রাজিয়াদের হেরে যাওয়া দেখছি…

লাবণী মণ্ডল:

একটা নিউজ চোখে পড়লো। আমি মোটেও আঁতকে উঠিনি, চিৎকারও করিনি। স্ত্রীর মুখ দাহ্য পদার্থে ঝলসে দিয়েছে স্বামী নামের এক কাপুরুষ, বর্বর, জানোয়ার। স্ত্রীর দোষটি শুনবেন না! পুরুষ সমাজ তো আবার আমাকে খাবলে ধরবেন। বলা শুরু করবেন, ‘আপনার চোখে এসবই পড়ে শুধু? নিশ্চয়ই ওই স্ত্রীর কোনো দোষ আছে। মনে হয় পরকীয়ায় জড়িত ছিল।’ কিন্তু ঘটনা কিন্তু তা নয়। ঘটনা হচ্ছে- বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে চেয়েছিলেন রাজিয়া নামের মেয়েটি। জানলেন তো কী তার অপরাধ ছিল?

বুধবার ভোর রাতে এ ঘটনাটি ঘটে যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার কাশিপুর গ্রামে। স্বামীর নামটিও একটু শুনে রাখেন- কামরুজ্জামান। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ঘুমিয়ে ছিলেন। হয়তো সে রাতে কত মধুর বাণীও শুনেছেন স্বামী নামের ওই লোকটির কাছে। কত সুখ, আহ্লাদের কথাও শুনেছেন। ভোর রাতে অ্যাসিড ছুঁড়ে পালিয়ে যায়। রাজিয়া চিৎকারে প্রকম্পিত করে তোলে পুরো বাড়ি। স্বজনরা এসে দেখেন, তার মুখ ঝলসে গেছে।

কেন করেছে, তা শুনবেন না? বলছি। রাজিয়া নামের ওই মেয়েটি এমএ পাস করেছেন। সামনে বিসিএস দিবেন। বড় স্বপ্ন। বোকা মেয়ে! নারীদের যে কোনো স্বপ্ন থাকতে নেই- তা দিব্যি ভুলে গেছে। যার ফলে অ্যাসিড মেরেছে। খুব ভালো করেছে- এই তো বলবেন! বিয়ের পর আবার কীসের পরীক্ষা! তার তো কাজ রান্নাবান্না, সন্তান জন্ম দেয়া, লালন-পালন করা, আর ওই পশুটির সেবাযত্ন করা। ঠিক না?

রাজিয়া বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন তার স্বামীকে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতো। তার স্বামী এসএসসি পাশ। তাতে কী! রাজিয়া নিজে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবেন। কিন্তু পুরুষ কি সেটা মেনে নিবে? সে হলো এসএসসি পাশ, আর বউ করবে বিসিএস! মানা যায়!

রাজিয়ার ইতোমধ্যে একটি সন্তানও হয়েছে। হয়তো সেই সন্তানটি নিয়েও রাজিয়ার কত স্বপ্ন। নিজে বিসিএস দিবেন। সন্তানটিকে বড় করবেন, অনেক বড়। কিন্তু স্বামী নামের পশুটি মেনে নিতে পারেনি- দমিয়েও রাখতে ব্যর্থ হয়ে অ্যাসিড মেরে বুঝিয়ে দিলো পুরুষের অবাধ্য হলে নারীর কী পরিণতি হতে পারে!

বুধবাবের ঘটনা। এ ক’দিন নিউজটি দেখিনি। এভাবেই কতো নারীর মৃত্যু ঘটনা চাপা পড়ে যায়। নারী কতোভাবে মরবেন! নারীর জন্মই কি আজন্ম পাপ! নারী সন্তান উৎপাদন করতে গিয়ে মরবে, অ্যাসিডে ঝলসে মারবে, পিটিয়ে মারবে, দোররা মেরে মারবে, বিষ খেয়ে মরবে, গলায় রশি দিয়ে মরবে- হায়রে নারী!

রাজিয়াকে মনিরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়, অবস্থার অবনতি দেখে প্রথমে যশোর জেনারেল হাসপাতালে এবং পরবর্তিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়েছে। বাংলাদেশে আরেকটি মেয়ে নাই হয়ে গেলেন- বিসিএস দেয়ার স্বপ্ন থাকার কারণে।

সামাজিক অবক্ষয় বলেন আর যাই বলেন না কেন- এর থেকে মুক্তির উপায় কী? ভোগবাদী, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী এভাবে আর কতদিন মরবে? ওই মেয়েটির কী দোষ ছিল? ও বিসিএস দেওয়ার স্বপ্ন প্রকাশ করতে পারে না? ওর ভিতরে কোনো স্বপ্ন থাকতে পারে না? ওর ইচ্ছে জাগতে পারে না এই পৃথিবীটাকে ছুঁয়ে দেখার। পৃথিবীর সকল সুখকে অনুভব করার!

আমি কি বিয়ে প্রথাকে ঘৃণা করবো? এখনই বন্ধ হোক বিয়ে! তাতে আর কী হবে! সমাজের প্রতিটি পুরুষের মনে যদি সুপ্ত আকাঙ্খা থাকে নারী মানেই তার ভোগ্যবস্তু, ব্যবহারিক পণ্য। স্পষ্টভাবে বলি, কারো আঁতে ঘা লাগলে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ব নেই, নারীকে দমিয়ে রাখতে চায় না- এমন পুরুষের সংখ্যা আজ একেবারেই জিরোতে পৌঁছে গেছে। এটা পুঁজিবাদী সিস্টেমের বড় পাওয়া। নারী যতদিন না এটা বুঝবেন ততদিন এর কুফল নারীকেই ভোগ করতে হবে।

সাময়িক স্বস্তি, সাময়িক ভালোবাসা, সাময়িক স্বাধীনতা- এসব পুঁজিবাদী সমাজে নারীকে দেয়। কেন দেয় জানেন? এই পুঁজিপতি পুরুষদের সুবিধার্থে। এই সাময়িক থেকে বের হয়ে আসা জন্য নারীমুক্তিটা জরুরি। সমাজতন্ত্র হবে। নারীদের মুক্তি হয়ে যাবে। এই আশাটা আজকাল আমার মোটেও বিশ্বাস হয় না। নারীদের মুক্তির জন্য নারীকেই লড়তে হবে। এইজন্য নারী সমাজের দায়িত্ব বেশি। তাদের একইসাথে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে লড়তে হয়, একইসাথে পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। কাজটা সহজ নয়। খুবই কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আজ আমরা এ পর্যন্ত। আরও বহুদূর হাঁটতে হবে। অর্থনৈতিকটা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি চিন্তার মুক্তিটা আরও বেশি জরুরি।

নারীকে বুঝতে হবে স্বামী, প্রেমিক, বন্ধু এগুলো নাম- মূলত তারা পুরুষ। এদেরকে ত্যাগ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। স্বামী হয়েছে বিধায় তার সবকিছু মেনে নিয়ে আজীবন তার সংসার করতে হবে, সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে, পরিবার, সমাজের দিকে চেয়ে- হাজার নির্যাতনের পরও ওই পুরুষের ঘর করতে হবে, এই চিন্তা শিকেয় তুলে রাখতে হবে। যেখানে ন্যূনতম শ্রদ্ধা নেই, সম্মান নেই, ভালোবাসা, ভালোলাগা নেই, সেখানে পড়ে থাকার অর্থ কী! কিসের প্রয়োজেন! মানসিকভাবে শান্তি না পেলে আমি কোনো থাকবো ওই বেড়াজালে? শারীরিক চাহিদা থাকে যখন মানসিক অশান্তি থাকে? যখন শ্রদ্ধা থাকে না?

রাজিয়াদের বুঝতে হবে এই সমাজের পুরুষরা তাদের ভালো চায় না। তারা তাদের যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই করতে দিবে। আর এই বোধ রাজিয়াদের ভিতর যতদিন না জন্মাবে ততদিন কতভাবে মরতে হবে- তা বলা মুশকিল! কেনো লিখছি, কী হবে, কার উদ্দেশ্যে, প্রয়োজন কী? জানি কিচ্ছু হবে না।

হয়তো আজকালের মধ্যেই খবর আসবে- ‘রাজিয়া আর নেই। স্বামীর এসিডেই প্রাণ গেল রাজিয়ার।’ তাতে কী হবে! এখন ওই অপরাধী স্বামীর বিচার চাইবো, গ্রেফতার করে ফাঁসিতে লটকিয়ে দিক- তা বলবো? আমি কিছুই বলতে পারছি না। আমি শুধু দেখতে পারছি, স্পষ্ট দেখতে পারছি- রাজিয়াদের হারিয়ে যাওয়া, রাজিয়াদের পরাজয়।

শেয়ার করুন: