কানিজ আকলিমা সুলতানা:
সকাল থেকে তুষারঝড় হচ্ছে। শুরু হতে না হতেই চারদিক ধবল তুষার স্তরে ঢাকা পড়েছে। জানালার পাশে বসে প্রকৃতির অশান্ত রূপ দেখছি। প্রবল বাতাসে উড়ে উড়ে যাচ্ছে তুষারকণারা। আষাঢ়ের জোর বর্ষণে বাতাসে যেমন বৃষ্টির ছাঁট এসে ঢাকার বাসার জানালায় আছড়ে পড়ে, ফেয়ারমাউন্টের এই বাসার জানালায়ও সেটাই হচ্ছে। তফাৎ শুধু জলকণারা গড়িয়ে না পড়ে জানালায় কুচো বরফ হয়ে আটকে থাকছে।
সকাল দশটা এখন। প্রিয়ম বেঞ্জিকে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল। ঝড়বৃষ্টিতে আমরা আটকে থাকলেও কুকুরকে যে বাইরে নিয়ে যেতেই হয় । প্রবল শীতেও বাইরে হাঁটতে গেলে বেঞ্জি আনন্দে থাকে। এদিক ওদিক তাকায়। রাস্তায় মানুষ বা অন্য কুকুর দেখলে লেজ নাড়ে। কাঁপতে থাকে কিন্তু জমা তুষারে মুখ ডুবিয়ে আইসক্রীমের মত করে তুষার খায়।
বেঞ্জিকে নিয়ে ঘরে ফিরে তোয়ালে দিয়ে প্রিয়ম ওকে মুছে দিল। আমি প্রিয়মের মাথার দিকে তাকালাম। ওর মুখটাও ভেজা। আমার হাতে তোয়ালে দেখে প্রিয়ম হাসলো। বললো, ব্যাপার না মা! আমি মুছে নিব।
রাস্তার উল্টোদিকের বাসার বাইরে দু’জন নারী তুষার পরিস্কার করার কোদাল দিয়ে তাদের বাসার সিঁড়ি আর ফুটপাত থেকে জমে থাকা তুষার সরাচ্ছে। পায়ে তুষার বুট। নাকমুখ হাত সব ঢাকা, চোখে সানগ্লাস নিয়ে একনাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছে ওরা। আমি জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে পরোটা আর পেয়াজ কাঁচামরিচ কুঁচি দিয়ে ডিমের ঝাল অমলেট ভাজলাম। চা বানালাম। বেঞ্জির শুকনো খাবার ওর বাটিতে ঢেলে দিয়ে প্রিয়ম এসে টেবিলে বসল। গরম পরোটা আর ডিম ভাজা খেতে খেতে বলল, মজা, মা!
দু’টো মাত্র শব্দ! আমার জগতের চেনা শব্দ। কিন্তু এই দুই শব্দেই আষাঢ়ের বর্ষণ আর জানুয়ারির তুষারঝড় আমার ভিতরে একসাথে বইতে শুরু করলো। দেশে আমি প্রতিদিন রান্না করি। কত খাবার টেবিলে আনি, কত জনকে খাওয়াই! আর আমার অনিন্দ্য প্রিয়ম এই ভীনদেশে আমার রান্না কত সামান্য খাবারই অসামান্য করে খায়! ওরা বছরের পর বছর ধরে এই তুষার ঠেকিয়ে একা লেখাপড়ার যুদ্ধ করে, একা খাবার খায়, ক্লাস পরীক্ষা শেষে ঘরে ফিরে খাবার না খেয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে! আমি মাঝে মাঝে এইদেশে এসেছি। খুব অল্প সময়ের জন্য এলেও প্রতিদিন রেঁধেছি। খাবার টেবিলে প্রতিবারই একই শব্দ দু’জনের মুখ থেকে বেরিয়েছে, ‘মজা, মা’! প্রতিবারই আমার বুকটা দুলে উঠেছে, আজও তেমনি ধেয়ে আসা জল চোখের তারায় জানালার জমাট তুষারের মতো আটকে গেছে।
ওরা যখন এইদেশে আন্ডার গ্রেডে পড়তে আসতে চেয়েছিল তখন আমার মনের ভিতর ৬৫/৩৫ টেট্রন কাপড়ের মতো একটা অনুভূতি ছিল। না অথবা হ্যাঁ, হ্যাঁ অথবা না। দোদুল দোলায় মন তিরতির করে কাঁপতো। মাত্র আঠারোতে ছেড়ে দিব দূরের ওই দেশে! থাকতে পারব তো আমি! থাকতে পারবে তো ওরা! কি খাবে, কে খাওয়াবে, কে সকালে ডেকে দিবে ক্লাসে যাওয়ার জন্য, রাতে বিছানা ঝেড়ে দুধ পানে অনিচ্ছুক পুত্রদের হাতে উষ্ণ দুধের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলবে, খেয়ে নাও আব্বু। রাতে ঘুমানোর আগে দুধ খাওয়া ভাল!
তখন আমার নানু আর দাদীর কথা মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল গ্রামের নরম কোমল গৃহবধূ সেকালের মায়েদের কথা। যারা বহুকাল আগে তাদের সন্তানদের শহরে পাঠিয়েছিল লেখাপড়া করতে। এই মায়েরা কোনোদিন শহরে আসেনি, সন্তানদের কোথায় পাঠাচ্ছে জানে না, যেখানে একটা চিঠি ও এর উত্তরের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়, ফোন নেই তাই ছ’মাসেও একবার সন্তানের গলার স্বর শোনা যায় না, শহরের খাঁজে-ভাঁজে পড়া সন্তান আদৌ আর তেমন করে ফিরবে কিনা জানে না, সেই মায়েরাও সন্তানকে শিখতে দূরে পাঠিয়েছিল। ডানা মেলতে দিয়েছিল আকাশে।
কত মা ডালের বড়ি শুকিয়ে রাখতো, দু’বার ভাজা যায় তেমন শুকনো পিঠা বানিয়ে রাখতো, মাষকলাইয়ের ডালের গুড়া, চালের গুড়া নিয়ে বসে থাকতো ছ’ মাস, ন’মাস! সন্তানের প্রিয় খাবার বলে মাছভাজা দিয়ে ভাত খেতে গেলে দলাদলা কান্নায় গলায় আটকে যেতো খাবার! মায়েরা সন্তানের বেদনা নিত। প্রথম ছুটিতে বাড়ি এলে খুঁটে খুঁটে জেনে নিত তারা কি খায়, কোথায় ঘুমায়! জানা হয়ে যেত তাদের সন্তানরা হলে/মেসে ঘ্যাঁট খায়, ডালের পানি দিয়ে ভাত খায়, তাদের সরু এক চিলতে বিছানায় ঠিক করে শোয়া যায়না, মাসের শেষে টাকা ফুরিয়ে এলে তারা নাস্তাটা ফাঁকে ফেলে দিতে বেলা অবদি ঘুমায়! তারপরেও মায়েরা সন্তানকে ফিরে আসতে বলেনি। পিছন থেকে জামা টেনে বলেনি, আর যাসনা !
আমিও সন্তানদের ডানা ছেঁটে দিইনি। বরং আস্থার পালক গুঁজে দিয়েছি তাতে। জানতাম উড়তে গেলে প্রতিদিন আকাশে অনুকূল হাওয়া থাকবেনা, রোদেলা সকাল নন্দিত আবাহনে মুখর হয়ে উঠবেনা, জানতাম হাতের ডলার ফুরিয়ে গেলে ওরা ব্রেকফাষ্ট লাঞ্চ মিলিয়ে ব্রাঞ্চের জন্য ছুটবে, অপেক্ষায় থেকে লন্ড্রী ব্যাগ উপচে পড়বে, আর আমিও মাছের কাঁটা বুকে বিঁধে যাওয়ার মত রক্তপাতহীন বেদনায় ভুগতে থাকব। তবুও আমি আমার বেঁচে থাকার সম্বলদের দূরে যেতে দিয়েছি। ওরা যেমন করে শক্তিশালী হয়ে উঠবে, নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে বলবে, ব্যাপার না মা, তেমনটা হতে দিতে আমি হাজার হাজার মাইল দূরে বসে ভেবেছি,
‘আমার নীড়ের পাখি এবার উধাও হল আকাশ-মাঝে
যায়নি কারো সন্ধানে সে যায়নি যে সে কোনো কাজে।
গানের ভরা উঠল ভরে, চায় দিতে তাই উজাড় করে-
নীরব গানের সাগর-মাঝে আপন প্রাণের সকল বাণী।’
আজ এই তীব্র প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কত কথা মনে পড়ছে। তবে সব ভুলে গিয়ে আমি আজ আমাদের সন্তানদের জন্য প্রার্থনায় রত হয়েছি। সন্তানদের বলছি, সুঠাম ডানা মেলে উড়ে বেড়াও অনিন্দ্য, প্রিয়ম। জ্ঞানে, চৈতন্যে, জ্যোতিতে নিজেদের আকাশ তৈরি করো। জগত সংসারের সকল মন্দ সাহসের সাথে মোকাবেলা করো, আনন্দে গানে কল্যাণে ভুবন ভরিয়ে দাও। মা ভালোবাসার হাইফেন হয়ে তোমাদের সাথে জড়িয়ে থাকবো, আর মনের ভিতর গভীর বিশ্বাস ধারণ করবো এই বলে যে, আমার সন্তান আছে দুধে-ভাতে, আমার সন্তান তার চারপাশকেও রাখে দুধে-ভাতে।