নাসিব-ই-নূর মিতু:
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা নারীই জন্মের পর থেকে একটা কথা শুনে বড় হই। বলা যায় কানের কাছে বুলির মতো আওড়ানো হয়- “লজ্জা নারীর ভূষণ”। বাংলা ভাষা জন্মের সাথে সাথেই মনে হয় এই বাক্যটির উদ্ভব। সহস্রবার একটি মিথ্যা বলা হলে, এক সময় তা সত্যি মনে হতে থাকে। আমাদের দেশের মেয়েদের ক্ষেত্রেও কথাটা ঠিক। জন্মের পর থেকে এই এক কথা শুনতে শুনতে আমরা ধারণাই করে নিয়ে মেয়ে মাত্রই লজ্জার ভান্ডার। হাঁটতে, চলতে, উঠতে,বসতে, কথা বলতে সব খানেই লজ্জা আমাদের আস্টেপিস্টে জড়িয়ে থাকবে। আহা লজ্জা!
পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় বোধকরি এমন প্রবাদ-প্রবচন,বাগধারা,বাক্য সংকোচন কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে নারীদের দমিয়ে রাখার আরেকটা কৌশল হলো এই চিরাচরিত এই বুলি। মুখ ফুটে কিছু বলবে কি? আগেই তো মুখে লজ্জার কুলুপ আটা।এখন অনেকেই আমার দিকে তেড়েফুঁড়ে আস্তে পারেন! এতো দিনের সংস্কার, ঐতিহ্য “লজ্জা”- আমি ছাড়তে বলছি বলে। যে লজ্জা আমার ক্ষতির কারণ। এমনকি মৃত্যুরও কারণ, যে লজ্জা আমার মুখে আহার না দিয়ে অনাহারে রাখে- তাতে আমার কী লাভ?
এখন অনেকে ভাবতেই পারেন লজ্জা কিভাবে মৃত্যুর কারণ হতে পারে? একটা ছোট্ট গল্প বলি। বছর ছয়েক আগের কথা।তখনো মা হইনি। কিন্তু সন্তানসম্ভবা মায়েদের প্রতি আমার অশেষ ভালোলাগা আর ভালোবাসা কাজ করে। আমার এক কলিগ সন্তান সম্ভবা। রিক্সায় উঠলাম তাকে নিয়ে। রিক্সা আলা পাইলটের গতিতে রিক্সা চালানো শুরু করলো। বারবার বলার পরও সে তার গতি কমায় না। তাকে জোরে ধমক দিয়ে বললাম, আমার সাথের আপুটির কথা। এরপর তার গতি কমে আসলো, কিন্তু আপুটি আমাকে বললেন “কী দরকার ছিলো রিক্সাওয়ালাকে এটা বলার, ও কী ভাববে? মানে আমার আপুটি লজ্জা পাচ্ছেন। যে লজ্জা তোমার ক্ষতির কারণ, সে লজ্জা রেখে লাভ কি? আমার আগে তো তার নিজেরই সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বলা উচিত ছিলো-সাবধানে রিক্সা চালানোর কথা। আমরা নিশ্চয়ই এতো অমানুষ হয়ে যাইনি যে এমন কথা শোনার পরও ওই রিক্সাচালক অসাবধানতা নিয়ে রিক্সা চালাবেন? কিন্তু মাঝখানে বাদ সাধে লজ্জা। এভাবে তো একটা এক্সিডেন্ট হতেই পারে, যা মা ও শিশু দুজনের জন্যই মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়!
এবার আসি আরেকটি গল্পে। মোহাম্মাদপুর –মতিঝিল বাসে যাওয়া আসা করতাম চাকরীর সুবাদে। এভাবে আসা-যাওয়ার পথে অনেকেই চেনা হয়ে যায়। সিটি ব্যাংকে চাকরী করতেন এক আপু। একদিন পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দেখলাম তিনি সন্তানসম্ভবা। উঠে তাকে বসার জায়গা করে দিলাম। এভাবেই তাঁর সাথে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উনি নামতেন মতিঝিল রাজউক এর সামনে। ওখানে বাস পুরা থামতোনা,স্লো করতো। ওভাবেই উনি নেমে যেতেন। যা ছিলো খুব ঝুঁকিপূর্ণ।
একদিন ওনাকে বললাম-“আপনি আগে থেকে বলে রাখেন না কেন?” উনি বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-“কী বলো? কী ভাববে ওরা?” একজন শিক্ষিত ও কর্মজীবী নারীর মুখে এমন কথা শুনে খুব অবাক হয়ে ছিলাম। এর কয়েকদিন পরেই বাস থেকে নামার সময় উনি পড়ে যান এবং জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে নিজে ফিরে আসেন, কিন্তু বাচ্চাটা বাঁচেনি। ওনার সাথে পরে যখন দেখা হয়েছে, খুব বলতে ইচ্ছে হয়েছে; কী লাভ হলো আপু এমন লজ্জায়?
আমাদের দেশে বা উপমহাদেশে প্রায় ৯০ভাগ মেয়েই তাঁর ঋতুকালীন সমস্যার কথা কাউকে জানান না। এমনকি নিজের পার্টনারকে জানাতেও সঙ্কোচ বোধ করে। পরবর্তীতে যা শুধু সমস্যাই সৃষ্টি করে না, প্রাণঘাতীও হয়ে যায়।
ইভটিজিং এর ঘটনাগুলোতে দেখা যায় প্রায় ৬০% মেয়ে লজ্জায় বাড়িতে বা অভিভাবককে কিছু জানায় না। পাছে লোকে কিছু বলে! ফলশ্রুতিতে ধর্ষণ, নির্যাতনের মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে।
একটা মেয়ের মুখ ফুটে কিছু না বলা, এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের চারপাশের মানুষ ওই মেয়েটার সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে। এমনও শুনেছি, বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে মুখফুটে ক্ষুধার কথা না বলার কারণে, একটা মেয়ে সারাদিন না খেয়ে থেকে, বিপি লো করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। খেতে চাইলে হয়তো কেউ তোমাকে বেহায়া বলতো, তাতে কি? তুমি তো এভাবে অসুস্থ হতে না!
নারী! মুখ খোলো, আওয়াজ তোলো। নিজের প্রয়োজনের কথা অন্যকে জানাও। প্রয়োজনে নিজের দিকে নিজেই সাহায্যের হাত বাড়াও। না কাঁদলে মাও সন্তানকে দুধ দেয় না। আর তুমি তো নারী! তোমার দিকে তোমারই নজর দিতে হবে, নইলে কোনদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। লজ্জা তোমাকে কিছুই দেবে না নারী, বরং নেবে বহুগুণ। এর চেয়ে বরং লজ্জাহীনা হয়ে বাঁচার মতো বাঁচো। লজ্জা নারীর ভূষণ নয়, লজ্জা নারীর পায়ের বেড়ী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আরেকটা কৌশল তোমাকে অন্তর্মুখী করে রাখার।