অলিভিয়া শীল:
নারীবাদী— সেই শব্দ। যত ক্লিশে, তত মুচমুচে। সেই ট্যাগ, যা নিতে অনেকেই পিছপা। কেন? তাঁরা বোধ হয়, রাজতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র, গণতন্ত্রের (রাজার/পিতার/জনগণের শাসন) সাথে নারীবাদকে গুলিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের জ্ঞাতার্থে—
১) নারীবাদ মানে নারীতন্ত্র বা নারীর শাসন নয়।
২) পিতৃতন্ত্রের বিকল্প মাতৃতন্ত্র নয়।
৩) নারীবাদ সমস্ত লিঙ্গবৈষম্য থেকে মুক্তির পথে যাত্রা। বিশদে জানতে বই (book) পড়ুন, Facebook নয়।
শিরোনামে নারীবাদী। তবে, আলোচ্য নারীবাদ নয়। এই লেখার মূল বিষয় দুটো— ক) সেক্স ও জেন্ডার (Sex & Gender) এবং খ) বৈচিত্র্য ও বৈষম্য (Diversity & Difference/Inequality)।
সেক্স ও জেন্ডার
সেক্স— জৈবিক/দেহগত (biological/physical) লিঙ্গ-বৈশিষ্ট্য। উদা-পুরুষ, নারী (male, female)।
জেন্ডার— সামাজিক/মনোসামাজিক (social/psychosocial) বৈশিষ্ট্য। উদা- পুরুষালি, মেয়েলি (masculine, feminine)।
বিবাহসহ সামাজিক সব প্রথা, রীতি-নীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, কর্মক্ষেত্র, ধর্মগ্রন্থ, ধর্মীয় আচার, সাহিত্য-সিনেমা-সিরিয়াল সহ সব শিল্পমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, শিক্ষাব্যবস্থা, ভাষা, পোশাক— এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে gender stereotype/biasness নেই। আর, তার মূলে জৈবিক বৈশিষ্ট্য এক আনা হলে, মনো-সামাজিক পনেরো আনা। জীবন থেকে কুড়িয়ে নেওয়া ক’টা উদাহরণ—
• “মেয়েলি”— রান্না, ঘরের কাজ, সাজগোজ, পুতুল খেলা, কান্না, আবেগপ্রবণতা, সেবা, গোলাপি রং, কোমলতা, লজ্জা, ঘরোয়া, আর্টস গ্রুপ, শপিং, সংসার, সন্তান পালন, নির্ভরশীলতা, নিষ্ক্রিয়তা…
• “পুরুষালি— অর্থোপার্জন, পেশিশক্তি, নেশা, গালিগালাজ, আবেগহীনতা, অগোছালো, নীল রং, সায়েন্স গ্রুপ, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, কর্তৃত্ব, যৌনতা, নেতৃত্ব, বন্দুক, আউটডোর স্পোর্টস, সক্রিয়তা, টেকনিক্যাল কাজ, পরিবারের ভরণ-পোষণ, নিজের যত্ন না নেওয়া…
কোনো মেয়ে বা ছেলের মধ্যে এর বিপরীত লক্ষণ দেখা দিলেই, তাকে “পুরুষালি মেয়ে” বা “মেয়েলি পুরুষ” ব’লে দেগে দেওয়া হয়। এমন দেগে দেওয়া/আরোপ করা বহু আছে, বিভিন্ন আছে, তালিকা দীর্ঘতর করলাম না।
এবার, কিছু শব্দ, যেগুলো শুনলে আক্ষরিক অর্থে বিবমিষা জাগে— ‘মেয়েছেলে’ (মেয়ে আবার ছেলে! কী আশ্চর্য!), ‘কন্যাদান’ (ব্যাসবাক্য— কন্যারূপ বস্তুটিকে দান! মানে হাতবদল আরকি), ‘গোত্রান্তর’ (ওহহ! গড!!), বংশরক্ষা (এখন নাকি একুশ শতক!)…
শেষে, শোনা কিছু উক্তি থুড়ি বাণী—
১) “লজ্জা নারীর ভূষণ”
২) “সেবা নারীর ধর্ম”
৩) “নারীত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ মাতৃত্বে”
৪) “সংসারই মেয়েদের প্রকৃত স্থান”
৫) “শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের আসল বাড়ি”
৬) “মেয়েরা পরধন। পরের ঘরে যাওয়ার জন্যই তাদের জন্ম”
৭) “মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষের মতো থাক”
৮) “মেয়েরা মেয়েদের শত্রু”
৯) “পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা”
১০) “বারো হাত কাপড়েও কাছা হয় না”
১১) “কুড়িতেই বুড়ি”
১২) “হাঁটুর নিচে বুদ্ধি, চুলের নিচে ফাঁকা”। “স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী”।
১৩) “বিবাহিত মহিলার গার্জেন তার স্বামী” (ধরণী দ্বিধা হও…)
১৪) “যতই লেখাপড়া/চাকরি কর, সেই তো হাতা খুন্তি নাড়তে হবে”
১৫) “…সেই তো নিচেই শুতে হবে” (বাণী…বাণী…)
১৬) “নারী খেত, পুরুষ তাতে বীজ বপন করে” (সেরা উক্তি)
১৭) “সোনার আংটি আবার বাঁকা”
১৮) “বয়েজ ডোন্ট ক্রাই”
১৯) “ফুটবল ইজ আ ম্যান্স গেম”
২০) “সতীর দেবতা পতি, জীবনের সার/ পূজিতে এসেছি ভবে চরণ তোমার” (সেরা বাণী)
আর কত বলব !
শুধু দুটো পয়েন্ট বিশেষভাবে উল্লেখ্য—
১) পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপন— কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট… “ফর্সা, ঘরোয়া, গৃহকর্মনিপুণা পাত্রী চাই”। “প্রকৃত সুন্দরী ছাড়া যোগাযোগ নিষ্প্রোয়জন”। “চশমা ছাড়া পাত্রী চাই”। “পাত্রীর ভাই থাকা আবশ্যক”। (ওহহ! নো! আমাকে কেউ একটু বিষ দেবে?)
২) বিবাহ ব্যবস্থা/প্রথা— পুরুষতন্ত্রের মূল স্তম্ভ। Gender biasness-এর ভুরি ভুরি উদাহরণ এখানে। তার মধ্যে কয়েকটা— বিয়ের পর মেয়ের বাড়ি, পদবী, গোত্র বদল। মেয়েদের বিবাহ-চিহ্ন বহন (সিঁদুর-শাঁখা-পলা-মঙ্গলসূত্র)। পুত্র মানে বংশধর। কন্যা নয় (পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য!)।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে জেন্ডার স্টেরিওটাইপ কত ব্যাপ্ত ও ভয়ানক! ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, ভ্রুণহত্যা, বৈধব্য, পণপ্রথা নিয়ে লিখলাম না। এখানে যে ক্ষুদ্র খণ্ডচিত্র উঠে এলো, তা এতো ভয়ানক, যে, পূর্ণ চিত্রের আভাস মাত্র দেওয়ার সাহস হলো না।
পুনশ্চ— এমন অনেক জ্ঞানী আছেন, যাঁরা এই সমস্ত জেন্ডার স্টেরিওটাইপের মূলে বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক ও জৈবিক কারণ আবিষ্কারে সক্ষম। আর, কোনো কিছু বিজ্ঞানঅসম্মত প্রমাণ করার যে অলৌকিক আনন্দ, তা কী বলে বোঝানোর ! তাঁদের ক্ষুরে অগ্রিম দণ্ডবৎ।
বৈচিত্র্য ও বৈষম্য
যাঁরা বলেন, প্রকৃতিতে সাম্য নেই, তাঁদের হিতার্থে— ১) প্রকৃতিতে যে সাম্য আছে, তাইই নয়, প্রকৃতিই সাম্যের শিক্ষক। ২) তাঁরা কী “Law of Natural Justice” কথাটা শুনেছেন?
প্রকৃতিতে যা আছে, তা বৈচিত্র্য; বৈষম্য নয়।
নারী-পুরুষের মধ্যেও তেমন কিছু পার্থক্য/বৈচিত্র্য আছে, যা জৈবিক/দৈহিক। সেই জিন-ক্রোমোজোম-হরমোনের প্রাকৃতিক লীলাকে যাঁরা জেন্ডার পলিটিক্সের ঘৃণ্য খেলায় রূপান্তরিত করেছেন, তাঁদের লাল-নীল-হলুদ-সবুজ সেলাম।
প্রাচীনকালে নারী কত পেশিবহুল ছিল, সুদূর ভবিষ্যতে কত শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তা আজ আমার আলোচ্য নয়। আমি শুধু বর্তমানের ছবি আঁকবো।
পুরুষের উচ্চতা, ওজন, পেশিশক্তি, এনার্জি বেশি। তার হাঁটা দ্রুততর। সে ক্ষিপ্রতর। পেশিনির্ভর যে কোনো কাজে সে দক্ষতর। পুরুষ ও নারীর কয়েকটি হরমোন পৃথক। পুরুষের পিরিয়ড হয় না। সে সন্তান ধারণে সক্ষম নয়। অর্থাৎ পুরুষ ও নারী সমান নয়।
১) এই জৈবিক পার্থক্যগুলি মেনে নিতে যাঁরা অক্ষম, তাঁরা প্লিজ কাউন্সেলিং করান।
২) ঠিক এর বিপরীতে, যাঁরা, এই জৈবিক পার্থক্য/বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের জীবনকে সম্পূর্ণ দুটি পৃথক পৃথিবীতে (ঘর-বাহির) পরিণত করতে ব্যস্ত, তাঁদের বিনীতভাবে জানাই, একুশ শতক আপনাদের জন্য নয়।
৩) যাঁদের কাছে পুরুষতন্ত্র প্রকৃতিসম্মত, অত্যাচারহীন পুরুষতন্ত্র কল্যাণকর, যাঁদের ধারণা, শুধু দৈহিক পার্থক্যের উপর এটি প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা শিশুর সারল্যে দিবাস্বপ্ন দেখে জীবন কাটান। তাঁদের অ-বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। হে ‘তবক-রাংতা-মোড়কে আপ্লুত মানব’, এই তন্ত্র “বিষ কুম্ভং পয়োমুখম্” ছাড়া কিছু নয়।
৪) যাঁরা ভাবেন, XX-এর আঙুল সরু বলেই সে বড়ি/আচার দিয়ে, চা পাতা তুলে, টাইপ ক’রে, আর, XY-এর পেশি পুষ্ট বলে সে মাল তুলে, ট্রাক চালিয়ে, ট্রেকিং ক’রে জীবন কাটাবে, তাঁদের কাছে সবিনয় নিবেদন— এসব ভেবে বৃথা আয়ুক্ষয় করবেন না। এসবের জন্য উন্নতমানের IQ-aptitude-attitude-achievement-personality test আছে। Just chill !!
৫) এত কিছুর পরও যাঁরা পৃথিবীকে অহরহ পুরুষ-নারী, ফর্সা-কালো, শহুরে-গ্রাম্য, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরীব, আস্তিক-নাস্তিক, হিন্দু-অহিন্দু, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ, বাঙাল-ঘটি……এমন আরও বহু ভাগে দ্বিধাবিভক্ত (dichotomy) ক’রে ফেলছেন, তাঁদের জন্য তিনটি শব্দ— “Grow up guys”।
৬) আর, যাঁরা অন্য প্রাণী ও মানুষের জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ তুলনা করতে ভালোবাসেন, তাঁরা প্লিজ মনে রাখবেন, শুধু আমাদেরই চেতনার রঙে পান্না সবুজ হয়।
অনেককে রাগিয়ে দিলাম। এবার সারাংশ।
সারাংশ: অতঃপর…
১) নারীবাদ মানে নারীর শাসন বা পুরুষবিদ্বেষ নয়। নারী-পুরুষ উভয়েই পুরুষতন্ত্রের Victim। একজন বেশি, আরেকজন কম। পিতৃতন্ত্রের বিসর্জন মানে মাতৃতন্ত্রের আবাহন নয়।
২) নারীবাদ তাই যতটা যুদ্ধ, ততটাই ক্রমবিকাশ (development)। বৈষম্য থেকে সাম্যের পথে যাত্রা। এখানে প্রতিপক্ষ পুরুষতন্ত্র, পুরুষ নয়।
৩) এই সাম্যের পথে প্রাথমিক ভাবে জরুরি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। যা ছাড়া সবই মাঠে মারা যাবে।
৪) কিন্তু, পুরুষতন্ত্র নামক বটবৃক্ষের ছায়া বড় আরামের। সে আমার অভ্যেস। নিরাপত্তা। Comfort Zone । সে আমার আলো গ্রাস করলেও, অপুষ্টির কারণ হলেও, খুব প্রিয়।
৫) তাই, এ জীবন পান চিবানো, সিরিয়ালময়, আলসে দুপুর হবে, না কি চাঁদিফাটা কর্মমুখর দিন (রূপকার্থে)— তা নিজেকেই ঠিক করতে হবে।
৬) এ সাম্যযাপন কঠিন। বিশেষত পুরুষের পক্ষে। এই আরাম, সুবিধা, ক্ষমতা ‘ত্যাগ’…বড় সহজ কী !?
৭) তবু স্বপ্ন দেখি…জৈবিক ছাড়া সব তফাত মিলিয়ে যাক। পুরুষালি ও মেয়েলি শব্দ হারিয়ে যাক। সার্বিক কল্যাণের নামে পুরুষতন্ত্রের ঠাট্টা লুপ্ত হোক। বৈষম্য থেকে সাম্যের পথে যৌথ যাত্রা জয়যুক্ত হোক। সাম্য ছাড়া কাম্য কী!
শেষে বলি, সেই অ-ক্লিশে, অমর সঙ্গীতের দুকলি… “…… I’m a dreamer. But I’m not the only one. I hope someday you’ll join us……”
লেখক: অলিভিয়া। কলকাতা নিবাসী। মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।বর্তমানে কলকাতায় কর্মরত