ফেসবুক, বেশবুক

শেখ তাসলিমা মুন:

আমাদের ছোট্ট মফস্বল জায়গাটিতে ঘরে ঘরে টেলিফোন ছিল না। একটি টেলিফোন অফিস ছিল। ‘ট্রাঙ্ককল’ করে টেলিযোগাযোগ হইতো। আমাদের বাড়ির পাশের সরকারি কোয়ার্টারসের হেড কোয়ার্টারে একটি ফোন ছিল। আর ছিল থানা অফিস কোর্ট আদালতে। বাসা থেকে শুনতে পেতাম চিৎকার চলছে ‘অ্যালা’ ‘অ্যালা’, হ্যালোই বলতো মনে হয়, আমার কানেই মনে হতো হ্যালা অ্যালা।

কথা বলা যে এতো যন্ত্রণার, তবু একটা শব্দ বার বার বলে ওপারের কারও কান আর গলা ফাটিয়ে দেওয়া যোগাযোগের কাল আমাদের ছিল। সে এক গর্বের কাল। আপনজনের কাছে আমরা চিঠি লিখতাম। কসিটানা খাতায় লেখার কাল শেষ হলে সাদা পাতায় বেশ মুন্সিয়ানা স্টাইলে চিঠি লিখতাম।
‘আমাদের বাড়ির সকলে ভাল আছেন আছে। তোমাদের বাড়ির সবাই কেমন আছে?’ শনি আর মঙ্গলবার ছিল হাটবার। দূর গ্রাম থেকে হাটুরেরা আসতো। হাটের প্রান্তে গিয়ে বিকট শব্দে তারা ডাক দিতো প্রয়োজনীয় জনকে। দুমাইল দূরে সে শব্দ পৌঁছে যেতো। একটু অপেক্ষা করলে ওপারের জনের উত্তরও পাওয়া যেতো। ভাবতে অবাক লাগে। এমন যোগাযোগকাল আমার জীবদ্দশায় দেখা।

আমার প্রথম মোবাইল ফোন ১৯৯৬ সালে। এরিক্সন। একটি আস্ত ইটের সাইজ। জ্যাকেটের পকেটে রাখলে সেটি ঝুলে পড়তো হাঁটু পর্যন্ত। ইন্টানেট আমি ব্যবহার করি বেইজিং এ চতুর্থ নারী সম্মেলনের সময়। আমার থিসিসের টপিক ছিল ‘আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে নারী অধিকার’। প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে একটি বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনের ডকুমেন্টস প্রিন্ট নিতাম। বিশাল একটা এড্রেস নির্ভুলভাবে লিখতে নাভিশ্বাস উঠে যেতো। পিঠে ব্যথার অসুখটা মনে হয় তখনই শুরু। ইমেইল। আহা! বিস্ময়ের কোন সীমা নেই। একটার পর একটা আসতে শুরু করলো।

একটু আধটু লিখতাম এতো যোগাযোগ আবিষ্কার হবার আগেই। দেশের কোনো পাক্ষিক বা দৈনিকের সম্পাদকের কাছে ফ্যাক্স করে হাপিত্যেশ করে চেয়ে থাকতাম। হয়তো ছাপবে। না ছাপলে নাই! কে কেয়ার করে?

এলো ব্লগ। নিজে লেখো নিজে ছাপাও। এডমিন মেম্বারশিপ দেবেন কিনা সেটার জন্য অবশ্য অপেক্ষা করতে হতো। তবে ফেসবুক কী, তখনও আমি জানি না। আমি ব্লগে একাউন্ট করি প্রথম। ফেসবুক শুরু করলাম ২০০৭ সালে। প্রথম ছ মাস শুধু একাউন্ট ছিল। কোন অকাম কিছু করি নাই তখনও।
তার পর একটা গ্রুপ ‘কাল’ আসলো ফেসবুকের। একটা কিছু ঘটলে গ্রুপের মাধ্যমে আমরা প্রতিবাদ করতাম। এখনও দুটো গ্রুপ থেকে মেম্বার হবার রিকোয়েস্ট আসে। এক্টার নাম ‘ইভটিজিংবিরোধী মুভমেন্ট’ অন্যটি ‘নারীবাদী’। সেসব ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই।

যা লিখি নিজের পোষ্টেই লিখি। এ লেখালেখিতে নিজের মনের বাষ্প বের হওয়া ছাড়াও মানুষের সাথে একটা কানেক্টিভিটিও তৈরি হয়। স্বজনদের নড়াচড়া দেখা যায়, নিজের নড়াচড়া দেখানো যায়। স্থিরচিত্রে কিংবা এক্টিভিটিজে। ইনবক্সে যদিও স্ক্রিনশট জাতীয় করার দরকার পড়ে নাই। তবে নূরানি দাঁড়ির কাউরে ভাল্লাগলে স্ক্রিনশট কইরে রাখি। ডিলিট মারার পরও যেন হৃদয়ে থাকে। যাই হোক, সব মিলায়ে ছয় সপ্তাহের বেশি ফেবুতে নাই। বিশেষ কারাকাল ভোগ করছি ফেবু আদালত থেকে। অপরাধ যা, তা শুনলে সূর্য অর্ধস্তিমিত হবে লজ্জায়। নাইবা বললাম। শুনলাম এলেম বাবা এক নৌকার যাত্রী। তিনি ফ্যাসিবাদকে ভয় পান না। ক্রুসেড অব্যাহত থাকবে। ভাইরে, ৬ সপ্তাহ যে কারাদণ্ড পালন করছি প্রায় এক ডজন মানুষ, এ বাদরে কী বলা যায়? এর নাম তবে কী? সাধুবাদ? দিলাম তবে তাই!

অভ্যেস হয়ে গেছে। ফেসবুক না থাকলেও গড়ে প্রতিদিন একটি করে লেখা লিখেছি। ফেসবুকের বাইরেও জীবন খারাপ না। লেখালেখি থামে না সেখানেও।

ভালো কথা, কলকাতা বইমেলা এবং বাংলাদেশ বইমেলা আমার একটি করে বই আসছে। সেগুলো আগেই লেখা ছিল। লেখা কি আর থামেরে গোপাল?

শেয়ার করুন: