নারীবাদ এবং আমাদের ভ্রান্তিবিলাস

রাব্বী আহমেদ:

‘নারীবাদ’ এর সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে কৈশোরের প্রারম্ভে যখন আমাদের আড্ডার সবচেয়ে মুখরোচক প্রসঙ্গ ছিলো ‘নারী’। বয়োঃসন্ধির শুরুতে যখন নারীর প্রতি স্বভাবসুলভ প্রাকৃতিক আকর্ষণগুলো মনের মাঝে দানা বাধা শুরু করছে কেবল তখন নারীকে কেবলই দুর্গম রহস্যে ঘেরা কোন দ্বীপ মনে হতো। এর কারণ অবশ্য ছিলো।
লেখাপড়ার সূত্রে কৈশোর কাটাতে হয়েছে নারী বিবর্জিত এক মিলিটারি বোর্ডিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, আমরা যাকে ক্যাডেট কলেজ বলে জানি। আবাসিক এ অঙ্গনে নারীদের শারীরিক অনুপুস্থিতিই ছিলো নারী নিয়ে ভাবনার মূল কারণ। ফলে নারী নিয়ে স্বভাবসুলভ আগ্রহ আমাদের ছিল বৈকি!

আমরা যারা সাহিত্য ভালোবাসতাম, রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র কিংবা বঙ্কিমের নারীরা তাদের ভাবনার পুরোটা অঞ্চল জুড়ে ছিলো। কিন্তু তবুও অনুভব করতাম আমাদের আড্ডাগুলোতে নারীকে নায়িকা নয়, বরং কেমন খলনায়িকা রূপেই উপস্থাপন করা হতো। ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’ শব্দের সাথে যদিও তখন পরিচয় ঘটেনি তবে চিন্তা ও চেতনার বিবিধ নির্মাণ এবং বিনির্মাণের ভেতর দিয়ে গিয়ে আজ এতোকাল পর এসে মনে হচ্ছে সেসব আড্ডাগুলো কতোই না পুরুষতান্ত্রিকতায় জর্জরিত ছিলো। যা ভাবলে আজও ব্যথিত হই, লজ্জা অনুভব করি।

আমাদের মধ্যে কারও অকিঞ্চিৎকর প্রেম ভেঙে গেলেও আমরা নারীকেই দোষারোপ করতাম আর ভাবতাম, বেগম রোকেয়ার কারণেই হয়তো বা নারীরা পুরুষের চেয়ে অধিক সুবিধা পায় সমাজ থেকে। নারীদের ‘নষ্ট’ করার কারণে এই মহীয়সীকেও কম গালি শুনতে হয়নি আমাদের কাছে। নারী দিবস থাকলেও পুরুষ দিবস কেন নেই? কিংবা নারীবাদ থাকলেও পুরুষবাদ নেই কেন এমন সব চিন্তা-অপচিন্তায় কাটতো আমাদের কৈশোরের একেকটি দিন।

নারীবাদ সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক ধারণা এই পর্যন্ত থাকলেও পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নৃবিজ্ঞান পড়তে এসে নারীবাদকে আরেকটু বিস্তৃতভাবে জানার সুযোগ ঘটে। ফলে নারীবাদ নিয়ে গৎবাঁধা বিবিধ মামুলি চিন্তা-ভাবনা ক্রমাগত দূর হতে থাকে। কিন্তু অনুভব করি আমাদের সমাজের বেশ বড় একটা অংশের চিন্তা ভাবনা এখনও সে-ই প্রাথমিক স্তরেই রয়ে গেছে। আর তাই ‘নারীবাদ’ সম্পর্কে কোন সম্যক ধারণা না রেখেই এই শব্দ শোনা মাত্র আমাদের গাত্রদাহ হয়। একজন পুরুষ তো বটেই একজন নারীও নারীবাদে বিপন্নতা বোধ করে। নারী হয়েও তাই একজন নারী নিজেকে নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে কোথাও কুন্ঠা বোধ করে কিংবা লজ্জিতও হয়।

আবার একজন পুরুষ যদি নিজেকে নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দেয় তবে তাকেও তার স্বজাতিকূলের কাছেই শুনতে হয় বিস্তর উপহাস। এর নেপথ্যের কারণ অবশ্য নারীবাদ নিয়ে আমাদের ভেতরে বেড়ে ওঠা অগণন ভ্রান্ত ধারণা। আরেকটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে, নারীবাদ সম্পর্কে না জেনেই আমাদের ভেতরে নারীবাদ নিয়ে হুট করে সমালোচনা করার প্রবণতাও এর কারণ। ফলে, সমাজে নারীবাদ নিয়ে যে ভ্রান্ত ধারণাগুলো রয়েছে তাও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা দ্বারা প্রভাবিত এবং নির্মিত হয়ে আছে দীর্ঘকাল ধরে।

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীবাদ নিয়ে বিস্তর পঠন-পাঠন হয়েছে, হচ্ছে। অনেকের কাছেই হয়তো মনে হয়, নারীবাদ মানে হচ্ছে নিজের ঋতুস্রাবের কথা জানান দেয়া, নিজেকে অতি আধুনিক নারী হিসেবে উপস্থাপন করা, কিংবা পুরুষের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করা। আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে, এসব ধারণার অন্তরালে নারীবাদের মতো ‘মহান’ একটি আন্দোলন ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে তার জৌলুস। মানুষের মনে নারীবাদ সম্পর্কে জন্ম নিচ্ছে নেতিবাচক চিন্তা এবং ভ্রান্ত ধারণা।

সাম্প্রতিক সময়ে কিভাবে নারীবাদ পৃথিবী পাল্টে ফেলছে, কিংবা পাল্টে ফেলার আশা করছে এসবই নারীবাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। কেউ মানুক বা না-ই মানুক এই বিপ্লবের অংশ আমরা প্রত্যেকেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, অধিকাংশ মানুষ যারা নারীবাদ নিয়ে আলোচনা করে থাকে তারা জানেই না নারীবাদ আদৌ কী? কী নারীবাদ? এবং কী নারীবাদ নয়? এই বিষয় নিয়ে এখন ভাবা তাই জরুরি।

কীভাবে একটি প্রগতিশীল ধারণা দেশের সবচেয়ে ঘৃণাত্মক শব্দে পরিণত হয়েছে, তাও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করি। এ কথা আমাদের হয়তো অজানা নয় যে, নারীবাদের মূল সুর হচ্ছে নারী এবং পুরুষের অভিন্নতা। অর্থাৎ, নারী এবং পুরুষ সমান তাদের অধিকারে নেই কোন ভিন্নতা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, নারী ও পুরুষের অসাম্যের ধারণা আমরা প্রতিটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজেই দেখে থাকি।

নারীবাদের মূল লড়াই এই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে যারা নারীকে নির্মাণ করে। যেকোন সমাজে নারীর অবস্থান কোথায় হবে তা নির্ধারণ করে দেয় পুরুষতন্ত্র। নারীবাদ নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা এবং সাম্যের জন্য লড়াই করে। ‘নারীবাদ’ চায় সুদীর্ঘকাল ধরে চর্চিত পিতৃতান্ত্রিকতার ঘেরাটোপ থেকে নারীকে মুক্ত করে বৃহৎ পরিসরে নিয়ে আসতে। ‘সেক্স’ বায়োলজিকালি নির্ধারিত হলেও ‘জেন্ডার’ নির্ধারণ হয় সামজিকীকরণ এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে। জেন্ডারের ভিত্তিতে সমাজে নারীর ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয়ার বিরুদ্ধেও নারীবাদের লড়াই। ‘জেন্ডার’ নয় নারীকে মূল্যায়িত করতে হবে তার যোগ্যতার ভিত্তিতে এবং নারী ও পুরুষকে ভাবতে হবে সমান, নারীবাদের মূল আলোচ্য বিষয় এটাই।

কিন্তু কাল্ক্রমে এই মূল জায়গা থেকে ছিটকে এসে ‘নারীবাদ’কে ঘিরে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা। নারীবাদ সম্পর্কে সেসব ভ্রান্ত ধারণাগুলো জানা প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন মিথ্যে নারীবাদীদের বিরুদ্ধেও লড়াই করা যারা নারীবাদের নামে বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে এবং যারা নারীবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ও নারীবাদ দ্বারা এক ধরণের হুমকি অনুভব করে।

নারীবাদ মানেই কি পুরুষের প্রতি ঘৃণা?
নারীবাদ মানেই পুরুষদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন নয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীবাদকে পুরুষ বিদ্বেষ হিসেবে উপস্থাপন করে এক প্রকার ভ্রান্ত ধারণা দেয়া হয়। পূর্বেই আমরা জেনেছি সংজ্ঞাগত দিক থেকে নারীবাদ হচ্ছে লিঙ্গ নির্বিশেষে নারীর স্বাধীনতা এবং নারী ও পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করা। নারীবাদ সমাজে নারীকে উপরে এবং পুরুষকে নিচে নয় বরং নারী পুরুষ উভয়কেই সমান স্থান দেয়ার কথা বলে। নারীবাদীরা তাঁদের সমঅধিকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কখনোই পুরুষের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে না। লিঙ্গের ভিত্তিতে নারীবাদীরা পুরুষদের সেক্সিস্টও ভাবে না। শুধুমাত্র তারা পুরুষতান্ত্রিকতাকে অগ্রাহ্য করে এবং পুরুষেরা নারীর চেয়ে উচ্চতর এই সামাজিক ধারণার বিরোধিতা করে। যে নারীবাদী একজন পুরুষকে শুধুমাত্র একজন পুরুষ হবার জন্য ঘৃণা করে সে আদতে নারীবাদীই নয়। আর তাই নারীবাদের ঘৃণা ও লড়াই ‘পুরুষ’ এর বিরুদ্ধে নয় বরং পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে।

শুধুমাত্র নারীরাই কি নারীবাদী হতে পারবে?
নারীবাদ সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণার আরেকটি হচ্ছে শুধু মাত্র নারীরাই নারীবাদী হতে পারবে। যেমন, একজন মানুষের পশুপাখিদের অধিকারকে সমর্থন করার জন্য পশুপাখি হওয়া জরুরী নয় তেমনি নারীর অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামকে সমর্থন দিতেও কারো নারী হবার প্রয়োজন নেই। তাই নারীর সমাধিকার আন্দোলনকে সমর্থন দেয়ার জন্য কাউকে নারী হবার প্রয়োজন নেই। একজন পুরুষও ইচ্ছে হলে নারীবাদী হতে পারে এবং আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে পৃথিবীতে এমন অনেক পুরুষ রয়েছে যারা নারীবাদী ছিলেন।

নারীর সম অধিকার প্রত্যাশিত যে কেউই নারীবাদী, হোক সে পুরুষ কিংবা নারী। অর্থাৎ, যদি কেউ মনে করে সমাজে বিরাজমান নারী পুরুষের বিভেদ ঘোচানো উচিৎ, পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ, শুধুমাত্র লিঙ্গের কারণে নারীকে পুরুষের অধস্তন ভাবা বন্ধ করা উচিৎ এবং পুরুষতান্ত্রিকতাকে উচ্চতর আসনে বসানো বন্ধ করা উচিৎ তবেই সে একজন নারীবাদী। এতে অবশ্য দোষের কিছু নেই বরং তা গৌরবের। নারী ও পুরুষের সমান অধিকার চাওয়া যেকোন মানবিক মানুষেরই কর্তব্য।

নারীবাদীরা সবসময় কি শুধু নারীকেই প্রাধান্য দেয়?
নারীবাদীরা সব নারীকেই সমান প্রাধান্য দেয় না। সমর্থনও নয়। নারীবাদীদের সংগ্রাম তাদের বিরুদ্ধেই যারা যে কোন আঙ্গিকে পুরুষতন্ত্রকে সমর্থন করে এবং তা প্রয়োগ করে। এক্ষেত্রে একজন নারীও যদি পুরুষতান্ত্রিকতার ধারক এবং বাহক হয়, নারীবাদীদের প্রতিবাদ তার বিরুদ্ধেও। যেকোন জাতিকে পুরুষতান্ত্রিকতায় গ্রাস করার পেছনে নারীর ভূমিকাও অনেক। প্রতিটি পুরুষই যেমন পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার ধারক ও বাহক নয় তেমনি প্রতিটি নারীই নারীর সম অধিকার নিয়ে সমান ধারণা পোষণ করে না। ভিন্নতা থাকবেই।

অনেক নারীই প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা পোষণ করে যে, নারীদের জন্মই হয়েছে পুরুষের সেবা করার জন্য। ঘরকন্না করার জন্য। এবং জন্মগত ভাবেই নারীরা পুরুষের চেয়ে নিম্নতর এবং নারী পুরুষ কখনোই সমান হতে পারে না। নারীবাদ এই মানসিকতাই নির্মূল করতে চায়। তাই, এক্ষেত্রে কেউ পুরুষ না নারী এই বিষয়টি বিবেচ্য নয়। সত্যিকারের নারীবাদীরা একদিকে যেমন নারীতান্ত্রিকতার সমর্থনকারীকে ঘৃণা করে তেমনই পুরুষতান্ত্রিকতার সমর্থকারীকেও একই পরিমাণ ঘৃণা করে। নারীবাদ যেমন ‘পুরুষতন্ত্র’ সমর্থন করে না একই ভাবে ‘নারীতন্ত্র’ও নয়।

নারীবাদ কি পুরুষের জন্য ক্ষতিকারক?
নারীবাদ নিয়ে কথা উঠলেই আমাদের ভেতরে এই ধারণা জন্মায় যে নারীবাদ শুধুই নারীর সুবিধাকে প্রাধান্য দেয়। এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পুরুষের অধিকার লঙ্ঘন করে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে, নারীবাদ কখনোই পুরুষকে আঘাত করে না বরং তা পুরুষকে সাহায্য করে। নারীবাদ শুনলেই অনেক পুরুষ আতঙ্কগ্রস্ত থাকে এবং নারীবাদের প্রভাবের কথা চিন্তা করে বিপন্নবোধ করে। যদিও নারীবাদের প্রাথমিক ধারণায় নারীর প্রতি সমান অধিকারের কথা বলা হয় তবুও নারীবাদ পুরুষের জন্যেও সমান কল্যাণকর। নারী এবং পুরুষের লিঙ্গের ভিত্তিতে কাজকে নির্ধারণ করার ধারণাকে নারীবাদ আঘাত করে।

রুটি-রুজি, পরিবারের ভরণ পোষণ, পরিবারের দায়িত্ব নেয়া শুধুমাত্র পুরুষের একার দায়িত্ব নয়। নারীরাও প্রথাগত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এসব ক্ষেত্রে পুরুষকে সমান ভাবে সাহায্য করতে পারে কিংবা তারাও পরিবারের উপার্জনকারী সদস্য হতে পারে নারীবাদ সে বিষয়ের দিকেই দৃষ্টিপাত করে। সমঅধিকারের কথা বলে নারীবাদ কখনোই চায় না পুরুষের ওপর সব ধরনের অর্থনৈতিক চাপ পড়ুক। ফলে নারীবাদ শুধু নারীর সমাধিকার নয় বরং পুরুষের সমাধিকারের কথাও বলে। এ প্রসঙ্গে ব্রিট্রিশ মানবধিকার কর্মী, হলিউডের অভিনেত্রী এমা ওয়াটসন তাঁর এক বক্তৃতায় বলেন, তথাকথিত পুরুষের সাফল্যের ধারণা সমাজে খুব বিকৃতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। আর এই সাফল্য অর্জনের জন্য আমাদের সমাজের পুরুষেরা অনেক ভঙ্গুর এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনযাপন করে। সমাধিকারের সুফল পুরুষ কখনো ভোগ করে না।

আবহমানকাল ধরে পুরুষেরাও লিঙ্গীয় ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে আছে, কিন্তু এ কথা আমরা কখনো বলি না। যখন পুরুষেরা তাদের এই বন্দীদশা থেকে মুক্ত হবে তখন স্বাভাবিকভাবেই নারীর অবস্থাও সমাজে পরিবর্তন হবে। পুরুষ যদি প্রচলিত ধারার মতো আক্রমণাত্মক না হয়, তবে নারীরাও বিনয়ী হতে বাধ্য হবে না। পুরুষের যদি নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতেই না হয়, তবে নারীরাও আর নিয়ন্ত্রিত হবে না। নারী এবং পুরুষ উভয়কেই সংবেদনশীল হওয়া জরুরী। আবার একই সাথে নারী এবং পুরুষ উভয়কেই শক্ত হওয়া প্রয়োজন।

নারী এবং পুরুষকে লিঙ্গগতভাবে দু’টি বিপরীত জায়গায় না দেখে একই জায়গায় দেখার এটাই সময়। আমরা যদি প্রত্যেকে কে কী নয়? এ কথা বলা বন্ধ করে কে কী? এ কথা বলা শুরু করি তবে নারী পুরুষ উভয়েই মুক্ত হতে পারবে। এটি সম্পূর্ণই স্বাধীনতার ব্যাপার। এমা মনে করেন, পুরুষেরা বংশ পরম্পরায় এই গুরুদায়িত্বটুকু পালন করুক এবং তাঁদের মেয়ে, বোন এবং মাকেও এই কুসংস্কার থেকে বের করে আনুক। একই সাথে তাদের পুত্ররাও মানবিক হয়ে উঠুক এবং যেখানে তাদের ঘাটতি রয়েছে সেখানে নিজেদের সংশোধন করে একজন সত্যিকারের পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠুক।
এমার কথার সূত্র ধরেই আমরা বলতে পারি, নারীবাদ যখন নারীর সমতার কথা বলে তখন তারা পুরুষের স্বাধীনতার কথাও বলে। নারীবাদ তাই পুরুষকে আঘাত নয় বরং সহযোগিতা করে।

নারীবাদ কি ক্ষমতা এবং মাতৃতান্ত্রিকতার জন্য লড়াই?

নারীবাদ নিয়ে বিবিধ ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে নারীবাদ ক্ষমতা এবং মাতৃতান্ত্রিকতার জন্য লড়াই। কিন্তু আদতে নারীবাদীরা আড়ালে এমন কোন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করছে না। নারীবাদীরা শুধুমাত্র একটি বিভেদহীন সমাজ চায়, যেখানে নারী এবং পুরুষের সমঅধিকার বাস্তবায়িত হবে। বিশ্বজুড়ে এমন মিথ চালু রয়েছে যে নারীবাদে পুরুষেরা নির্যাতিত হয় এবং পুরুষদের অধিকার ভূলন্ঠিত হয়। কিন্তু নারীবাদীরা যেমন চায় না পুরুষতান্ত্রিকতা থাকুক তেমনি মাতৃতান্ত্রিকতাকেও তারা অগ্রাহ্য করে। নারীবাদ তাই কোন ক্ষমতার লড়াই নয় বরং নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদায় নিয়ে আসা। এতে পুরুষের অধিকার হয় না বরং নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কোথাও যদি পুরুষের অধিকার লুন্ঠিত হয় নারীবাদ সেক্ষেত্রেও নির্মোহ ভূমিকা পালন করে।

নারীবাদীরা কি নারীবাদ সম্পর্কে প্রবল স্পর্শকাতর?

অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত রয়েছে যে নারীবাদীরা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত। ধর্মানুভূতি যেমন কিছু মানুষের মধ্যে প্রবল আকারে দেখা যায় তেমনি নারীবাদুনুভূতিও নারীবাদীদের মধ্যে প্রবল ভাবে দেখা যায়। নারীবাদীদের সম্পর্কে আরো অভিযোগ রয়েছে যে এরা সুযোগ পেলেই কারণ ছাড়া কোন ইস্যু নিয়ে মাতামাতি করে। অনেকেই আবার নারীবাদী বলতেই সোস্যাল একটিভিস্টদের ভেবে থাকে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। নারীবাদ নিয়েও তর্কবিতর্ক চলতে পারে তবে তা শিথিল ভাবে, ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়। কারণ, সত্যিকার অর্থে নারীর অধিকার নিয়ে যারা কাজ করে যাচ্ছে এবং বিগতদিনগুলোতে কাজ করে গিয়েছে তাদের সবাই নীরবেই কাজ করেছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেকে জাহির করে নয়। নারীবাদ বিতর্ককে সমর্থন করে। তারা তাদের অবস্থানে কট্টর নয়।

পুরুষ নারীবাদীরা কি পুরুষের বিরোধী?
পুরুষ নারীবাদীদের অনেক ক্ষেত্রেই অন্য পুরুষদের কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতক উপাধি পেতে হয়। তাঁরা ভাবতেই পারে না একজন পুরুষ কখনো নারীবাদী হতে পারে। ফলে পুরুষ নারীবাদীরা হাসি-তামাশা এবং টিটকারির পাত্র হয়ে ওঠে সমাজে। একটা বিষয় অবশ্যই বুঝতে হবে যে নারীবাদ কখনোই দু’টি লিঙ্গের যুদ্ধ নয়। কেউ যদি নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলে, তবে তাকে কখনোই পুরুষের অধিকারকে বঞ্চিত করতে হবে না। এই দু’টো বিষয়ের সাথে কোন যোগসাজশ নেই।

নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করতে গেলে কারো পুরুষ অস্তিত্বের ঘাটতিও পড়বে না। মানবতার খাতিরে যে কেউ নারীকে একজন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে পারে। এতে পুরুষ হিসেবে লজ্জা পাওয়ারও কিছু নেই। কোন লিঙ্গকে সাহায্য করতে গিয়ে অন্য কোন লিঙ্গের বিপরীতে দাঁড়াতে হবে বিষয়টি এমনও নয়। উপরন্তু পুরুষ নারীবাদীরা পুরুষের গতানুগতিক ধারাকেও ভাঙতে চায় এবং জীবনকে আরো সরল করতে চায়। তাঁরা চায়, পুরুষেরাও যেন তাদের নিজস্ব ঘেরাটোপে নিজেদের আটকে না রেখে বরং সহজ জীবন যাপন করে। পুরুষেরা যেন সংসারের দায়দায়িত্ব এবং নারীকে ভরণ পোষণ করার স্টেরিওটাইপ চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে ভারমুক্ত জীবন যাপন করতে পারে, নারীবাদ তা-ই চায়।

নারীবাদীরা কি পুরুষের মতো হতে চায়?
নারীবাদ নিয়ে বহুল চর্চিত ভ্রান্ত ধারণার একটি হচ্ছে নারীবাদীরা পুরুষের মতো হতে চায়। তারা তাদের চলন, কথা বলার ধরণ, আচার-আচরণ, পোশাক সবকিছুতেই পুরুষকে অনুকরণ করতে চায়। যেহেতু নারীবাদীরা নারীদের ওপর সমাজের দেয়া বিভিন্ন চাপ থেকে নারী জাতিকে মুক্তি দিতে চায় তাই অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয় যে যারা নারীবাদ চর্চা করে তাঁরা কখনোই মেয়েলি স্বভাবের হতে পারবে না। মেয়েলি স্বভাব বলতে বোঝানো হয় নারীর স্বভাবসুলভ আচরণ। যেমন একজন নারী ওড়না পরে। এই ওড়না পরার অভ্যাস তাঁর সমাজ এবং সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য।

কিন্তু নারীবাদ হলেই তাকে ওড়না পরা বাদ দিতে হবে বিষয়টি এমনও নয়। ওড়না, হিজাব, বোরকা তথা পোশাক কিংবা গতানুগতিক আচরণের সাথে নারীবাদের কোন সম্পর্ক নেই। আবারো মনে রাখা জরুরি যে, নারীবাদ নারী এবং পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলে। নারীরা কি পোশাক পরলো এ নিয়ে নারীবাদের বিশেষ কোন মাথাব্যথা নেই। সমাজে প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে, নারীবাদীরা পুরুষ হতে চায়। পুরুষের মতো পোশাক পড়তে চায় । সত্যিকার অর্থে নারীবাদের মৌলিক নীতিতে এমন কোন বিষয় নেই। ফলে জিন্স শার্ট পরেও কেউ নারীবাদ চর্চা করতে পারে আবার বোরকা-হিজাব পরেও কেউ নারীবাদ চর্চা করতে পারে। পোশাকের স্বাধীনতা নারীর নিজস্ব, শুধু পুরুষ আরোপ করে না দিলেই হয়।

নারীবাদীরা কি বিয়েতে বিশ্বাস করে না?

নারীবাদী সম্পর্কে আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণাগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীবাদীরা বিয়েতে বিশ্বাস করে না। এরা বহুগামী হয়। ফ্রি সেক্সে বিশ্বাস করে। কিন্তু নারীবাদীরা কখনোই বিয়ের বিরুদ্ধে নয়। তবে সমাজে বিদ্যমান অসম বিয়ের বিরুদ্ধে। অসম বিয়ে বলতে, যে বিয়েতে নারী এবং পুরুষ সমান লাভবান হয় না। যেকোন নারীর মতোই একজন নারীবাদী বিয়ে, ঘর সংসার করতে পারে। নারীবাদীরা পুরুষকে ঘৃণা করে, এমন বহুল প্রচলিত মিথকে মিথ্যে প্রমাণিত করে বলা যায় যে, নারীবাদ কখনোই বিয়ে করতে অনুৎসাহিত করে না কিংবা বিয়ের কাঠামোর বিরুদ্ধেও নয়। বরং কোথাও অসামঞ্জস্য বিয়ে হলে নারীবাদ এর প্রতিবাদ করে। এবং বিয়ের পর যদি একজন নারীকে পিতৃতান্ত্রিকতার শিকার হতে হয় তবে তার বিরুদ্ধে নারীবাদ অবস্থান করে। একজন নারীবাদ তাঁর পছন্দ মতো বিয়ে করতে পারে, সঙ্গী বাছাই করতে পারে কিন্তু তাঁরা চায় তাদের সঙ্গী কোন একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের প্রতি যেন পক্ষপাতদুষ্ট না হয়।

সকল নারীবাদীই কি ক্যারিয়ারভিত্তিক চিন্তা করে?

নারীবাদ নিয়ে আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে নারীবাদ চায় সকল নারীই অফিস করুক, কাজ করুক, পরিবারের অর্থের যোগানদাতা হোক। কিন্তু নারীবাদীরা ফ্রিডম অফ চয়েসে বিশ্বাস করে। জোর করে কোন কিছুই নারীবাদ চাপিয়ে দেয় না। কেউ যদি অফিস করতে চায় করবে। কেউ যদি মনে করে সে গৃহস্থলী কাজ করবে, তাও করবে। এটি সম্পূর্ণ একজন নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা। নারীবাদ কখনোই বলে না, যে নারী ঘরে কাজ করে, পরিবারের দেখাশোনা করে সে নির্যাতিত। সত্যিকারের নারীবাদীরা প্রতিটি নারীর প্রতিই সম্মানশীল। কে হিজাব পড়ে থাকলো আর কে বিকিনি পরলো, তাতে নারীবাদীদের কিছুই আসে যায় না।

নারীবাদীরা শুধুমাত্র এই কথাই বলে যে, একজন নারী কি করবে তা সম্পূর্ণ তাঁর ওপর ছেড়ে দেয়া উচিৎ। এবং তাকে তাই করতে দেয়া উচিৎ। কোন পুরুষ যদি ঘরে থাকতে চায়, ঘরের কাজ করতে চায় নারীবাদীদের তাতেও আপত্তি নেই। আবার নারীবাদে একজন নারী যদি বেছে নিতে পারে সে ঘর করবে নাকি অফিস করবে, একজন পুরুষ কেন পারবে না? নারী এবং পুরুষের বিনির্মিত ভূমিকাকে ভেঙে দেয়াই নারীবাদের লক্ষ্য।

মূলত নারীবাদীরা সমাজে অধিক সুবিধা নয় বরং সম অধিকার চায়। নারীবাদীরা সুবিধা এবং অধিকারের মধ্যে পার্থক্য বোঝে। নারী হয়ে জন্মানোর কারণে সমাজ থেকে তারা অধিক সুবিধাপ্রাপ্ত হোক তা কখনোই তারা চায় না। বরং সমাজে নারী এবং পুরুষের যে অসাম্য অবস্থা রয়েছে তা থেকে নারীকে মুক্ত করে পুরুষ এবং নারীকে সম অবস্থানে নিয়ে আসাই নারীবাদের মূল প্রতিপাদ্য। নারীরা পুরুষের সমান হতে চায় না বরং নিজের যোগ্যতা প্রমাণের মাধ্যমে পুরুষের সাথে সমান অধিকার ও সম্মান নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু চায়। একজন মানুষ হিসেবে এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কাজ করা আমাদের মানবিক দায়িত্ব।

(Ankush Bahuguna এর ‘Misconception About Feminism’ প্রবন্ধের আলোকে লেখা। ঈষৎ সম্পাদিত এবং পরিমার্জিত)

শেয়ার করুন: