আমার জীবনে টিপ- সিঁদুরগাথা

রোজিনা রোজী:

টিপ পরতে ভালোবাসি, বিশেষত লাল টিপ। লালটিপ পরে মার্কেটে গেলে (বিশেষত চট্টগ্রাম শহরে) বিক্রয়কর্মীরা ‘দিদি’ বলে ডাকেন। সম্বোধনটা বেশ ভালো লাগতো আমার। প্রথমদিকে ভাবতাম, হয়তো এমনিই ডাকছে, তবে দু’একবার টিপ ছাড়া যাওয়াতে ভুলটা কেটে গেলো।

ক’দিন আগে মার্কেট থেকে একই অভিজ্ঞতা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। ভাবছিলাম, হয়তো তাদের তেমন পড়াশোনা নেই বলে বলছেন, করছেন; শিক্ষিত হলে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম হতো। পরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লো।

১) তখন আমি তৃতীয় বর্ষে পড়ি। টিপ এবং সিঁদুরের প্রতি ভীষণ ভালোলাগা আমার। যদিও পরে সিঁদুরের প্রতি ভালোলাগা কমে যায়, কারণ বর্তমানে এটি একটি নির্দিষ্ট তথ্যের ইঙ্গিত হিসেবে বিবাহিত মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেয়া। বিস্তারিত অন্যদিন লেখা যাবে। যাহোক, একদিন খুব ইচ্ছে করছিল লাল শাড়ির সঙ্গে লালটিপ আর সিঁদুর পরবো। কী আর করা, হলে সিঁদুর পাওয়া গেলো না। কিন্তু সিঁদুর আমার লাগবেই, তখনই লাগবে। অগত্যা লাল লিপস্টিককে সিঁদুর বানিয়ে পরলাম। ফ্লোরের সবাই বললো সুন্দর লাগছে। খেয়াল করার মতো দুয়েকজন ছাড়া সিঁদুরের কথা কেউ বলেনি।

রাতের খবারের সময় রান্নাঘরে গেলাম, অনেক ছাত্রীই তখন রান্না করছিল। দুয়েক ঘন্টা পর আমার সেসময়ের এক বন্ধু বললো, “তুই সিঁদুর কেনো পরছিস? শি* আপু আমাকে জিজ্ঞেস করছে, তুই কি ধর্ম চেঞ্জ করে ফেলছিস?” অবাক হলাম। এটা শুধু ধর্ম পরিবর্তনের বিষয় ছিল না। কারণ, কোনো অবিবাহিত হিন্দু মেয়ে সিঁদুর পরে না, বিবাহিতরাই পরে। তার মানে ওরা জানতে চাইছে, আমি কোনো হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়েছি কিনা!
শুনতে পেলাম আমার রুমের বাইরে আমার সিঁদুর নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা করছে। যে আরেকজনের মাধ্যমে এই প্রশ্নটি করে পাঠিয়েছিল, সে তখন নৃবিজ্ঞানেরর মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। সে বোরখা পরতো, তাকে বোরখা নিয়ে আমি কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করেছি বলে মনে পড়ে না। সত্যি বলতে তার সঙ্গে মোটে কয়েকবার কথা হয়েছিল সমস্ত হল জীবনে। আর যে প্রশ্নটি নিয়ে এসেছে, সে আমার সহপাঠী ও বন্ধু। এই শেষ নয়, আশ্চর্যের বেশ খানিকটা বাকি ছিল আমার জন্য তখনো।

পরদিন আমার সে বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সে আগের রাতের সিঁদুরের প্রসঙ্গ তুললো। আমি ভাবলাম হয়তো সে ক্ষমা চেয়ে স্যরি বলবে। কিন্তু না, আমাকে বিস্ময়ের সপ্তমাকাশে তুলে আমার সে সনাতন বন্ধু, হলের একই ফ্লোরে থাকে, সে বললো, আমি নাকি সিঁদুর পরে ঠিক করিনি। সিঁদুর পরে আমি হিন্দু ধর্মকে ছোট করেছি, অপমান করেছি! অথচ শুধু আমিই জানি কতটা ভালোবাসা আর আবেগ নিয়ে আমি সেদিন সেজেছিলাম।

সেদিন কোনো প্রতিবাদ করিনি, আগেভাগেই যেখানে বোঝা যায় যে বলে কোনো ফল হবে না, সেখানে কিছু না বলাই ভালো মনে করেছিলাম। শুধু তাই নয়, এরকম অনেক ক্ষেত্রেই সেসময় কোনো প্রতিবাদ করতাম না, কোনো লাভ হবে না জেনে। তবে আমার রুমমেট অনেক অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিল। সে গর্বিত বাঙালি মুসলমান ছিল না, সে ছিল আদিবাসি মারমা জনগোষ্ঠীর একজন সচেতন প্রতিনিধি।

২) বিয়ের পরপর হল ছেড়ে বাসায় উঠলাম। এক বিকেলে বাসা থেকে হলে গিয়েছিলাম। সেদিনও কপালে লালটিপ ছিল। যথারীতি শুনতে হলো, “তোকে হিন্দু হিন্দু লাগছে।” কে বলেছে সেটা না হয় উহ্যই থাক। এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে।

৩) ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী। কিছুদিন আগে তিনি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হলেন, তখন তাঁর অসুস্থতা নিয়ে অনেকগুলো সংবাদপত্রে খবর এলো। আমার প্রিয় একজন শিক্ষকের সুবাদে ফেইসবুকে সে খবরে করা কিছু মন্তব্য দেখে আঁতকে উঠলাম। সবার মন্তব্যে আক্রমণের মূল জায়গা ছিল তাঁর টিপ।

প্রথমদিকে যেখানে কিছু বিক্রয়কর্মীর দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছি সেখানে পরের অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরার পর সেই বিক্রয়কর্মীদের দোষ দেয়া যায় না। বাংলাদেশের অবস্থা বিচারে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে যখন কেউ এ ধরনের কথা বলতে পারে, তখন অন্যদের কাছে আর আশা করার কিছু থাকে না।

ঋকবেদে আছে, টিপ পরার ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছর পুরোনো। আদিম নারীরা প্রকৃতি থেকে রঙ নিয়ে টিপ পরতেন। সিঁদুরকে ধরা হতো শক্তির প্রতীক হিসেবে,ঊর্বরতার প্রতীক হিসেবে। আদিম নারী তাঁর গোত্রে শক্তিমান ছিলেন, সম্মানিত ছিলেন।

আমাদের লেখাপড়া এখন বড় বেশি সার্টিফিকেটমুখী। শিক্ষাজীবনে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সিলেবাসের কিছু পড়া বাধ্য হয়ে পড়ে অনেকে, তবে বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। কথায় কথায় সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ করতে ভোলে না অনেকে। যে দেশে জন্ম নিলাম, বড় হলাম তার আদি ইতিহাস, সংস্কৃতি পড়ার প্রয়োজনটুকুও বোধ করি না। যে ইডিওলজিক্যাল হেজিমনি উত্তরাধিকার সূত্রে অর্পিত হয়, তার ঊর্ধ্বে ওঠা না গেলে বেগবান পিছিয়ে যাওয়াকে থামানো যাবে না কিছুতেই।

শেয়ার করুন: