শেখ তাসলিমা মুন:
আমার আগের ছোট্ট নিবন্ধটিতে আমি বলেছিলাম, নারীকে আবৃত করা বা তাদের তা থেকে বেরিয়ে আসার যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতির একটি অংশ। পশ্চিমা সোসাইটির প্রতি আস্থার কারণে মুসলিম বিশ্বের নারীরা পর্দা থেকে এক সময় বেরিয়ে এসেছিল। আবার পশ্চিমা আগ্রাসনের প্রতিবাদ হিসেবে তারা আবার তাদের আইডেন্টিকে শক্তিশালী করতে পর্দায় ফিরে গেছে। নারী তথা নারীর শরীর হয়েছে মুসলিম আইডেন্টিটির এক সাইনবোর্ড।
পশ্চিমা কালচারের কিছু নেতিবাচক উপসর্গও মুসলিম নারীর হিজাবকে righteous এবং virtuous হিসেবে জাস্টিফাইড করেছে। কর্পোরেট বাণিজ্যিক বিশ্ব নারীর দেহকে ‘পণ্য’ করেছে এ অভিযোগ একটি পপুলার অভিযোগ। এর চাপ মুসলমান নারীর পর্দা পালনের উপর এসে পড়েছে। এভাবেই নারীর শরীরে পর্দার যৌক্তিকতার অসাড়তার প্রশ্নটি ঢাকা পড়ে গেছে। পর্দায় আবৃত করে একটি ধর্মের পরিচয়কে প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তায় এভাবে নারীর শরীর ‘বিষয়বস্তু’ হয়েছে।
নারীর শরীর যেন এক চলমান যুদ্ধক্ষেত্র, যাকে ঘিরেই পুরুষতন্ত্র তা ধর্মীয় হোক বা সেক্যুলার হোক, সকল বিধান জারি করেছে। এবং কিভাবে তার শরীরের সকল পাপ মাথায় এসে পৌঁছেছে, পুরুষতন্ত্রের চোখে ঠাণ্ডা মলম দেওয়ার কাজে এক টুকরো বস্ত্রখণ্ড এতো শক্তিশালী ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সেটাই এক বিস্ময়কর বিষয়।
এখন প্রশ্ন হলো, মাথা কেন? যদি ধরে নেই শরীরের অন্যান্য অংশের মতো মাথাও যৌন আবেদনময়, তাহলে অবশ্যই তার ঠোঁটও। নারীর দাঁত। নারীর কপাল। নারীর কপোল। নারীর হাসি। তার কণ্ঠস্বর। তার কথা? তার সকল আবেগের প্রকাশ তো তার কথায়। আর তার চোখ? মূলত চোখেই থাকে নারীর সকল আবেদন। এগুলোকে না ঢেকে মাথা এবং শরীর ঢাকার ভেতর দিয়ে নারীর সেক্সুয়ালিটিকে কতটা সফলভাবে দমন করা সম্ভব? তাহলে বলা যায়, পর্দা সে অর্থে পুরোপুরি সফল কোথাও নয়। নারীর এ পর্দার প্রকারও সে কারণে এলাকা ভেদে, গ্রুপ ভেদে আলাদা হয়েছে। পুরোপুরি তবু এ যুদ্ধ সমাপ্ত হয়নি।
মূলত, এটি কি নারীর যৌনতা দমন? নাকি এটি একটি ‘শক্তি’র দাপট? নারীর শরীরের উপর পুরুষের আধিপত্যের ‘পাওয়ার’? নারীর শরীরের উপর নিয়ম জারি করছে পুরুষ এবং তাদের তৈরি আদেশ, বিধান, নিয়ম, আইন, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা। নারীর এখানে রোল কেবল তা পালন করা। সে পালন কখনও বাধ্যতামূলক, তার উপর বশ্যতার চাবুক চালিয়ে, মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে, ইন্ডক্ট্রিনেট করে। কখনও ধর্মের আফিমে, কখনও মুল্যবধের দায় চাপিয়ে। মূলত এটি নারীর প্রতি পুরুষতন্ত্রের শক্তি প্রয়োগ এবং নারীর দেহে তাদের আধিপত্যই মূল কথা।
মুসলিম নারীর স্বেচ্ছায় হিজাব পরিধান একটি মিথ। মূলত তার প্রতি আরোপিত এ পর্দা প্রথাটি ঘটে কয়েকটি ধাপে। তাকে বুঝানো হয় সে মুসলমান। ধর্মীয়ভাবে তার উপর এ নিয়ম আরোপিত। ‘তুমি মুসলমান নারী, আল্লাহকে বিশ্বাস করলে তোমাকে এটি পরিধান তোমার জন্য অপরিহার্য করা হয়েছে।’
এখানে ‘কেন’ প্রশ্নের কোন জায়গা নেই। ‘কেন’ প্রশ্নটি ধৃষ্টতা। ধৃষ্টতা আল্লাহর প্রতি। এটি বিশ্বাস। এখানে তার পছন্দ বা অপছন্দের স্পেস নেই। তুমি বিশ্বাসী তুমি আদেশ পালনের জন্য। অন্যথায় তুমি আদেশ ভঙ্গকারী। আল্লাহর আদেশ ভঙ্গকারীর জন্য দোজখের আগুন। এবং যে ধর্মীয় নিয়ম আদেশ এবং মূল্যবোধকে লঙ্ঘন করে সে তার ভারচু হারায়। আদর্শচ্যুত, পতিত সে। এর গুরুত্ব উপেক্ষা করে একজন নারী তার ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটাবে সে এক কঠিন বিষয়। Muslim patriarchy পুরুষদের কামনার পাপ থেকে নিজেদের রক্ষা করার দায়িত্ব নারীর উপরই চাপিয়েছে।
অতি মোটা দাগে নারীর শরীরকে নিজের নয় বরং কমিউনিটি প্রপার্টি করে তোলা হয়েছে যেন সকলের তাতে অধিকার। নারীকেও সেভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। তাকেই মাল্টিপল দায় ও দায়িত্ব নিতে হয়েছে। তাকেই তার আচরণের মাধ্যমেই রক্ষা করতে হয়েছে তার শরীরের মর্যাদা, সমাজ ও ধর্মের নর্ম এবং তার পারিবারিক ‘সম্মান’। এ সব কিছুর মূলে কাজ করে তার শরীর। নারীর শরীরকে ‘বদ নজর’ থেকে রক্ষা করার, তার শরীরের পবিত্রতা রক্ষা করার, পুরুষের যৌন উত্যক্ততা থেকে নিজেকে রক্ষা করার যে দায় চাপানো হয়ে আসছে ধর্মের বিধান দিয়ে, যা মনে হয় পর্দার সবচাইতে ইতিবাচক যুক্তি হিসেবে নারীকেই ঘায়েল করা গেছে বহুদিন ধরে। যুক্তিটি তারা এ যাবত গ্রহণ করেছে, “ওকে, মাথায় এক টুকরো কাপড় তুলে দিয়ে ঝামেলা এড়াই। পরিবার সমাজ আপনজনকে সন্তুষ্ট রাখি। এক টুকরো কাপড় মাথায় দিলে রাস্তার মাস্তান ছেলেটা ‘কুনজর’ দেবেনা, ‘সম্মান’ দেখাবে। খারাপ কি? এতে যদি কাজ নির্বিঘ্নে হয়ে যায়, দিলাম না হয় মাথায় এক টুকরো কাপড়”!
কিন্তু এ যুক্তির অসাড়তা সকল শিক্ষিত নারী এবং পুরুষ আজ বুঝতে পারছে। আসলে এভাবে মস্তক আবৃত করার মাধ্যমে একটি সমাজের গেঁড়ে বসে থাকা পুরুষতান্ত্রিক ব্যাধি দূর করা যায়না। সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। সমস্যাটার শেকড়ে হাত দিতে হলে নারীর মাথা নয় পুরুষের নারীর শরীরকে কেবল ‘ভোগ্য বস্তু’ হিসেবে দেখার চোখটির পরিবর্তন করতে হবে।
নারীর মাথায় আচ্ছাদন নয়, তাদের তথা গোটা পুরুষতান্ত্রিক মাথার মগজটি বদলাতে হবে। মননটির সংস্কার করতে হবে। মস্তক কাপড়ে মুড়ে সামগ্রিক এবং উন্নত মানব সমাজ গড়া সম্ভব নয়। যেকোনো শ্যালো সমাধান সমস্যাকে কেবল জটিল করে, সমস্যার শেকড় উৎপাটন করে না। আর সে সমাধান যদি মানব শ্রেণীর একটি বৃহৎ অংশকে সাপ্রেস করে হয়, তাদের ব্যক্তিসত্ত্বাকে অসম্মান করে হয়, তাদেকে ‘আলাদা’ করে হয়, প্রকারন্তরে তাদেরকে ‘ভোগ্যবস্তু’ হিসেবে চিহ্নিত করে হয় তাহলে সেটি মানব সম্প্রদায়ের জন্য এক কদাকার সমাধান। যার নৈতিক পরাজয় ইতিমধ্যেই একটি বাস্তবতা।
আর কোনো শিক্ষিত এনলাইটেন্ড নারীরই উচিত নয় এ স্থুল পদ্ধতি গ্রহণ করে একটি অন্ধকার সমাজ জিইয়ে রাখার বিষয়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখা। তাদের দরকার নিজেদের শক্তিশালী করে একটি শক্তিশালী সভ্য সমাজ গঠনে সহযোগিতা করা।