারিটা নিজ হাতে দিয়ে দিলেন। যত্ন করে বিছানার চারদিকে মশারি গুজেও দিলেন।

পরদিন আব্বা চলে যাওয়ার বেলা আমাকেই কাছে ডেকে আরো সহনশীল, আরো দায়িত্বশীল হওয়ার কথা বললেন। আমার জীবনের ক্রাইসিসগুলোর জন্য আমাকেই দায়ী করে চলে গেলেন।

এমন কতো কতো দিন-রাত চলে গেছে। আমার আর কোনদিন আব্বা-মাকে কিছুই বলা হয়নি। শুধু ৫০ হাজার টাকা নয়, ২/৩ মাস পর পর এক-একটা জমি বিক্রি করে জুয়া খেলে শেষ হলো। আমি আর কোনদিন আব্বাকে কিছু বললাম না। তার দায়িত্বহীনতা চরমে উঠলো, আমি কাউকে বুঝতে দিলাম না। কিন্তু সেসময় আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ডাক্তার বললেন, হয়তো বাঁচানো যাবে না। এবার তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। অপেক্ষা করতে থাকলেন আমার মরে যাওয়ার। আমি শরীরে মরলাম না, বেঁচে গেলাম। কিন্তু মনে মনে তাকেই মৃত ঘোষণা করলাম। বাড়তে থাকলো সকল দূরত্ব। মৃত আর জীবন্তের দূরত্ব। যোজন থেকে যোজনে।

এর মধ্যে আমার পড়ালেখা শেষ করে আমি রোজগার করা শুরু করলাম। বিনা বাক্যব্যয়ে নিজের ও সন্তানদের সকল দায়িত্ব মাথায় নিলাম। সব ধরনের কাজকে গুরুত্ব দিয়ে করতে থাকলাম। নিজেকে সম্মান করে আমি আজো সেভাবে বেঁচে আছি।

আমি কাউকে দায়ী করা ভুলে গেলেও আমার সন্তানরা স্বার্থপরের মতো ঠিকই আমাকে দায়ী করে। তারা আমার বাঁচা ও বাঁচানোর লড়াইয়ের সাক্ষী হলেও সাথী হলো না। আমার মর্যাদার লড়াই আরো দীর্ঘতর হলো। মরণতক। শুধু একার।

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী
লেখক সাংবাদিক
তারিখ-১০.০৩.১৮

শেয়ার করুন: