প্রীতি – ইমতিয়াজের ফ্যান্টাসি ও কিছু কথা

রাহাত মুস্তাফিজ:

এ মাসের শুরুর দিকে কথা। অনেকদিন পরে জান্নাতুন নাঈম প্রীতির ফোন। জানালো একটা খুব সিরিয়াস ও কনফিডেনশিয়াল বিষয় শেয়ার করার আছে, আমার সময় আছে কিনা? আমি ধারণা করলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিশ্চয়ই হবে। খুব মনোযোগ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ওর কথা শুনলাম।

ব্যাপারটা ইমতিয়াজ মাহমুদের সাথে শুনে হালকা ধাক্কার মতো খেলাম। কারণ মানুষটাকে যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ ও যথেষ্ট বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম। প্রীতির কথা শেষ হলে আমি উপলব্ধি করলাম, মেয়েটি প্রতিশোধ স্পৃহায় ধ্বংসের প্রত্যয় নিয়ে আগুনের মতো জ্বলছে। ও আসলে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ব্যাপারটা প্রকাশ্যে আনবে। আমার মতামত ওর কাছে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব বহন করে না। তথাপি, আমাকে জানানোর কারণ একটাই -মতাদর্শের দিক দিয়ে ইমতিয়াজ মাহমুদ – আমি একই লাইনের। আমাদের মাঝে বিরোধের জায়গা খুব সামান্য। ও হয়তো ভেবেছিল, আমি ওর হাত-পা ধরে অনুরোধ করবো যেনো বিষয়টি প্রকাশ না করা হয়। তবে হ্যাঁ, আমি ওকে সময় নিতে বলেছিলাম, ভাবতে বলেছিলাম। হুট করে কিছু না করার জন্য বলেছিলাম। জানি না ও শেষ পর্যন্ত কোন গ্রুপের দ্বারা গাইডেড হয়েছে।

গত দুদিন ধরে অসংখ্য স্ট্যাটাস – কমেন্ট-রিপ্লাই পড়েছি। ভালো লাগছে এটা দেখে যে, একজন নারী, তায় আবার ‘সেলিব্রিটি’ বলে তাঁর যে কোনও কথা শিরোধার্য করে পুরুষের মুণ্ডুপাত করার মিশনে দু’একজন বাদে কেউ নামেনি। নারী, নারীবাদ ও এ সম্পর্কিত বিষয়ে আমাদের এতোদিনের ধারাবাহিক লেখালেখি একটা মোটামুটি ধারণা তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছে। এই ধারণা তৈরির মিশনে প্রীতি এবং অবশ্যই ইমতিয়াজ মাহমুদের লেখালেখির অবদান অনস্বীকার্য। আর তাই প্রীতির কথার ভেতরের অন্তঃসারশূন্যতা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না।
প্রীতি-ইমতিয়াজের রসায়নটা প্রেম ছিল, নাকি ফ্যান্টাসি?

প্রীতিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাদের সম্পর্কের বয়স কতো? বলেছে দেড় মাস। তখন আবার প্রশ্ন করেছিলাম, এই সম্পর্কের কী পরিণতি তুমি আশা করো? ও বলেছে, ‘আমি চাই সম্পর্কটা যেভাবে চলছে, সেভাবে চলুক।’
বিয়ে-টিয়ে জাতীয় কিছু ভাবছো না? ইমতিয়াজ মাহমুদ কি তোমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে পোষণ করেন?
নাহ, তেমন কিছু নয়। তাছাড়া সব সম্পর্ক কেনো বিয়ে পর্যন্ত টেনে নিতে হবে?
আসলেই তো তাই। এই কথার পর আর কোনও কথা থাকতে পারে না। এ থেকে থেকে বোঝা যায়, একটা চূড়ান্ত কমপ্লিকেটেড রিলেশন মেয়েটি কনটিনিউ করতে চেয়েছিল এবং তা নিজের মর্জিমাফিক।

প্রিয় পাঠক, বিষয়টিকে একটু অন্য এঙ্গেল থেকে পাঠ করি আসুন। আচ্ছা আমাদের কেনো মনে হচ্ছে না, ওঁদের এন্ডিংটা অন্যভাবেও হতে পারতো। যেমন হুমায়ূন আহমেদ- শাওনের ক্ষেত্রে হয়েছিল। অর্থাৎ প্রীতি-ইমতিয়াজের প্রেমের(?) ক্ষেত্রে হুমায়ূন-শাওন কাপলের মতো পরিণতিও হতে পারতো। হতে পারতো, যদি তাঁদের মধ্যে পরিণতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতো। আবার নাও হতে পারতো, আসলে পুরো ব্যাপারটা ছিল একটা ফ্যান্টাসি। দুজনই ওই ফ্যান্টাসিতে মজে ছিল। পরে একজনের ফ্যান্টাসি শেষ হয়েছে আরেকজনের শেষ হয়নি বা তাঁর অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল।
কিন্তু মানুষ দিনের পর দিন ফ্যান্টিসিতে থাকতে পারে না। তাঁকে বাস্তব জগতে বাস করতে হয়। ওই ফ্যান্টাসি ইমতিয়াজ মাহমুদের আগে প্রীতিরও কেটে যেতে পারতো। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, ওঁদের মধ্যে কোনও রকমের কমিটমেন্টই ছিল না।

প্রীতিকে আমি বারবার করে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছি, তোমাদের রিলেশন যে পরিণতিতে এসে ঠেকেছে, সত্যি করে বলো তো তাই কি হওয়ার কথা ছিল না? ও তখন স্বীকার করেছে, ‘হ্যাঁ, এরকমই হওয়ার কথা। কিন্তু আমি মানতে পারছি না।’ ওঁদের রিলেশনকে প্রেমের সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না কোনও মতে। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলতে হয়, এ হচ্ছে ‘মাংসের জন্য মাংসের নীল ক্ষুধা’। এই ক্ষুধা বা পিপাসা নিবৃত্ত করতে প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা কিংবা কাজী-পুরোহিতের দরকার পড়ে না।

প্রীতি যখন বারবার প্রতারণার কথা উল্লেখ করছিল, তখন আমার বিশেষভাবে জানবার ছিল, ইমতিয়াজ মাহমুদ মেয়েটিকে কোনো মিথ্যে বা ছলনাপূর্ণ বা প্রবঞ্চনাপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কি না! নাহ, তেমন কিছু সে আমাকে বলেনি কিংবা তাঁর একাধিক ফেসবুক পোস্ট থেকেও তেমন কিছুর আলামত পাইনি। জনাব ইমতিয়াজের তরফ থেকে যেটা হয়েছে, একটা পর্যায়ে এসে তিনি রিলেশনটার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আগেই বলেছি এই টাইপের সম্পর্কের ভাঙ্গন প্রীতির দ্বারাও হতে পারতো। সুতরাং তাঁদের সম্পর্ককে প্রেমের ফ্রেমে আবদ্ধ করা যাচ্ছে না এবং একে প্রতারণার ছকেও ফেলতে পারছি না – না আইনত, না ধর্মমতো, না সমাজ স্বীকৃত মতে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রীতির সাথে কৃত বিষয়টি নাহয় প্রতারণা ছিল না, কিন্তু ইমতিয়াজ মাহমুদ কি তাঁর স্ত্রী-সন্তান-পরিবারের সাথেও প্রতারণা করেননি?

এই প্রশ্নের উত্তর ‘না’। তিনি প্রতারণা করেননি। তিনি পরিবারের কাছে নিজেকে অবিশ্বস্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন মাত্র। এক পতি-পত্নী সম্পর্কের গোড়া পত্তন হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কের পায়ে মানুষ শেকল পরিয়েছে। যা এখন পরিবার নামে আধুনিক সভ্যতার অচ্ছেদ্য বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও পুরুষ কখনোই যৌনতা নিয়ন্ত্রণ করেনি। এক নারীতে তৃপ্ত থাকেনি। সন্তুষ্ট থাকার প্রয়োজন বোধই করেনি।

ওই নিয়ন্ত্রণ নারীর ক্ষেত্রে বরাদ্দ হয়েছে। এখনো অধিকাংশ দেশে ওই নিয়মই বহাল আছে। যাহোক, বিয়ে, পরিবার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মূল দাবি বা প্রত্যাশা হচ্ছে ‘ বিশ্বস্ততা ’। স্বামী-স্ত্রী ধর্ম ও আইন অনুসারে একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস্ত থাকার প্রতিশ্রুতি মেনে নিয়েই বিধিবদ্ধ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। এবং অনুমান করে নেওয়া হয় যে, আইনত এই সম্পর্কে থাকাকালীন কেউ অন্য কারও সাথে কোনও রকমের বিবাহ বহির্ভূত প্রতিশ্রুতিপূর্ণ সম্পর্কে জড়াবে না। ভিন্ন নারী বা পুরুষের সাথে যৌনতা উপভোগ করবে না। ওদিকে প্রিয় সন্তানরাও তাঁদের প্রিয়তম পিতাকে তাঁদের মায়ের একমাত্র প্রেমিক হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত এবং সেটাই সারাজীবন কামনা করে থাকে। ভাইস ভার্সাও।

বলা বাহুল্য, জনাব ইমতিয়াজ মাহমুদ বিশ্বস্ততা ভঙ্গ করেছেন। তাঁর এহেন ঘটনায় নিশ্চয়ই স্ত্রী-কন্যাগণ অখুশী হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন। একইসাথে তাঁর অগণিত বন্ধু, পাঠক, শুভাকাঙ্ক্ষী বিব্রত হয়েছেন। তিনি বিবাহিত বলে এ জীবনে আর কোনও নারীর প্রতি ভালো লাগা থাকতে পারবে না, কাউকে ভালবাসতে পারবেন না, কাউকে প্রেম নিবেদন করতে পারবেন না, কারও সাথে যৌনতা করতে পারবেন না, তা বলছি না। সবই পারবেন, তবে ওই যে বললাম, ডিসিপ্লিন মেনেই সেটা করতে হবে। বৈবাহিক সম্পর্কটার ধরনই এমন। যদিও উন্নত পুঁজিবাদী বিশ্বে ‘ওপেন রিলেশনশিপ’ নামে একটা ব্যাপার ডেভেলপ করছে বলে শুনেছি। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্পর্কে থাকার পরেও প্রেম ও যৌনতায় বৈচিত্র্য আনার প্রয়োজনে কাপলগণ ভিন্ন সঙ্গী খুঁজে নিচ্ছে। একেই সম্ভবত বাঙলায় ‘স্বকীয়া’ বলা হচ্ছে। অর্থাৎ পরস্পরের সম্মতিতে কেবল যৌনতা ফুলফিল করতে ভিন্ন গমন হচ্ছে। ইমতিয়াজ-জেনিফা দম্পতির ভেতরে এরকম কোনও কমিটমেন্ট আছে বলে জানা নেই।

ঘটনা যাই হোক, জীবনের ছোট্ট একটা অধ্যায় দিয়ে পুরো মানুষটাকে বিচার করে ফেলাটা অন্যায়। এই লেখাটি আমি প্রীতি বা ইমতিয়াজ মাহমুদের বিচার করার জন্য লিখতে বসিনি। তাঁরা আমার কাছের পরিচিত মানুষ বলেই মনের ভেতর জমে থাকা কথাগুলো এখানে লিখছি।

প্রীতি-ইমতিয়াজের ঘটনাটিকে অনেকেই মনে করছেন এটা প্রীতির ‘স্ট্যান্টবাজি’। আসন্ন বইমেলাকে উপলক্ষ্য করে একটা হৈ চৈ দরকার ছিল নিজের বই প্রমোশনের জন্য। এজন্যই নাকি সে পরিকল্পনা করে এরকম একটা মুখরোচক কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। রেফারেন্স হিসেবে নিন্দুকেরা জাবি’তে তাঁকে র‍্যাগ দেওয়ার মিথ্যে কাহিনী ফেঁদে আলোচনায় থাকতে চাওয়ার উদগ্র বাসনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

আমি বিশ্বাস করতে চাই না, সদ্য টিনএজ পেরিয়ে আসা একজন বিশ-একুশ বছরের তরুণী এমন চাতুর্য্যের আশ্রয় নিতে পারে। আমি এও বিশ্বাস করতে চাই না, নিজের সৃজনী ক্ষমতার প্রতি তাঁর আস্থা নেই, এবং সে সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে বুঁদ হয়ে আছে! আমি বিশ্বাস করি সে তার প্রতিভার স্বাক্ষর কালের খাতায় লিখে রেখে যেতে পারবে। এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যুক্তিসংগত উপায়ে খণ্ডাবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই অনেকভাবে তথাকথিত জনপ্রিয় সেলিব্রিটি হয়ে নিজেকে অনেক বড় কিছু ভাবা শুরু করেছে, কিন্ত আদতে ওটা আখেরে কোনও কাজেই দেবে না। আমরা একজন আরেকজনের বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান-গরিমার দৌড় কতদূর, তা জানি। অন্তত এতোদিনে ধারণা করতে পারি। সুতরাং অন্যের বিবেচনাবোধকে আন্ডার এস্টিমেট করে, বা তাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে নিজের মত জোর করে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না।

পরিশেষে বলতে চাই, স্ক্রিনশট ফাঁস করে দেওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। এক্ষেত্রে অন্যকে সতর্ক করে দেওয়ার ‘মহান’ দায়িত্ব পালনের অজুহাত ধোপে টেকে না। একান্ত ব্যক্তিগত ঘটনা বা দুঃখ বেদনাকে পুঁজি করে আলোচনায় থাকতে চাওয়ার বাসনা অত্যন্ত নিম্নমানের। এটা আন ইথিক্যাল। এটা ব্রিচ অব ট্রাস্ট। আশা করি প্রীতি বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।

আইনজীবী, লেখক

শেয়ার করুন: