প্রেমহীন সম্পর্কের চাইতে ব্রেকআপ ভালো

বৈশালী রহমান:

নব্বই দশকের বিখ্যাত সিনেমা “কুচ কুচ হোতা হ্যায়” মুভিতে শাহরুখ খানের একটা বিখ্যাত ডায়লগে আমরা তখনকার টিন এইজাররা বেশ গ্যাস খেয়ে গেছিলাম। ডায়লগটা ছিল অনেকটা এইরকম, মানুষ একবার বাঁচে, একবার মরে, প্রেমও একবার করে, বিয়াও একবার। যদিও মুভিতে এই ডায়লগ দেওয়ার পরেও শাহরুখ সেখানে নিজেই দুইবার প্রেমে পড়ে, দুইবার বিয়া করে। মাঝখান দিয়ে আইট্ঠা কলা খায় সালমান খান। কিন্তু এই মুভি এবং আরও কিছু ধুরমার্কা বাংলা, হিন্দি রোমান্টিক মুভি ও বাংলা উপন্যাস আমাদের মাথায় এইটা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে একবারের বেশি দুইবার প্রেমে পড়া হারাম, হারাম, হারাম! প্রেমের প্রস্তাবে একবার হ্যাঁ বলে ফেললে, একজনের প্রেমে পড়লে, পরবর্তীতে প্রেমপাত্র বা পাত্রীকে যতোই অসহ্য বোধ হোক না কেন, সেই প্রেম জান প্রাণ দিয়ে টিকিয়ে রাখাই লাগবে।

এই চিন্তাধারার পরিণতি কি খুব সুখকর হয় সবসময়? কয়েকটা ঘটনা একটু পর্যালোচনা করে দেখা যাক।

আমার এক বান্ধবী পড়েছিল এক ছায়াময়ের প্রেমে। ছায়াময় বলার কারণ হচ্ছে ছেলেটা ছিল বান্ধবীর ছায়ার মতো। বান্ধবী যেখানে, সেও ওখানে। অনেকটা ইংরেজি কিউ ইউ লেটারের মতো। বান্ধবী কলেজে যায়, সে পিছে পিছে। বান্ধবী নাচের ক্লাসে যায়, বান্দা সেইখানেও হাজির। বান্ধবী টিউশনে যায়, বান্দা বিনা পারিশ্রমিকে হাজিরা দেয়। শেষ পর্যন্ত বান্ধবী রাজি হয়ে গেল শুধুমাত্র ছেলের ধৈর্য দেখে। আহারে, এত যার ধৈর্য, সে না জানি কতো ভালোবাসে!

প্রেমে পড়ার পর বান্ধবী বুঝলো ছায়া কতো বিরক্তিকর হতে পারে। বান্ধবী তার বন্ধুবান্ধবদের সাথে কোথাও যেতে পারবে না, বাপ মায়ের সাথে যেতে পারবে না, কাজিনদের সাথে সময় কাটাতে পারবে না, ছায়া তখন কায়া ধারণ করে রীতিমতো পজেসিভ অবতারে পরিণত। তার অনুমতি ছাড়া নিজের বাপের সাথে বের হলেও “ওই মাগি” ছাড়া কথা বলে না। দুই চারবার চড় থাপ্পড়ও দিয়েছে। বান্ধবীরে বললাম, ওরে, পালিয়ে আয়। সে কয়, এইসব তো ভালোবাসা। আমি বললাম, ওরে ইহা ভালোবাসা নয়, প্যারানয়া। সে কয়, একজনকে ভালোবাসলাম, কিস করলাম, হাত ধরলাম, ছাড়ি কেমনে। রাগে দু:খে আমি এই বলিউডি প্রেমিকাকে ত্যাজ্যবন্ধু করলাম।

পরে শুনি, বিয়ে করেছে ওই ছেলেকেই, কিন্তু সুখে নাই। নাচ বন্ধ, পড়াশোনাও বিয়ের আগে যতোদূর করেছিল ততোদূর, দুইবেলা মাইর খায়, মাইর খেয়ে বাপের বাড়ি যায়, বজ্জাত বরটা (বর্বরও বলা যায়) গিয়ে হাতে পায়ে ধরলে আবার ফিরে আসে। তবু ডিভোর্স দেয় না। কেন? কারণ ওই মাথায় ঢুকে গেছে। পেয়ার একবার হোতা হ্যায় শাদি ভি। আগে তো তবু কিস পর্যন্ত ছিল। এখন তো কেইস আরো সিরিয়াস। একজনের সাথে শুয়ে ফেলেছে। এখন আরেকজনের সাথে শুলে “প্রেমের মহিমা” ক্ষুণ্ণ হবে না!

এক ছোটো ভাইয়ের প্রেম কাহিনি ছিল খুব বিখ্যাত। হাইস্কুল সুইটহার্ট। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই জানে তারা কাপল্। বাড়িতেও আপত্তি নেই। কিন্তু একটা সময় গিয়ে ছেলেটি দেখলো তার আর মেয়েটির সাথে মেন্টালিটি ম্যাচ হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, মেয়েটির তার মোবাইল, ইনবক্স ইত্যাদি ঘাঁটাঘাঁটি, মেয়ে বন্ধুদের নিয়ে সন্দেহ, নিজেদের কিছু ব্যক্তিগত কথাবার্তা অন্যদের বলে দেওয়া, এগুলো সে নিতেই পারছে না। মেয়েটির সাথে সারাজীবন কাটাতে হবে, এটা চিন্তা করলেই এখন তার আতঙ্ক হয়। আমি বললাম, “তো, ব্রেকআপ করছো না কেন?” সে বললো, “আপু, ব্রেকআপ করতে তো চাই, কিন্তু বন্ধুবান্ধব জাস্ট কথা শোনাতে শোনাতে মেরে ফেলবে। জনে জনে জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের যে প্রায় নয় বছরের সম্পর্ক!”

এই পিয়ার প্রেশারের কারণে কতো মানুষ যে প্রেমহীনভাবে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়! কারণ আমরা এত খচ্চর যে, একটা কাপল্ এর ব্রেকআপ হয়েছে বা তারা অন্য কারো প্রেমে পড়েছে এইটা শুনে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। “কী হলো, কিভাবে হলো, কার দোষ ছিল” এগুলো সবই আমাদের জানা লাগবে। শুধু তাই নয়, জেনে আবার ছিছিও করা লাগবে। “আল্লা, দুইদিন আগে অমুকের সাথে প্রেম করতো, এখন কেন ব্রেক আপ হইলো, এখন কেন তমুকের সাথে প্রেম করে! ছি ছি কী চরিত্রহীন” এইসব বলে একটা সম্পর্ক ছেড়ে আরেক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া মানুষজনের জীবন অতিষ্ঠ করে দিতে আমরা একটুও দ্বিধা করি না। আমাদের এইসব আচরণের কারণেই একটা মেয়ে প্রেমিকের হাতে চড় থাপ্পড় খেয়েও তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। তার অপরাধ, তাদের দীর্ঘ সময় প্রেম ছিল এবং সেই প্রেমের কথা লোকজন জেনে ফেলেছে।

এরকম বিশ্রী সমালোচনার শিকার হয়ে একবার পরিচিত এক মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল। তার দোষ হলো, সে একটি ছেলের প্রেমে পড়েছিল, তার সাথে শারীরিক সম্পর্কও হয়েছিল। পরবর্তীতে বিয়ের কথাবার্তা চলার সময় ছেলে কিছু শর্ত আরোপ করেছিল। যার মধ্যে ছিল বিয়ের পর “পশ্চিমা চালচলন” চলবে না। ছেলের বাপ মা হুজুর প্রকৃতির, তাঁরা হিজাবী মেয়ে পছন্দ করেন। অতএব, মেয়ে চাকরি করতে পারবে না, তারে বুরকা হিজাব পরতে হবে। শুধু তাই নয়, মেয়ের পরিবারকে ছেলের “খানদানের ইজ্জত” অনুযায়ী “উপহার” দিয়ে সম্মানিত করতে হবে।

মেয়ে তেজী ছিল। তার শক্ত একটা মেরুদণ্ড ছিল। সে এইসব ভগিচগি মেনে নেয়নি। ছেলেটিকে সে প্রত্যাখ্যান করে। ব্যস্, শুরু হয়ে যায় পারিবারিক চাপ। ছেলে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে কেঁদে-কেটে হয়ে যায় ট্র্যাজিক হিরো, মেয়ে হয়ে যায় ভিলেইন। এতো বছর প্রেম করার পর বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণে সবাই তার চরিত্রের দোষ দিল।

কেউ এটা বুঝতে চাইলো না, একটা উচ্ছ্বল, স্বাধীন, কেরিয়ারিস্ট মেয়ের পক্ষে কখনোই এইসব চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুনের মধ্যে সুখে থাকা সম্ভব না। কেউ এটা জানতে চাইলো না, “পশ্চিমা চালচলন” অপছন্দ করা ছেলেটি কেন নিজে টাইট জিন্স, টি শার্ট পরে ঘুরে। কেন সে নিজে মুখে দাড়ি রেখে টাকনুর ওপরে জোব্বা পরে ঘুরে না। সবাই বললো, ছেলে তো ভালোই, বউরে পর্দার ভেতর রাখতে চেয়ে কী অপরাধ করেছে! গাধার বাচ্চাদের মাথায় ঢুকলো না, মেয়েটা নিজস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছা, পছন্দ অপছন্দ ওয়ালা একটা পরিপূর্ণ মানুষ। সে কী পোশাক পরে চলবে এটা তার সিদ্ধান্ত। সে কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না যে কারো ইচ্ছা অনিচ্ছা অনুযায়ী তার পোশাক নিয়ন্ত্রিত হবে।

প্রেম একটা সদা চঞ্চল বস্তু। স্থির কিছু নয়। কাউকে একবার ভালো লেগেছিল বলে সারাজীবন ভালো লাগতে হবে, এমন নয়। সম্পর্কের মোড় যে কোনো সময় ঘুরে যেতে পারে। বহু বছর প্রেম করার পরও প্রেমিক বা প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা ফুরিয়ে যেতেই পারে। সেই স্থানে আসতে পারে অন্য কেউ। কাজেই ব্রেক আপ কোনো অপরাধ নয়। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ অসীম প্রেমও প্রথম প্রেমের মতোই সুন্দর। কাজেই আমরা ম্যাচিউরড্ হই, “প্রেম একবারই হয়” মার্কা সস্তা ফিলজফি থেকে আমরা বের হয়ে আসি।

কারণ এক সাথে দুই তিনটা সম্পর্ক নিয়ে জাগলিং করার চাইতে ব্রেকআপ করে নতুন সম্পর্কে জড়ানো অনেক অনেক বেশি সুস্থ।

শেয়ার করুন: