উড়তে হলে ভাঙতে হবে শেকল

লোপা হোসেইন:

“নারী দিবস” এলেই কেন যেন মন খারাপ হয়ে যায় আমার। এক অচেনা বিষন্নতা এসে ভর করে। অসহায় লাগে। কারণ “নারী দিবস”,”নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়”,”নারীদের জন্য আলাদা কোটা” –এই কথাগুলো কানে এলেই নিজেকে বঞ্চিত, নিপীড়িত, আশ্রিত এক বিশেষ শ্রেণীর জীব মনে হয়, যে মানুষের মতো দেখতে হলেও পুরোপুরি মানুষ নয়। শেকলে বাঁধা কোনো প্রাণী, যে শেকলের অন্য প্রান্ত ধরে আছে পুরুষ আর নিজের অজান্তেই দাসত্ব স্বীকার করে নেয়া এক শ্রেণীর নারী। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর প্রত্যেকটিরই কিছু প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হলো গতকাল। এ উপলক্ষে আজ কথা বলতে চাই “শেকল” নিয়ে। সমাজ আমাদের জন্য যে শেকল তৈরী করে এবং সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে যে শেকলের ধরন-গড়নও পাল্টায়… আমাদের সমাজ “আদর্শ নারী”র একটা ফ্রেম তৈরি করে দিয়েছে। যে ফ্রেমের বাইরে পা দিলেই সে আর “ভালো মেয়ে” সার্টিফিকেট পায় না। আর পেয়ে থাকলেও তা কেড়ে নেয়া হয়। তাকে তিরস্কার করা হয়। কখনো হাতে মেরে রক্তাক্ত করা হয় তার শরীর। কখনো মুখের কথায় প্রতিদিন একটু একটু করে খুন করা হয় তার আত্মসম্মান আর আত্মবিশ্বাস। কখনো আমাদের চোখের সামনে, কখনো আমাদের অজান্তেই আমাদের পায়ে পরিয়ে দেয়া হয় এক অদৃশ্য “শেকল”।

সমাজ আমাদের বোঝাতে চায় এটি আমাদের সৌন্দর্য্য বর্ধক নূপুর সদৃশ। আর্থিক শ্রেণী ভেদে সে নূপুর হয় সোনা, রূপা, তামা বা লোহা দিয়ে গড়া। আর এই শেকল যে নারীর পায়ে কেবল পুরুষই বেঁধে দেয় তা নয়। পুরুষের ভয়ে বা কখনো পুরুষকে তুষ্ট করতে এই শেকল পরানো সমাজের অংশ হয়ে যায় নারী নিজেই।

আমাদের দেশে একটি মেয়ের সুন্দরী না হওয়া মনে হয় সবচেয়ে বড় অপরাধ । “সুন্দরী”র স্বরূপ কেমন হবে, সেটাও সমাজ আমাদের ঠিক করে দেয়। সুন্দরী হতে হলে একটি মেয়েকে ফর্সা হতে হবে। তাকে স্লিম হতে হবে। ঘন চুলের অধিকারী হতে হবে। বেঁটে বা নাক বোঁচা হওয়া চলবে না। চোখে চশমা পরা চলবে না। অপুষ্টির শিকার হোক, হাড়গুলো ক্ষয়ে যাক, ভেতর-বাহির রক্তাক্ত হোক, কিন্তু সুন্দরী তাকে হতেই হবে।

শারীরিক সৌন্দর্য্য ছাড়া সব বৃথা, তা সে যত শিক্ষিত আর গুণীই হোক না কেন। রান্না এবং গৃহস্থালি কাজ না জানা বা কম জানাও অনেক বড় অপরাধ। তা সে যত ভদ্র, বিনয়ী, সহনশীল, স্বাবলম্বী আর পরিবারের সকলের প্রতি যত্নশীলই হোক না কেন। আর যদি শখ করেও সিগারেটে দুটো টান দিতে বা মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দেখা যায় কোনদিন, সেই মেয়ে তো চরিত্রহীন। যে মেয়ের বান্ধবীর চেয়ে বন্ধুর সংখ্যা বেশি, যে কখনো ছেলে বন্ধুদের সাথে রিকশা চড়ে ঘুরে বেড়ায় বা সিনেমা দেখতে যায়, সে তো আরো বড় চরিত্রহীন … কথাগুলো শুনে হয়তো অনেকেরই মনে হবে- শিক্ষিত মানুষেরা তো আর এভাবে ভাবে না। এসব চিন্তা গ্রাম,মফস্বলের মানুষ করে।

মনে হতে পারে – এই ভাবনাগুলো কেবল পুরুষের। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, সবগুলো কথাই আমার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। মানুষগুলো সবাই শহরে বসবাসকারী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং তাদের অনেকেই নারী।
আমার এই লেখাটা পুরুষদের উদ্দেশ্যে নয়, নারীদের উদ্দেশ্যে। পুরুষের মানসিকতা আমরা পাল্টাতে পারবো না, পাল্টাতে যাবোও না। আর পুরুষদের প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু ভাবাও বোকামি। আমাদের পাল্টাতে হবে নিজেদের।

আমাদের ভাবতে হবে- সমাজ আমাদের যে ফ্রেমের ভেতর সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করে, আমরাও কি সেভাবেই থাকতে চাই? আমরা কি অন্যের চোখের দেখায় নিজেকে দেখতে চাই ? নাকি নিজের আয়নায় নিজেকে আবিষ্কার করতে চাই ? আমরা কি সোনা-রূপার নুপুর সদৃশ শেকল পরে কৃত্রিম সুখের অভিনয় করে যেতে চাই? নাকি শেকল ভেঙ্গে উড়তে চাই সম্ভাবনার বিশাল, উন্মুক্ত আকাশে? আমরা কি নিজের রঙে রাঙাতে চাই পৃথিবীকে, নাকি বর্ণহীন পানি হয়ে রঙিন বোতলে প্রবেশ করাতেই সাফল্যের স্বাদ নিতে চাই? আমরা কি শক্তিশালী হয়ে নিজেকে রক্ষা করতে শিখতে চাই, নাকি সিনেমার নায়িকাদের মতো “বাঁচাও বাঁচাও” চিৎকারে পুরুষের কাছেই নিরাপত্তা চাই? নিজের গন্তব্য নিজে ঠিক করতে চাই, নাকি চাবি দেয়া পুতুল হয়ে বাঁচতে চাই?

আমাদের সমাজ আমাদের পায়ে যে শেকল পরিয়ে দিয়েছে, সে শেকল দু’হাত দিয়ে ভাঙা এতো সহজ নয়। কিন্তু নিজের দু’হাতের সাথে যদি আরো দুটি বা চারটি বা আরো কয়েক জোড়া হাত এসে মিলে যায়, তাহলে এই কঠিন শেকল ভাঙা আর কঠিন হয় না। একে অপরের প্রতি ঈর্ষা, অবহেলা আর তাচ্ছিল্য আমাদের কেবল ক্ষতিই করবে। আমরা বন্ধু হয়ে, সহমর্মী হয়ে একে অন্যের হাত ধরলে আমাদের বিষন্ন আকাশ আলোয় ঝলমল করে উঠবে। আমরা একে অন্যের হাতিয়ার হতে পারলেই ভাঙতে পারবো শেকলগুলো।

নারীরা যদি পুরুষ সমাজকে খুশী করতে অন্য নারীর নামে কুৎসা না রটিয়ে তার শেকল ভাঙতে সাহায্য করেন, তাহলে দেখবেন আপনার পায়ের শেকল ভাঙতেও কেউ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
পুরুষ যখন শিশু থাকে, তখনই যদি মা তাকে শেখান যে মেধায়, বুদ্ধিতে, দক্ষতায় নারী পুরুষের চেয়ে কম নয়,যদি বোঝান যে রান্না,ঘর গোছানো, সন্তান লালন পালন কেবল নারীর কাজ নয়, তাহলে নারীর প্রতি সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে উঠবে আমাদের পরবর্তী পুরুষ প্রজন্ম।

একটি মেয়েকে কত ধরনের শারীরিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার ধারণা মাকেই দিতে হবে তার ছেলে সন্তানটিকে। যাতে সে নারী শরীরের প্রতি লালসা নিয়ে নয়, বরং মমতা আর শ্রদ্ধা নিয়ে বেড়ে ওঠে। সুন্দরী হওয়া জরুরি নয়, জরুরি হচ্ছে শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে শক্তিশালী ও স্বাবলম্বী হওয়া। আমাদের নিজস্ব শক্তিকে কাজে লাগিয়েই ভাঙতে হবে আমাদের পায়ের শেকল। আমরাই হবো একে অন্যের ঢাল আর তলোয়ার।

সংগীত শিল্পী, সংবাদ উপস্থাপক

শেয়ার করুন: