‘ভাগো গো ভগিনী’দের বলছি

নাজিয়া শারমিন:

আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়তাম বাংলা বইয়ে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের একটা প্রবন্ধ ছিল ‘জাগো গো ভগিনী আমার বইয়ে প্রিন্টিংয়ের টাইমে কম কালি পরার কারণে হয়ত ‘জ’ টা ‘ভ’ এর মত দেখাতো

ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষার পর পরই আমার ব্যাপক সিরিয়াস আম্মু আমাকে নাইনের বাংলা বই কিনে দিলেন আর মহা উৎসাহে আমি “ভাগো গো ভগিনী” পড়তে বসলাম অল্প একটু পড়েই বিজ্ঞের মতো বুঝে গেলাম প্রবন্ধের সারমর্ম। মনে মনে ভাবলাম, ‘হুম, বুঝলাম এখানে নারীশিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে’। শুধু একটা জিনিস মনে খচখচ করতে লাগল প্রবন্ধটার নাম ‘ভাগো গো ভগিনী’ কেন?

টানা দুইদিন চিন্তা করে আমার উর্বর মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরণকে কাজে লাগিয়ে শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, আসলে বেগম রোকেয়া মনে হয় নারীদের শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন সিচ্যুয়েশন থেকে ভাগতে বলেছেন। যেমনটা আম্মু ঝামেলা দেখলেই সেখান থেকে সরে পড়তে বলে, ফেইসবুকে মেয়েদেরকে দোষ দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে দেখলে সেখানে প্রতিবাদ করে কোনো কমেন্ট করতে দেয় না, লগ আউট করে ভেগে যেতে বলে, রাস্তায় চলার সময় ইচ্ছা করে ধাক্কা দিয়ে বা গায়ে গা লাগিয়ে যাওয়া বা নিউ মার্কেটে ভিড়ের মধ্যে সুযোগ বুঝে ব্রেস্ট টাচ করতে চাওয়া লোকদের কষে থাপ্পড় না মেরে মুখ বুজে ভেগে আসতে বলে, তেমন ভাগার কথাই বলছে হয়তো।

সেই সময় মনে হয়েছিল এখনও তো স্কুলে পড়ি, শিক্ষিত হইনি তাই খালি প্রতিবাদ করতে, থাপ্পড়, কিল ঘুষি মারতে মন চায়। পাশের বাসার চাকরিজীবী আন্টিটাকে আংকেল পিটায় আর আম্মুকে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে “ভাবী আমার সাথেই কেন এমন হয় বলেন তো? মন চায় ডিভোর্স দিয়ে দেই, কিন্তু মানুষ কী বলবে?” আন্টিটা যেমন নিজের আত্মসম্মানবোধকে গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজের অধিকার থেকে ভাগে, তেমনি আমিও শিক্ষিত হলে হয়তো কীভাবে ভাগতে হয় সেই কৌশলটা আয়ত্ত করতে শিখে যাবো

যাইহোক আমার নতুন এই উপলব্ধি বেশিদিন টিকলো নাহ। ক্লাস শুরুর পরই আমাকে অবাক করে ‘ভাগো গো ভগিনী’ হয়ে গেল ‘জাগো গো ভগিনী’আমার তো আক্কেল গুডুম!! হায় হায় বেগম রোকেয়া তো ভাগার কথা বলেননি। নিজের আত্মসম্মানকে সব থেকে উপরে রাখার কথা বলেছেন, বাংলার শিক্ষিত নারীদের স্বাধীনতার কথা বলেছেন, শিক্ষিত এ নারীরা সমাজে কী কী ঝামেলার মুখোমুখি হোন, সে কথা বলেছেন, নিজের অধিকারের জন্য জেগে ওঠার কথা বলেছেন নারীদের।

তাহলে শিক্ষিত আপুরা, আন্টিরা আর অন্য নারীরা এমন ভাগে কেন? আম্মুই বা আমাকে ভেগে যাওয়ার জন্য ট্রেনিং দিচ্ছে কেন!! ক্লাস নাইনে যেহেতু নিজেকে আমি একজন বড় ধরনের অশিক্ষিত ভাবতাম, আমার জানার থেকে না-জানার বিষয়গুলোর সংখ্যাই বেশি ছিল, তাই তখন থেকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকলাম ‘শিক্ষিত’ হবারআর কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় গণ্ডী পেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে ঢুকবো। কিন্তু ঝামেলা হলো, এখনও আমি সেই অশিক্ষিতই রয়ে গিয়েছি

এইতো সেদিন সামান্য ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের ফাইনাল ম্যাচের জেরে ফেইসবুকে একটা মেয়েকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছিল। যে মেয়েটাকে বলছিল সে চুপ করে ভেগে গেল। আমি তার হয়ে গলাবাজি করায় সে চুপিচুপি আমাকে ইনবক্সে বলে, “আপু থাক কিছু বলেন না, থামেন।”

আমি ভাবলাম বাহ বাহ আমার থেকে জুনিয়র এ মেয়েটা কী সুন্দর ভেগে যাওয়ার আর্টটা আয়ত্ত করে ফেলেছে, আমিই এক অশিক্ষিত এখনও ‘জাগো গো ভগিনি’কে ‘ভাগো গো ভগিনী’তে পরিণত করতে পারলাম নাহ।

আমি বলি কী- ভগিনীরা, অনেক তো ভাগলেন, এবার না হয় একটু জেগে উঠতে শিখুনপ্রতিবাদ করতে শিখুন। শিক্ষিত তো ভালোই হয়েছেন, কিন্তু পড়ে আছেন সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে। যেখানে আপনি প্রাতিষ্ঠানিক বিয়েকে বাহবা দেন, আপনাকে ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তো করবেনই না বরং ছেলেপক্ষ যখন আপনার চুল, নখ, গায়ের রং মাপবে তখন আপনি সংসারের রঙিন স্বপ্ন গাঁথবেন।

একজন স্ত্রী, মা, মেয়ের গণ্ডীর বাইরে একজন ‘মানুষ’ হিসেবে আপনি চিন্তা করতে না জানলে দোষটা আপনারইনিজের আত্মসম্মানকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের অধিকার থেকে ভেগে যাওয়ার কৌশলটা ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। আপনার সাথে যা মন চায় তা করার অধিকার তো আপনিই দিয়েছেনস্বামী বা প্রেমিকের দোষ কী এতে? নির্যাতিত হওয়ার রাস্তা তো আপনিই বাতলে দিয়েছেন।

পারফেক্ট ও শিক্ষিত বউ হওয়ার জন্য তো বিবিএ, এমবিএ, অনার্স বা মাস্টার্স কিংবা এমবিবিএস ডিগ্রি নিচ্ছেন, বা নেওয়া শেষ করেছেন এখন একটু সেই ক্লাস নাইনের বাংলা বইয়ের ‘জাগো গো ভগিনী’টা একটু পড়ে আসুন, আর নিজের মৃত বা অর্ধমৃত সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করুন। তা না হলে টিস্যু পেপারে নাক মুছতে মুছতে ‘আমার বর আমাকে কেন ভালবাসে না?’ ‘আমার সাথেই কেন এমন হয়?’ ‘আমিই কেন?’ ‘প্রেম করার সময় ও অন্যরকম ছিল, এখন বিয়ের পর আগের মতো নেই কেন?’ ‘আমি তো ভার্জিন না, ও যদি আমাকে বিয়ে না করে?’ ‘আমার মতো একটা বউকে ঘরে রেখে ঐ খ্যাত মেয়েটার সাথে পরকীয়া করে কেন?’ ‘অন্য মেয়ের দিকে ও তাকায় কেন, আমি কি দেখতে খারাপ?’ ‘আমি যদি আরেকটু শুকাই তাহলে আমাকে সেক্সি লাগবে, তাহলে কি ও একটু ঘরমুখো হবে?’ ‘ডিভোর্স দিব ভাবী? পাগল হয়েছেন? সমাজ কী বলবে?’ এইসব প্রশ্নের গণ্ডিতেই আজীবন ঘুরপাক খেতে খেতে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন।

তাই সময় থাকতে আর ভেগে নয় এবার জেগে উঠুন, কথায় কথায় শুধু পুরুষদেরকেই দোষ না দিয়ে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন, প্রতিবাদ করতে শিখুন বিশ্বাস রাখুন নিজের উপর।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.