‘একটি গল্প’

শেখ তাসলিমা মুন:

আমার ছোটবেলায় আমাদের কোনো টেলিভিশন ছিল না। একটি রেডিও ছিল। আমাদের একমাত্র বিনোদন। অনেক শিল্পী লেখককে কেবল স্থিরচিত্র এবং রিডিওতে শুনে কণ্ঠস্বরে চিনতাম। ফুটবলের ধারাবিবরণী, গানের আসর, সাক্ষাৎকার, কবিতা আবৃত্তি, গল্পপাঠ, যাত্রা, নাটক সবই আমার রেডিওতে শোনা প্রথম। শোনাও একটি অভ্যেস গড়ে তোলে। কানের ক্ষমতা এমন হয় যেন দৃশ্যগুলো পরিষ্কার দেখছি। আকাশবানীর নাটকগুলো ছিল এপিক। এখনও কানে বাজে। নামি দামী গল্প নিয়ে হওয়া নাটকগুলো মিস করতাম না। শাঁওলী মিত্রের গলা এখনও কানে লেগে আছে।

সেই সময়ের একটি গল্প আমার চিন্তার জগতে একটি ওলটপালট ঘটিয়েছিল। এখনও মনে আছে। অথচ বয়স তখন কত? বড়জোর ১৬। গল্পটি আমার জীবনের প্রথম ‘ব্যক্তিসম্মান’ ও ‘নিজ’ কী, বুঝতে সাহয্য করেছিল। মগজের স্বাধীনতা ও ইন্টিগ্রিটি ধারণের শুরু আমার সে বয়সে।

গল্পটির শুরু সুখী নব বিবাহিত এক দম্পতির আনন্দমুহূর্ত দিয়ে। শিক্ষিত সুখী সাবলীল চিন্তার নবদম্পতি। অভি আর শিলু। অফিসে যাওয়ার আগে ঝকঝকে আদর দিয়ে অভি বেরিয়ে যায়। সিঁড়ি থেকে ফিরে আসে। শিলু জোর করে অভিকে সিঁড়ি পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে আসে। খুনসুটি পর্ব শেষ করে শিলু দরোজা বন্ধ করে। অফুরন্ত সময়। শিলু ঘরদোর সাজায়, প্রিয় রান্না রাঁধে, স্নান সেরে নিজেকে সাজিয়েও সময় শেষ হয় না। মাঝে মাঝে সংসারের এটা ওটা উল কাঁটা আসন মাজন কিনতে বেরোয়। কখনও কোনো মন্দিরে পূজো দিতে যায়।

অভি অফিসের কাজে সেদিন বাইরে। দুপুর খাঁ খাঁ করছে। হঠাৎ দেখে শিলু তার স্ত্রী হেঁটে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে? ‘এই কোথায় যাচ্ছো?’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো অভি। না শিলু শুনলো না। বেশ জোরে জোরে পা ফেলে হন হন করে শিলু হেঁটে যাচ্ছে। খুব জরুরি কিছু ঘটেছে? কেউ হাসপাতালে? হঠাৎ অভির মনে একটি ভিন্ন চিন্তা খেলে গেল। সে শিলুর পিছু নিলো। শিলুর সাথে হেঁটে পারছে না অভি।

কী হয়েছে? কীসের তাড়া ওর? মাথায় এক ধরনের জিদ চেপে যায় অভির। সে শিলুকে ফলো করে। একটু দূর থেকে। শিলু একটি দোকানে ঢোকে। বেশ কিছু জিনিসপত্র হাতে বেরিয়ে আসে শিলু। দৈনন্দিন জিনিস। ফল ইত্যাদি। কোন দিকে যাচ্ছে শিলু? ওদিক তো ওদের বাড়ি নয়? হাতের বাজার নিয়ে সে কোথায় যাচ্ছে? শিলু দ্রুত একটি অচেনা গলিতে ঢুকে যায়। সে গলিতে তাদের কেউ থাকে না। কোথায় যাচ্ছে শিলু? অভি শিলুকে হারিয়ে ফেলে। অভির ভেতরে আগুন জ্বলতে থাকে। কী করবে সে? বাসায় ফিরে যাবে? অফিসের কাজ ভুলে যায় অভি।

বিকেলে শান্তভাবে দরোজার বেল টেপে অভি। শিলু দৌড়ে দরোজা খুলে অভির মুখে চিন্তার রেখা দেখে। অন্যদিন সে বেল টিপে ধরে রাখে। শিলু দরোজা খুলতে খুলতে বকা ঝকা করে। আজ সে শান্ত পায়ে ঘরে ঢুকে। শিলু বলে, বাব্বাহ! আজ বাবুর কী হলো? মুখ-টুখ দেখি ভারি সিরিয়াস? অভি কিছু বলে না। শিলু চিন্তিত হয়। অসুখ করেনি তো। অফিসের কোনো ঝামেলা? পাশে এসে বলে অসুখ করেছে নাকি? মুখ এমন কেন তোমার? কপালে হাত রাখে। কপাল থেকে হাতটি সরিয়ে দেয় অভি। শিলু অবাক হয়।

– অভি, কী হয়েছে?

– তার আগে বলো, আজ দুপুরে কোথায় গিয়েছিলে?

– মানে?

– মানে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? ঠিক দুপুর দুটো। বিপিনবাবু মোড়ে। যাওনি তুমি? একগাদা বাজার করোনি তুমি? মিত্তিরবাড়ি গলিতে দৌড়ে ঢুকে যাওনি তুমি? কই আমাকে তো আগে কিছু বলোনি? কেন? কে থাকে ও গলিতে? আমাকে বললে কী হতো?

– অভি, দাঁড়াও দাড়াও! কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি? বিপিনবাবু মোড়ে? আজ? মিত্তিরবাড়ির গলি? মাথা গরম হয়েছে? অতি গরমে উল্টাপাল্টা বকছো, ঠাণ্ডা মাথায় বসো! আমি শরবৎ নিয়ে আসছি।

– অভিনয় তো ভালই জানো দেখছি।

– অভি! এবার শিলু শক্ত গলায় অভিকে সতর্ক করে দেয়।

– কী হয়েছে পরিষ্কারভাবে বলো। আমার মনে হয় বিষয়টি এখন আর হালকা থাকছে না।

অভি কাঁপছে। কাছে এগিয়ে আসছে। হঠাত অভি শিলুর দুকাঁধ ঝাঁকি দিয়ে উন্মাদের মতো বলে, আমাকে কেন লুকালে? হাতে তোমার ধূতির দুটো ব্যাগ ছিল। দুহাতে এক গাদা ফল। বিস্কিট টোস্ট, ব্রাশ পেস্ট। কার জন্য? কে বলো? অভি এবার জোরে জোরে ঝাঁকি দিতে থাকে। বলো কে? বলবে না? দাঁড়াও কীভাবে বলতে হয় আমি শেখাচ্ছি। শাড়ির আঁচলটি শিলুর গলায় পেঁচিয়ে ধরে।

শিলু ভয় পেয়ে যায়। অভি, অভি তুমি পাগল হয়ে গেছো। থামো। আমার গলা বন্ধ হয়ে আসছে। আমি মরে যাচ্ছি। থামো থামো বলছি। অভি থামে না। তার গলা থেকে এক অদ্ভুত শব্দ বের হতে থাকে। অন্ধের মতো বলতে থাকে, কে? বলো কে কে সে? শিলু ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়। বলে, বলছি। দাঁড়াও বলছি। আমি সব বলছি, তুমি আমার গলা ছেড়ে দাও।

– এই তো কথা ফুটছে। বাহ! তাহলে বলার কিছু আছে? ছিল। কেবল আমি জানতাম না।

– হ্যাঁ আছে।

ধপাস করে বসে পরে সে। শিলু গলা থেকে শাড়ির আঁচল মুক্ত করে একটু দূরত্ব নিয়ে বসে।

– তার নাম নরেন। আমাদের সম্পর্ক ছিল। মোহগ্রস্তের মতো বলতে থাকে শিলু।

– তারপর? অভি প্রশ্ন করে যেতে থাকে। শিলু বলতে থাকে সে প্রতিদিন দুপুরে বেরিয়ে যায়। অভি অফিস গেলে সে রান্না করে স্নান করে বেরিয়ে যায় নরেনের সাথে দেখা করতে। সে মিত্তিরবাড়ির গলিতে থাকে।

– তাকে বিয়ে না করে আমাকে করলে কেন?

– সে অসুস্থ। ক্যান্সার। আমি রোজ তার জন্য দৈনন্দিন কিছু জিনিসপত্র কিনে দিয়ে আসি। ঐ যে দেখলে না একজোড়া ধূতি, একটু ফল, চা ইত্যাদি।

– তার কেউ নাই?

– না। শেষের দিকে নরেনের বড় কষ্ট গেছে। শ্বাসকষ্ট হতো। ব্যথার যন্ত্রণায় বলতো, শিলু আমাকে এক কৌটা ঘুমের ওষুধ দাও। আর পারি না। আমি নরেনকে বকা দিতাম। ওর প্রিয় কবিতা পড়ে শোনাতাম। যদি ব্যথা একটু কমে।

– শোনাতাম বলছো কেন? আজও তো সেখানে গিয়েছিলে। কবিতা শোনাওনি আজ?

– না।

– না, কারণ নরেন আর নেই।

– মানে? বলতে চাচ্ছো তিনি আজ মারা গেছেন?

– না। আজ নয়, দু বছর আগে। দু বছর আগে সে মারা গেছে। তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে এক মাস।

– কিন্তু আজ যে গেলে?

– না, আজ কোথাও যাইনি।

– আমি নিজে দেখেছি।

– না দেখোনি। অন্য কেউ। চোখের ভুল।

– সত্য বলছো?

– এর থেকে সত্য আমার জীবনে আর নেই।

– দু বছর আগে। ওকে, কোনো সমস্যা নেই। আমার হয়তো ভুল হয়েছে। দু বছর আগের কোনো সম্পর্ক নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। এসো এসব ভুলে যাই। বাব্বাহ! কী জঘন্য একটি দিন গেছে আমার! ভাবতে পারছি না এরম ভুল আমার কীভাবে হলো! যাকগে যা হবার হয়ে গেছে। এসো ভুলে যাই সব।

– কিন্তু আমার যে সমস্যা আছে অভি। আমি যে আজকের দিনটি ভুলে যেতে পারবো না। ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

– কী বলছো শিলু? ভুল তো সবারই হতে পারে! পারে না?

– পারে অভি খুব পারে। শিলু ভেতরে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসে। দরোজার দিকে এগোয়।

– শিলু কোথায় যাচ্ছো?

– জানি না। তবে এখান থেকে।

– আমি বলেছি, আমার ভুল হয়েছে। আমার আর কোনো সমস্যা হবে না।

– কিন্তু আমার যে হবে অভি। নরেন ছিল একান্ত আমার। খুব যত্নে, নিভৃতে ওকে আমি কেবল আমার ভেতরে রেখেছিলাম। গত দুবছর আমি নরেনের নাম উচ্চারণ করিনি। মৃত্যুর শেষ দিনগুলোতে আমি কেবল ওর সাথে ছিলাম। সে বড় কষ্টের সময়। নরেন জানতো কোনভাবেই আমি ওকে ফেরাতে পারবো না।
ও বড় বাঁচতে চাইতো। বলতো, শিলু বাঁচতে বড় ইচ্ছে করে। তোমাকে ছেড়ে যাওয়া বড় কষ্টের। তবু চিতায় তাকে জ্বালিয়ে কলের জলে মুখ ধুয়ে বাড়ি ফিরে ভেবেছিলাম, এ জীবনে নরেন কেবল আমার থাকবে। চিরকাল। পৃথিবীর কারও জানার দরকার নেই সে কথা। কিন্তু আজ তুমি তোমার পৌরুষত্বের জোরে টেনে হিঁচড়ে জোর দেখিয়ে নরেনকে আমার ভেতর থেকে বড় অসম্মানের সাথে বের করে আনলে। এইটুকুন ছিল কেবল আমার। কেবল আমার। সেই একান্ত আপনার আড়ালটুকুন তুমি আজ বড় কদর্যতায় গায়ের জোরে খোলা করে দিলে। ওখানে আমি আজ বড় নগ্ন। আমার ভেতরটার সেখানটায় তুমি চাবুক মেরে বুকের উপর পাড়া দিয়ে থেঁৎলে দিলে।

– কিন্তু আমরা স্বামী-স্ত্রী। আমাদের ভেতর কোনো গোপনীয়তা থাকা কি উচিত? কী অন্যায় হয়েছে তুমি তোমার গোপনীয়তা বলে দিয়ে? আর তা ছাড়া সে তো কবে চুকে বুকে গিয়েছে। সে বেঁচেও নেই।

-তাই অভি? স্বামী-স্ত্রী হলেই কারও কোন আপন একান্ত নিজস্ব কিছু থাকতে নেই? আর নরেন মরে গেছে সেটাই সমস্যা মুক্তি? যদি নরেন না মরে যেতো? যদি কোনো কারণে নরেন আর আমার বিয়ে না হয়ে তোমার সাথেই হতো? নরেন যদি আমার জীবনের কেউ হয়ে থাকতো? সেটি কি এতোই অসম্ভব কিছু? সেটা কি অপরাধ?

-তাহলে আমি?

-তুমি আমার বন্ধু জীবনসঙ্গী। তোমাকে তো আমি কোন অসম্মান করিনি। আমার সবকিছু দিতে বাকি রাখিনি। আমি তোমার সাথে বিবাহের সিদ্ধান্ত তো তোমাকে ঠকানোর জন্য করিনি। আমি স্বেচ্ছায় তোমার সাথে সারা জীবন সততা ও সুন্দরতায় তোমার সাথে কাটাবো সে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু সেজন্য আমার জীবনের কোন অধ্যায় কেবল আমার থাকতে পারবে না সেটি কি আমি কোথাও দস্তখৎ দিয়েছি? আমি তোমাকে ভালবাসি এবং আমি আমার আমাকে আমার আত্মমর্যাদা স্বকীয়তার বিনিময়ে নয়। বিদায় অভি।

শিলু শান্ত এবং আত্মমর্যাদায় ধীরে ধীরে দরোজা খুলে বেরিয়ে যায়। সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যতে থাকে। অভি মাথা নিচু করে বসে থাকে।

শেয়ার করুন: