তুমহারি সুলু: নারীর স্বপ্ন আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের গল্প

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল:

১.
তুমহারি সুলু আমি এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবারই দেখেছি। খুব সাধারণ একটি গল্প, কিন্তু মনে হয় আমাদের প্রতিটি মানুষেরই জীবনের গল্প। সিনেমা বলেই শেষ দৃশ্যে সুলুর জয় হয়; কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন। সুলু কে? ঘর গোছানো, হেঁশেল সামলানো, ছেলের পড়াশোনা, পাড়ার ছোটখাটো অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা নিয়ে খুশি থাকা একজন গৃহবধূ, যিনি স্বপ্ন দেখতে জানেন।

হ্যাঁ, তার ভাগ্য ভালো যে স্বপ্নগুলো শেয়ার করার জন্য তার স্বামী তার সাথেই থাকেন। যা কিনা সাধারণত মেয়েদের স্বপ্নেই থেকে যায় একজন স্বামী নয়, বরং সারাজীবন যার সাথে থাকবেন সেই বন্ধুকে পাওয়া। যারা সত্যিই সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক খুঁজে পান, তাদের জীবনে আসলেই বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না। স্বামী-স্ত্রী যখন দুজন দুজনের সত্যিকার বোঝাপড়ার জায়গাটি তৈরি করতে পারেন, সেটি বোধকরি খুবই সুন্দর সম্পর্ক। এই যে তাদের ছোটো ছোটো খুনসুটি বা স্ত্রীর ছোটো ছোটো স্বপ্নগুলো বা ইচ্ছাগুলোকে মন দিয়ে শোনা বা স্ত্রীর ছোট ছোট আনন্দগুলোকে ভালবাসা, এ যেন অনবদ্য!

২.
সিনেমাতে সুলু যখন গৃহবধূ, তখনও তার বোনেরা তাকে নিয়ে লজ্জা পান; আবার যখন আর.জে, তখনও তাদের মাথা কাটা যায়! মধ্যবিত্ত বাড়ির গৃহবধূ, নিজের স্বপ্ন আর ইচ্ছে পূরণের জন্য যখন রাতের শো এর আর.জে হয়, তখন তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে, এটিই সহজ সমীকরণ। সুলুর দুই দিদি এবং বাবা প্রথমে জেরা করে সুলুর স্বামীকে, কেন সে তার বৌকে রাতের বেলা এরকম ‘অশ্লীল‘ শো করার অনুমতি দিয়েছে, যা কিনা বাড়ির সবার সঙ্গে বসে শোনা যায় না। তার সংসার রসাতলে যাচ্ছে। ছেলের দেখভাল হচ্ছে না। মোটামুটি চেনা ছকই, নয় কি?

৩.
আমার কাছের এমন একজনের গল্প বলি। তিনি পাস করে ঘরে বসে না থেকে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ঢুকেছিলেন, তার মা-বাবা যারপরনাই লজ্জিত তার মেয়েকে নিয়ে। অথচ মা কিন্তু মাদ্রাসাতে শিক্ষকতা করেন। তারপর বিয়ের পর এই চাকরির সাথে আরও কিছু করার ইচ্ছে থেকে বরের উৎসাহে অনলাইনে ছোটখাটো বিজনেস শুরু করা।

আমি বলি, বাহ্! কিন্তু, তার পরিবারের সবাই ছি: ছি: বলতে বলতেই অস্থির, উৎসাহ দেয়া তো দূরের কথা! যদি চাকরি না করতো মেয়েটি, তাহলেও কথা শুনতে হতো, আবার করেও কথা শুনতে হচ্ছে! তুমহারি সুলুতেও ঠিক এটিই কী সুন্দরভাবে যে দৃশ্যায়ন করা হয়েছে! চাকরি না করলেও পরিবারের সম্মান যায়, তাদের সমপর্যায়ে নেই বলে! আবার করলেও তাদের পছন্দের কিছু করতে হবে।
এখানে যে ব্যক্তি, সেই নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাকচ হয়ে যায়, ঠিক আমাদের চারপাশের পরিবারের মতো করেই। নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার কীভাবে ক্ষুন্ন হয় এবং নারীকে যে সবসময়ই একজন ‘গার্জেয়ান’ এর অধীনস্থ থাকতে হবে, সে বাবাই হোক কী স্বামী, সেটি যেন সুন্দরভাবে সবার সামনে নিয়ে আসলেন পরিচালক! পাশাপাশি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে সামাজিক স্ট্যাটাস কীভাবে সক্রিয় থাকে এবং এতে নারীরা কিভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে, তাও কতো সহজভাবেই না দেখিয়েছেন!!

৪.
এছাড়াও আরেকটি বিষয় যে, আমাদের সমাজ নতুন কিছুকে সহজে মেনে নিতে পারে না। তাই তো দেশের কথা বললে, মানুষ বিসিএস এর চক্কর থেকে বের হতে পারছে না। সেখানে কোনো নারী বিজনেস করছে ভাবলে তাদের শরীরের রোম খাড়া হয়ে যায়। অথবা রেডিও জকি। একসময় সাংবাদিকতা ছিল। একবার কিছু জুনিয়র সাংবাদিক রিক্রুটিং দেয়ার জন্য একটি ছোট পরীক্ষা হলো। সেটিতে উৎরে আমি যারপরনাই আনন্দিত। আমার এক অধ্যাপক চাচা বললেন, তোমার বাবা-মার প্রশ্রয়ের তোমার সর্বনাশ হচ্ছে। খবরদার এইসব বাজে কাজ করবে না। তিনি সরাসরি বলেছিলেন, আর অন্যরা আড়ালে আলোচনার রসদ খুঁজে পেয়েছিল আরকি! আমি জানি, কত মেয়ে নিজের সাংবাদিকতার ইচ্ছাকে শেষ পর্যন্ত বাদ দিয়ে দেয় পরিবারের কারণে। রাতের শো বা রাতের অফিস বা এরকম নানা বিষয়কে বেহুদা ইস্যু বানানো হয়।

ব্যবসাকে এখনও মনে করা হয় আলু-পটলের ব্যবসা; আর এখানেই শ্রেণি বৈষম্যের বিষয়টিও যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যে শিক্ষিত মানুষ আবার ‘ছোটলোকের‘ মতো ব্যবসা করে নাকি! ‘শিক্ষিত‘ একটি শ্রেণিই বটে!! পড়াশুনা শিখে উচ্চ ডিগ্রিধারী হয়ে আপনি যেমন পোল্ট্রি ফার্ম দিলে আপনার আত্মীয়দের কাছে আপনি ‘চাষা‘ স্ট্যাটাসের হয়ে যাবেন; এটিও তেমনই একটি বিষয়।

পরিবার থেকেই কিন্তু বিরোধিতাটা শুরু হয় যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রেই; আর মেয়ে হলে তো কথাই নেই। সেটি বাবা-মা-ভাই-বোনই হোক, কিংবা স্বামী-সন্তান! অথচ বিশ্বাস করুন, কিংবা নাই করুন, একজন মেয়ে কিংবা ছেলে, পরিবারের সাপোর্টেই যে কতো অসাধ্য সাধন করতে পারতো, সে কথা কে বোঝাবে, কাকেই বা বোঝাবে! পরিবারের সদস্যরাই যখন বোঝেন না, তখন কিন্তু বাইরের মানুষেরা কথা বলার সুযোগ পেয়ে বসে।

৪.
শুধু একটি চান্স, সাথে নিজের যোগ্যতা আর পরিশ্রম, কিনা করতে পারা সম্ভব! প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে নয়, পাশে থাকুন, পাশে থেকে দেখুন কত অসম্ভবের গল্প তৈরি হবে বাস্তবেও! আপনার সঙ্গী বা অাপনার মেয়েকে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের বা মতামত প্রকাশের অধিকারটি দিন, তিনিও একজন মানুষ, তারও ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রকাশের সুযোগ করে দিন। নারীর সামনে এগিয়ে যেতে হলে আগে ইকুয়্যিটি নিশ্চিত করতে হবে, সেটি যদি কোনদিন সত্যিই নিশ্চিত করা যায়, তবে না হয় ইকুয়ালিটি নিয়ে ভাববেন।

শেয়ার করুন: