‘মাইন্ডসেট’ পরিবর্তনে ঘটনা অনেক সহায়ক

শেখ তাসলিমা মুন:

এমনকি প্রগতিশীল চিন্তাও একটি ডিজাইন হয়ে মাথায় বসে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত একটি ঘটনা সেটিকে নাড়া না দেয়। নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ঔচিত্যবোধ ইত্যাদির আসন বেশ শক্ত। এগুলো নিজের মনে অজান্তে একটি শেইপ নিয়ে থাকে।

মানুষের ধারণা বদলানোর জন্য আমি তর্ক করতে চাই না। একটি বিষয় বুঝি, সে মনের যে ‘অবস্থা’য় অবস্থান করছে সে অবস্থা থেকে যা সে দেখছে বা দেখতে সক্ষম, তার বাইরের কিছু তাঁকে দেখানো বা বোঝানো সম্ভব নয়। আমি সেখানে ক্ষান্ত দেওয়ার পক্ষপাতি। আমার কাজ বিষয়টির থিওরিটিক্যাল দিক অব্জেক্টিভভাবে তুলে ধরা। থিওরিটিক্যাল বিষয়টি প্রথমে যদি নাও নেয়, সেটি ব্রেইনের কোথাও না কোথাও ইনফরমেশন হিসেবে থাকে। কোনো ঘটনায় ইনফরমেশনগুলো সামনে আসে। সে রিফ্লেক্ট করে।

অনলাইনের বদৌলতে অনেক ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়। মানুষ তার প্রতিক্রিয়াও ঝটপট দিতে পারে। মতামতও। সেখানে দেখা যায় মানুষ একই ঘটনায় কত ধরনের মানসিকতার প্রতিফলন ঘটায়। খুব যে মানবতাবাদী, মুক্ত বলে দাবি করে থাকেন, তাকেই দেখা যায় জাজমেন্টাল হয়ে উঠতে। হঠাৎ দেখা যায় তাকে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে। আগের মুক্ত বিষয়ের সাথে সরাসরি কন্ট্রাডিক্ট করে এমন মতামত দিতে দেখা যায়। এতে আমি মূলত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই না। বিষয়গুলোর বিষয়ে ধারণাগুলো ম্যাচিওরড না হলেও এমন ঘটতে পারে।

আমরা মানুষ সবাই সমান না। একেকজন একেকভাবে কাজ করে। কিছু মানুষের দরকার পুঁথিগত থিওরি। কিছু মানুষের দরকার অভিজ্ঞতা বা উদাহরণ। অভিজ্ঞতা-জ্ঞান ঘটনার ভিতর দিয়ে গিয়ে পরিবর্তিত হয়। একটি ঘটনার রিফ্লেকশন তাকে ওয়াইজ করে তোলে। ব্যবহারিক জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল সে। সে বিশ্বাস করে যে তার ভেতর প্রাচীন এবং কনজারভেটিভ চিন্তা নেই, কিন্তু অবচেতন মনে কনজারভেটিভ বিষয় ভেতরে থেকে যায়।

এটা এমনকি থিওরি-জ্ঞানীদের ক্ষেত্রেও ঘটে। ইন্টিউশন বা কমনসেন্সে যেটাকে ন্যায় অন্যায় বলে সিগন্যাল দেয় সেটাকে মগজে রেজিস্ট্রি করা থাকে আমাদের। সে ডিজাইনের বিপরীত কিছু ঘটলে তারা রিয়্যাক্ট করে। বিষয়টি কেন ঘটছে সেটি নিয়ে তারা ভাবেন না। ঘটনাটির উৎস এবং গোঁড়ার কারণ নিয়ে ভাবতে তারা সমর্থ হয় না। তখনই তারা ‘জাজমেন্টাল’ হয়ে ওঠে। বিষয়টি তখন তাদের মুক্তমনা ‘অবস্থান’এর বিপরীতে চলে যায়। কোনো একটি বিষয়ের গোঁড়ার কথা জানার সুবিধা এইটি যে, কোনো বিষয়ে তাঁকে ‘জাজমেন্টাল’ হতে হয় না। তাকে বিস্মিতও হতে হয় না। কারণ ‘কেন’ র উত্তর তার জানা থাকে।

নারী জাগরণের অনেক লেখা আজকাল পড়ার সুযোগ ঘটে। বেশ ভালো লাগে আজকের নারীর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনাগুলো জানতে। তার সাথে যদি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটগুলো জানা থাকে, তাহলে প্রশ্নোত্তরগুলো নিজেদের হাতে থাকে। তাকে বিশ্লেষণ করতে পারলে বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করা যায়।

আমাদের নারীর প্রাতিষ্ঠানিক পথচলার কাল এক শতাব্দী মাত্র। বুকে হেঁটে চলতে হয়েছে নারীকে। সারা পৃথিবীর নারীকে সাংগঠনিকভাবে একত্রিত করা আজ যেমন সহজ, একশো বছর আগে সেটি ছিল না। যোগাযোগ অবস্থা ছিল কঠিন একটি অধ্যায়। একটি চিঠি পোস্ট করলে তিন মাস, ছ মাস লেগে যেতো। সে সময় এক একটি সম্মেলন সংঘটন মুখের কথা ছিল না। সেই নারীরা এখনও সংখ্যায় অনেক কম। হাজার বছর যে নারীকে একটি গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, তার মনের মুক্তি ঘটতে একটু সময় লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। অনেক তুচ্ছতার ভেতর তাঁকে আটকে রেখেছে পুরুষতন্ত্র। হঠাৎ তার মানসিক উৎকর্ষতা সাধন ঘটবে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

নারী এখন বাইরে বেরিয়ে আসছে। চারখানা সার্টিফিকেট অর্জন করলেও সাথে থেকে যায় পুরুষতন্ত্রের অন্ধত্ব। একটি পুরুষ হাজার বছর সুবিধায় থেকে যা অর্জন করেছে, একজন নারীর সকল বাঁধা পেরিয়ে আসতে যে যুদ্ধ করতে হয় তার সাথে সুবিধাভোগী পুরুষের তুলনা কোনমতেই চলে না। আমি সেজন্যই বলি, সবচাইতে মানবিক পুরুষের চাইতে একজন দানবিক নারী আমার কাছে প্রিয়, কারণ ঐ নারী ঐ পুরুষের সুবিধাগুলো ভোগ করে জীবন চলতে পারেনি।

অনেকে বলে নারী ক্ষমতায় আসলে তাঁরা অনেক কঠিন হবে। হয়ত। যারা সারাজীবন নিষ্পেষিত হয়ে আসে তাদের জন্য ক্ষমতা সহজ হয়না। কিন্তু সেজন্য মানবাংশের অর্ধেক অংশকে পিছিয়ে রাখার যুক্তি হিসেবে সেটি ব্যবহার করার কোন অধিকার কারও নেই। নারীর হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। নারী তার অতীত বঞ্চনাকে কোপ করবে শিক্ষার আলোয়, যোগ্য প্রাপ্তি ও দায়িত্বশীলতায় উত্তীর্ণ হয়ে। নারীর শিক্ষা ও সুযোগ্য পজিশন তাঁকে দায়িত্বশীল করে তুলবে।

মানুষ যখন দায়িত্বশীল, তার কাজকে জাজ করার আমি কেউ নই এটি মাথায় রাখা দরকারি। প্রত্যেক মানুষের ‘ভুল’ করার অধিকার তার জন্মগত। তার আপন ‘ভুলে’ তার অধিকার। আমি তুমি কেউ নই তাঁকে কী করতে হবে সেটি শেখানো। তার জীবনের কোর্স কমপ্লিট করতে যতবার ভুল করা দরকারি, সে সেটি করবে। আপন ভুল আপন সঠিক সাধনে সে তার জীবন সম্পাদন করবে। নিজেকে যদি ‘মুক্ত’ বলে দাবি করি, তাহলে মনে রাখা দরকার অন্য মানুষও তার মানুষ জীবনে মুক্ত।

অন্যের স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করলে নিজে স্বাধীন হওয়া যায়না।

শেয়ার করুন: