জিনাত হাসিবা স্বর্ণা:
জীবনে প্রথম ডিম ভেঙেছিলাম ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। চূলার পাশে দাঁড়িয়ে আমি ডিমটাকে ভাঙলাম হাতের নিচের বাটিকে উদ্দেশ্য করে, মুহূর্তেই আমাকে হতবাক করে দিয়ে ডিমটা ভেতর থেকে বেরিয়ে উড়ে গিয়ে পড়লো রান্নাঘরের দরজার কাছে। ডিমের অভূতপূর্ব হাইজাম্পে ফিক করে হেসেই আবার বোকা বোকা চেহারা আমার! দুই হাতে ডিমের খোসা দুটোর দিকে একবার, আর মেঝেতে পড়ে থাকা ডিমটার দিকে একবার তাকিয়ে অনুভূতিটা কী হওয়া উচিত বুঝে পাচ্ছিলাম না।
ঘটনা গুরুতর বটে, কারণ তখন আমাদের ‘একটা ডিম চারজন বা প্রয়োজনভেদে আটজনও’ খাওয়ার সময় যাচ্ছে। দ্বিতীয় ডিমটা ভাঙার ঝুঁকি নিবো কিনা দুই সেকেন্ড চিন্তা করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ডিমটা ভাঙবো; এবং ভাঙার পর বাটির মধ্যে ঠিকঠাক ডিমটাকে দেখে সে কী প্রশান্তি আমার! এই দ্বিতীয় ডিমটা তখনই ভাঙা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত আর শিক্ষা ছিলো। আমি জেনেছিলাম আমি চাইলে আর চেষ্টা করলে রান্নাবান্না নিশ্চয়ই পারবো। তারপরে আমি বিশেষ চিন্তিত ছিলাম না এ বিষয়ে।
আমার এই শিক্ষাটুকুর কথা উল্লেখ করলাম পরিবারের নির্দিষ্টসংখ্যক ‘নির্ভরশীল’ মানুষদের জন্য। মাত্রাতিরিক্ত হারে ‘নির্ভরশীল’ মানুষ- যারা দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য (আরো অনেক আছে, নিজের কাপড়ের খোঁজের জন্য, নিজের পানিটুকু ঢেলে খাওয়ার জন্য, গোছানো পরিবেশে পা ছড়িয়ে আরাম করার জন্য, সন্তানের পড়ালেখার দেখাশোনার জন্য কিংবা ডাক্তারের কাছে নেওয়ার জন্য) পরিবারের অন্য কিছু ‘নির্দিষ্ট’ মানুষের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।
তথাকথিত ‘নির্ভরশীলতার’ কথা বলছি না। যে সংজ্ঞা বলে “আয় করছেন বলে পরিবারে নারী ‘নির্ভরশীল’, আর পুরুষ ‘স্বনির্ভর’-” সে সংজ্ঞায় বলছি না। তথাকথিত চালে চলছে যেসব সংসার, সেসব সংসারের পুরুষদের নির্ভরশীলতা আর নারীদের স্বাবলম্বিতার কথা বলছি।
‘নির্ভরশীল পুরুষ’ আর ‘স্বনির্ভর নারীর’ কথা বলছি। স্বনির্ভরতা বলতে আমরা কেন যেন কেবল অর্থোপার্জনকে বুঝি। সুতরাং নারীকে ‘স্বনির্ভর’ করার কী প্রাণান্ত চেষ্টা! এই প্রাণান্ত চেষ্টা সফলতার মুখ দেখছে, অর্থকড়ি আসছে নারীর হাতে। সর্বজয়া নারী ‘স্বাবলম্বী’ হচ্ছেন। কিন্তু ‘স্বনির্ভর/স্বাবলম্বী’ পুরুষেরা আদৌ কি স্বনির্ভর?? আগের লেখায় বলেছিলাম রান্না ‘বেসিক স্কিল’, কারণ বাঁচতে হলে খেতে হয়, খেতে হলে রাঁধতে হয়। রান্নার ব্যাপারে আমার আরো অনেক কথা আছে। বলার চেষ্টা করা যাক।
আমরা অনেকেই ঘরের রান্নার দায়িত্ব মেয়েদের দেওয়ার অনুমোদন এই বলে দেই যে, “যে কাজ যে ভালো পারে সেটা তার করাতেই সংসারের সর্বোচ্চ মঙ্গল”। আমাদের সমাজের যা রীতি, এই অনুমোদনটুকু সম্বল করে পুরো দায়িত্ব চলে যায় মেয়েদের হাতে। এই যে ‘মেয়েটি’, সে কোনো বয়সের তার কোনো সীমা নির্ধারিত নেই। এটা নির্ভর করে পরিবারের সদস্যসংখ্যা, বাবা-মায়ের আর্থিক অবস্থা ও সময় দেওয়ার ক্ষমতা, ভাইবোনদের বয়স ইত্যাদির উপর। সুতরাং কোনো না কোনো বয়সে এসে মেয়েরা পরিবারে রান্নায় দক্ষ হয়ে উঠছে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের তুলনায়।
আবারও বলি- রান্নার ভার দেওয়ার বেলায় ‘রান্নায় যার হাত ভালো রান্নাটা সে-ই করবে’ থিওরিতে এগোলে এ সমাজে রান্নার ভার অবধারিতভাবেই নারীর উপর বর্তাবে। কারণ নারীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই রান্না শেখানো হয় ‘বিয়ের পর রান্নার দায়িত্ব নিবে’ বলে আর পুরুষকে রান্নাঘরের ধার ঘেঁষতে দেওয়া হয় না ওটা ‘মেয়েদের জায়গা’ বলে। দুই দিক থেকেই ব্যাপারটা অমানবিক। যেকোনো দক্ষতা অর্জনেই যদি সুযোগের সমতা না থাকে, তাহলে যোগ্যতার বিচার নিঃসন্দেহে পক্ষপাতদুষ্ট। যে ছেলেটা কখনো সুযোগ পায়নি সে কিভাবে একজন চমৎকার রাঁধুনী হয়ে উঠবে? তারপরেও কথা আছে, যে ‘ভালো পারে না’ তাকে আমি করারই সুযোগ দিবো না?
রান্নায় আগ্রহ ছিলো না বলে ছোটবেলায় বাসায় আমি ক্লিনিং, গোছগাছ আর দোকানে যাওয়া আসার কাজগুলো করতাম। রান্না শিখিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেও সাথে বোন থাকাতে শুরুতে রাঁধিনি। বাসায় ও রাঁধতো বলে রান্নায় ‘ওর হাত পেকেছে, সুতরাং ও-ই রাঁধতো’। ক্লাসের ফাঁকে হাতে কম সময় থাকতো বলে মাঝে মাঝে আমাকে এটা-সেটা করতে দিতো, আমি খুবই আগ্রহের সাথে কাজটা করতে চাইতাম। কিন্তু আনাড়ি আমি। শুরু করার একটু পরেই ও বিরক্ত হয়ে আমার হাত থেকে কেড়ে নিতো কাজটা, “এত্তো সময় লাগে? এর চেয়ে তো আমারই করা ভালো”।
কনফিডেন্স আরো কমে যেতো, আর পরেরবার আরো নড়বড়ে হয়ে যেতাম। হল লাইফে একবার ওকে ঢেঁড়স-ডাল রেঁধে খাইয়ে ওর প্রশংসা পেয়েছিলাম, বাকি জীবন আর কোনো রান্নায় স্পেশ্যালাইজ করে ফেললেও সেই প্রশংসার আনন্দ পাবো না! ‘খেতে হবে’ আর ‘ডাইনিং এর খাওয়া নিয়মিত খাওয়া সম্ভব না’ বলেই বোন হল ছেড়ে যাওয়ার পর রাঁধতে রাঁধতে শিখেছি রান্নাটা। আমার নড়বড়ে হাতের রান্না মহা আনন্দ নিয়ে খেয়ে রুমমেট শারমিন আর মাঝে মাঝে আমার বন্ধুরা ‘রান্না যে আমি চলতে পারার মতোন করতে পারি’ সেই বোধ দিয়েছে। এই বোধ আমার শক্তি হয়েছে যখন আমি চাকরি নিয়ে রংপুর চলে গেলাম একা।
বাঁচতে হলে খেতে হয়, খেতে হলে রাঁধতে হয়। নিয়মিত বাইরের খানা পেটে বা পয়সায়-কোনোটাতেই পোষায় না, সেজন্যেও রাঁধতে হয়। ‘পেটের দায়ে’ (!) অন্যের উপর জীবনে মরণে নির্ভরশীল হয়ে থাকা অসহায়ত্বের জন্ম দেয়। সেজন্যেও রাঁধতে হয়। সবাইকে রান্নার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলছিনা, বলছি এমন একটা আবহ তৈরী না করতে যেন কারো মনে হয় রান্না তার জন্য একটা অসম্ভব কাজ। রান্না প্রয়োজনমতো যেকোনো বয়সেই শিখে নেওয়া যায়, কিন্তু সেই মানসিকতাটুকু থাকা দরকার এবং উচিতও বটে।
ছোটবেলায় আমার ভাইটাকে মাঝে সাঝে রান্না করার ব্যাপারে আগ্রহী হতে দেখেছি আমি। কিন্তু চূলার আশপাশে গেলেই ওকে হয় তাড়ানো হয়েছে, নতুবা ঠাট্টা মশকরায় অবহেলায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কে বলতে পারে, তখন এমন না করলে হয়তো ও খুব সহজেই বন্ধু, বউ বা মেয়েকে চমৎকার ডিশ রেঁধে খাওয়াতে পারতো! ওকে সেই আনন্দটা থেকে তো বঞ্চিত করেছি আমরা। ওর একা থাকার সময়গুলোকে অসহায় করে তোলায় আমাদের দায় আছে। সেই দায়টা সমাজ চাপানোর চেষ্টা করে অন্য কোনো মেয়ের উপর, “বউ সাথে থাকলে আর সমস্যা হয়না”। একটা মেয়ে একা থাকলে আমরা তার ‘নিরাপত্তা/সতীত্ব’ নিয়ে চিন্তিত হই, একটা ছেলে একা থাকলে আমরা তার ‘খাওয়ার কষ্ট/স্বাস্থ্য’ নিয়ে চিন্তিত হই! বিচিত্র সমাজ, বিচিত্র তার আচরণ!
এখন কথা হলো, স্কুলে যে শিশুটা পড়ায় ভালো করে না, কিংবা সময় বেশি নেয় বুঝতে- তাকে কি আমরা স্কুল ছেড়ে দিতে বলবো? তাকে কি আমরা ‘পড়া তোমার কম্মো নয়’ বলে তাড়িয়ে দিবো? সবার কি আদৌ দরকার আছে ‘ভালো’ করার? নাকি সবার পড়ালেখা করে মহাবিদ্যান হয়ে পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করে যাবার বাধ্যবাধকতা আছে? নেই তো! কিন্তু পড়তে-লিখতে শেখার তো দরকার এবং অধিকার আছে সবার, যেন ঠ্যাকার কাজগুলি চালাতে পারে কিংবা আরো পড়বে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ছেলেদেরকে রান্নাঘর থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আমরা কি তাদেরকে রেঁধে খাওয়ার দক্ষতা থেকে বঞ্চিত করছি না?
খাওয়া হলো শ্বাস প্রশ্বাসের পরে জীবনের প্রথম শর্ত। এই খাওয়ার জন্যই যদি আমাকে পুরোপুরি অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয় এটা সত্যি দুঃখজনক (যদি সেটা পয়সার বিনিময়েও হয়, তবুও। পোশাকও আমরা কিনে পরি, কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারটা ভিন্ন)। অথচ এটাই হয়ে আসছে। ব্যাচেলর ছেলেদের হিমশিম অবস্থা হয়ে যায় এই খাওয়ার ব্যবস্থা করতে, শুধুমাত্র এইজন্য যে তাদের ভেতরে ‘রান্নাফোবিয়া’ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে (আজকাল মেসে থাকা ছেলেরা নাকি নিজেরা রাঁধার চর্চা শুরু করেছে। অভিনন্দন তাদের))।
আবার যে মেয়েটার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই রান্নায় তাকেও ‘নিয়মিত রান্নার ভার’ নিতে হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে। কারণ সে-ই ‘পারে’, তারই ‘করার কথা’। তার পুরুষ সঙ্গী ‘পারে না’, তার ‘করারও কথা না’। মোটেই পছন্দ না করা একটা কাজ প্রতিদিন করার দায়ভার নিরন্তর বয়ে যাওয়ার মতোন দুর্বিষহ জীবন আর হয়?
এই যখন অবস্থা, তখন আমরা যদি গোঁ ধরেই বসে থাকি, অথবা স্রোতে গা ভাসিয়ে দেই, তাহলে পরিবর্তনটা আসবে কিভাবে? পরের জেনারেশন? যে সন্তান কখনো বাবাদের রাঁধতে দেখেনি আর আজীবন মায়েদের/বোনদের সুস্থ বা অসুস্থ, জীবিত বা মরমর হয়েও রাঁধতে দেখেছে- সেই সন্তান? সে তো মায়ের এই ‘মহান অবস্থানে’ বউয়ের মাঝেও সেই ‘মরমর হয়েও রান্না করে যাওয়া টাইপ’ ত্যাগের মহিমা খুঁজবে।
আরো আছে। কেবল একজন মানুষের উপর ঘরের রান্নার দায়িত্ব থাকলে রাঁধুনীর উপর যে শুধু চাপ পড়ে তা নয়, এক ঘেঁয়েমি আসে। রাঁধতে মন সরেনা। একই স্বাদের রান্না খেতে খেতে যারা খাচ্ছে তাদেরও খেতে ভালো লাগেনা। দোষ হয় রাঁধুনীর। রান্নার দোষের বাহানায় নারীর উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা নেহায়েত কম নয়। পরিবারের সদস্যরা রান্নার দায়িত্ব ভাগ করে নিলে এসব সমস্যার তীব্রতা কমে আসে। এই ভাগ করাটা রুটিন মাফিক হবে নাকি নিজেরা ফ্লেক্সিবল থেকে বোঝাপড়ার মাধ্যমে করবেন সেটা একেবারেই পরিবারের মানুষগুলির ধরন আর মানসিকতার বিষয়, এটা এক এক পরিবারে এক এক রকমই হবে। পরিবারের মানুষগুলির একে অপরের প্রতি খেয়াল রাখার আর সুস্থতা/অসুস্থতা/ইচ্ছা-অনিচ্ছের প্রতি সম্মান রাখার উপর নির্ভর করে দায়-দায়িত্বের বন্টনটা কেমন হবে।
রান্না শুধুই দায়ভার নয়, আনন্দও বটে। একেবারেই যিনি রান্নায় আগ্রহী/পারদর্শী নন, তিনিও জানেন নিজে বা অন্য কেউ এই রান্না খাওয়ার সময় নিজের পরিতৃপ্তির কথা।
যেসব কাজে ‘প্রথাগত’ ভাবে মেয়েরা নিযুক্ত সেসব কাজকে হেয় করাটা এ সমাজের একটা চর্চা। সেই সূত্রে রান্না করাকে অনেকে নিম্নমানের কাজও মনে করে, এমনকি এটাকে কোনো ‘কাজ’ বলেই গণ্য করেনা। অথচ মুখের স্বাদ আর পেটের খোরাকের গুরুত্ব বোঝেনা এমন লোক নেই। এমনকি রান্নায় পটু হয়ে পুরুষের পেটের সাথে সাথে হৃদয়ের দখল নেওয়ার পরামর্শ মেয়েদের প্রতি হরে দরে। পেট আর হৃদয় তো মেয়েদেরও আছে, আর তার প্রেমের প্রয়োজনও পুরুষেরও আছে। মেয়েদের প্রতি এই পরামর্শের হীনতা/অন্তর্নিহিত অসম্মানের কথা না হয় না-ই বললাম, কিন্তু মন পাওয়ার এই ‘অব্যর্থ কৌশল’ অবলম্বনের সুযোগ পুরুষ কেন নিবেন না?
যে পুরুষেরা রান্নাঘরে পা রাখেন না, তারা কিন্তু পেট চালাতে কোনো না কোনো মেয়ে/নারীর উপর নির্ভরশীল হয়ে আছেন। এই নির্ভরশীলতা আর অসহায়ত্বের বোধ থেকে তৈরি করছেন ‘সাংসারিক জটিলতা’, যাকে আবার মানসিক নির্যাতনের পর্যায়ে অনুভব করেন অনেকে। সংসারে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের উপর নির্ভর করবে, কিন্তু তা অসহায়ত্বের পর্যায়ে যেতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বোকামী এবং এর ভোগান্তিটাও অবধারিত।
পুরুষদের প্রতি শুভকামনা! স্বনির্ভর হোন! স্বাবলম্বী হোন!