শাফিনেওয়াজ শিপু:
ইংল্যান্ডে আসার পর একটি বারের জন্যও আমি অনুভব করিনি যে আমিও এইদেশে সংখ্যালঘু। কারণ এই দেশের সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে সম্মানের সাথেই মিলেমিশে বসবাস করছে। আর তাছাড়া আমরা ভুলে যাই সব ধর্মের অনুসারীরাই কিন্তু কোনো না কোনো দেশের জন্য সংখ্যালঘু এবং এই সংখ্যালঘু শব্দটি আমাদের মতো অনুসারীদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক।
কিন্তু আমাদের দেশে এই শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় এবং তাদের ওপরে অত্যাচারও করা হয়। আজকে সমাজে কিছু শ্রেণির মানুষ ও উগ্র মৌলবাদীদের জন্য এই শব্দটি প্রকট আকার নিয়েছে। যে ধর্ম মানুষকে শান্তির বার্তা ও পথ দেখায়, সেখানে আমরা মানুষেরাই সেই ধর্মকে নিজের সুবিধা মতো ব্যবহার করছি। এইদেশে ইংরেজরা ধর্ম নিয়ে বিভেদ না করলেও মাঝেমধ্যে জাতিগত বিদ্বেষে হুল ফুটায়।
বাংলাদেশ মুসলিম দেশ, সুতরাং হিন্দুদের কোনো স্থান নেই এই দেশে, এই রকম নিয়ে ধ্যান-ধারনা, চিন্তা চেতনা ও গোড়াঁমী নিয়ে কিন্তু অনেক বাঙালী এই দেশে মানে ইংল্যান্ডে বসবাস করছে। ঠিক আমারই একজন পরিচিত আছেন, যিনি কিনা কথায় কথায় বলেন, হিন্দুদের কোনো স্থান হবে না আমাদের দেশে। এরা ভারত ছাড়া কিছুই বুঝে না, এরা আমাদের ইসলাম সংস্কৃতিকে নষ্ট করছে, তাহলে কেন এরা থাকবে আমাদের দেশে?
শুনে আমি বললাম, “ বাংলাদেশ যেমন আমাদের দেশ, ঠিক ওদেরও দেশ। কীভাবে সম্ভব নিজের দেশ ছেড়ে অন্যদেশে গিয়ে থাকা? তাছাড়া ওরা যেমন আমাদের দেশে সংখ্যালঘু, ঠিক আমি আর আপনি কিন্তু এই দেশে সংখ্যালঘু। কই এই দেশে তো এগুলো নিয়ে মানে ধর্ম নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই! উল্টো আমি আর আপনি শান্তিতে বসবাস করছি এই খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশে। শুধু তাই নয়, সেই সাথে সম্মানের সহিত বসবাস করছি এইদেশে, একটি বারের জন্যও এই সংখ্যালঘু শব্দটি তাড়া করেনি। আর তাছাড়া আপনি যেহেতু ধর্ম নিয়ে এতো চিন্তিত, তাহলে দেশে চলে যান, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে যান, সংখ্যালঘু হয়ে এই দেশে কেন বসবাস করছেন?”
তখন তিনি বললেন, “এই দেশে তো মুসলিমরা অনেক ভালো আছে। আর তাছাড়া আমরা তো ওদের ধর্মতে বাঁধা দিচ্ছি না, আর ওরাও বাঁধা দিচ্ছে না। ওরা ওদের ধর্ম পালন করছে, আর আমরা আমাদের ধর্ম পালন করছি। এই দেশে সবাই সবার ধর্মকে শ্রদ্ধা করে।”
আমি বললাম, “আপনি যদি পারেন এই দেশে অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে, তাহলে নিজের দেশে করতে সমস্যা কী? ইংল্যান্ডে আসার পর দেখলাম, প্রতিটি গলি বা জায়গাতে মসজিদ বা মাদ্রাসা আছে এবং তার কাছাকাছি বা কিছুদূরেই হয় পাব আর না হয় ক্লাব রয়েছে। একটিবারের জন্য তো এইখানে কোনো মুসলিম ব্যক্তি বাঁধা দেয়নি কেন মসজিদের সামনে বা কাছাকাছি পাব বা ক্লাব থাকবে! এমনকি ইংল্যান্ডে ঐতিহ্য হিসেবে অনেক ভাস্কর্য রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, তাই বলে কি আপনি পারছেন এই ভাস্কর্যগুলোকে মূর্তি বলে ভেঙে দিতে??? এই দেশে যদি আমরা সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে পারি, তাহলে নিজের দেশে কেন আমরা অশান্তি সৃষ্টি করি ধর্ম নিয়ে!!
আসল কথা আমাদের স্বভাবে দাঁড়িয়েছে অন্য ধর্মকে অপমান করা। নিজের ধর্ম সবার উপরে, এই মনোভাব যতোদিন থাকবে, ততদিন পর্যন্ত অন্য কোনো ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতাই থাকবে। আর তার সাথে যদি থাকে গোঁড়ামি ও কুসংস্কার, তাহলে তো কথাই নেই। সবার উচিত অন্য ধর্মের প্রতি বিরুপ মনোভাব প্রকাশ না করে বরং সম্মান করা।
সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করে শুধু যে অন্য ধর্মকে বিনাশ করার চেষ্টা করছি তা নয়, সেই সাথে নিজের ধর্মকেও টেনে নিচে নামাচ্ছি। তাই অন্যকে ঢিল মারার আগে নিজেরেও খেয়াল রাখা উচিত একই রকম বিপদের মধ্য দিয়ে তুমিও যেতে পারো।