“তবুও জীবন সুন্দর”

‌হে‌লেনা অাফ‌রোজ:

নদীটার নাম ‘সাসকাচুওয়ান রিভার’, নামটা অামার ঠিক পছন্দ না, কিন্তুু নদীটা ভীষণ পছ‌ন্দের। সব নদীই কম বে‌শি সুন্দর, কিন্তুু এই নদীটার ম‌ধ্যে অন্যরকম কিছু একটা অা‌ছে, কেমন যেন একটা মায়া লাগা‌নো, পা‌নিটা এতোটাই স্বচ্ছ, নি‌চের ন‌ুড়ি পাথরগু‌লোও দেখা যায়।

অামার বাসার ঠিক পা‌শেই নদীটা, নদীর উপ‌রে সুন্দর একটা পার্ক অা‌ছে, অা‌রও মজার ব্যাপার হলো পা‌র্কের ম‌ধ্যে বসার জন্য যে বে‌ঞ্চিগু‌লো অা‌ছে, সেগু‌লোর একটা‌তে অাবার অামার নাম লেখা, হে‌লেনা-(অবশ্য এটা যে অা‌মি না, সেটা অা‌মি ভালো ক‌রেই জানি,‌ কিন্তুু নামটা তো অামার)।

একটু সময় পে‌লেই অা‌মি নদীটার কা‌ছে গি‌য়ে ব‌সে থা‌কি, এটা এই শহ‌রে অামার সবচাই‌তে প্রিয় একটা জায়গা, নিজের সাথে একটু অাপন ক‌রে কিছু সময় কাটা‌নো, নি‌জের সা‌থে কথা বলা, একটু মন খু‌লে হাসা, বুকটা হালকা ক‌রে ক‌ান্না করা, এটাই থা‌কে উ‌দ্দেশ্য।

য‌দিও বে‌শিরভাগ সময়ই এই উ‌দ্দেশ্য সফল হয় না, বরং এই একান্ত অাপন সময়গু‌লো‌তে কিছু ঘটনা বা কিছু মানুষ কোন রকম পার‌সোনাল বা স্পেশাল ইনভাই‌টেশন ছাড়াই মাথার ম‌ধ্যে ঢু‌কে প‌ড়ে, তখন চিন্তা ভাবনাগ‌ু‌লো শুরু হয় অন্যরকম।

এটা কেন এই রকম হই‌লো, একটু অন্যরকম হই‌লে কী সমস্যা হ‌তো, ও কেন এরকম কর‌লো, অা‌মি তো ব‌লি‌নি যে অাকাশ থে‌কে চাঁদটা পে‌ড়ে দাও, বা এটাও অাবদার ক‌রি‌নি যে, তোমার দুইটা কিড‌নি থে‌কে অামা‌কে একটা দি‌য়ে দাও, মানুষ তো একটা কিড‌নি নি‌য়েও বাঁচে, তবুও কেন সম‌য়ের সা‌থে সাথে দূরত্বটা এতো বে‌ড়ে ‌গেল!

মা‌ঝে মা‌ঝে তো হিসাব কিতাবগু‌লো এতোটাই জ‌টিলতর হ‌য়ে যায় যে, ম‌নে হয় এই হিসাবটা মেলা‌নোর চাই‌তে নদী‌তে ঝাঁপ দেয়াটা অ‌নেক সহজ হ‌বে, কিন্তুু ভালম‌তো সাঁতার জা‌নি না ব‌লে এই সহজ কাজটাই অার করা হয় না।

অামরা যে স‌ত্যিই জীবনটা‌কে কতোটা ভালবা‌সি, এটা বোধহয় তারই একটা প্রমাণ, এজন্য এখা‌নেই শত অ‌ভিমান, অ‌ভি‌যোগ, রাগ, কান্না, ভালবাসা। জীব‌নের সব‌চে‌য়ে বড় স‌ত্যিটা হ‌চ্ছে মৃত্যু, কিন্তুু সেটা নি‌য়ে অামা‌দের তেমন কোনো মাথাব্যাথা বা অা‌য়োজন নেই, মা‌নে যখন অাস‌বে তখন দেখা যা‌বে টাইপ ভাব।

‌কিছু‌দিন অা‌গে যখন হস‌পিটাল থে‌কে বের হ‌চ্ছিলাম বরাব‌রের মতো বু‌কের ম‌ধ্যে একগাদা কষ্ট অার হাজা‌রো অ‌ভিমান নি‌য়ে, হঠাৎ ক‌রে খুব সুখি সু‌খি‌ চেহারার একটা ছে‌লে অামার সা‌থে লিফ‌টে অাসলো, অা‌মি সারাটা সময় ছে‌লেটার মুখের দি‌কে তা‌কি‌য়ে তা‌কি‌য়ে ভাব‌ছিলাম ছে‌লেটা কতো সু‌খি, এর ম‌নে হয় কোন কষ্টই নেই, অার তখন নি‌জের জন্য কষ্টটা এতো বে‌শি বোধ হ‌চ্ছিল যেন বোবা হ‌য়ে যা‌চ্ছিলাম। এরপর লিফট থে‌কে নাম‌তেই অামার চোখ পড়লো ছে‌লেটার পা‌য়ের দি‌কে, অা‌মি মুহূর্তেই চোখটা স‌রি‌য়ে অাবা‌রো ছে‌লেটার মু‌খের দি‌কে তাকি‌য়ে রইলাম যতটা দূর পর্যন্ত দেখা গেল তা‌কে, ছে‌লেটার দু‌টো পা-ই নেই, হাঁটুর নিচ থে‌কে দুটো পা-ই অা‌র্টি‌ফি‌শিয়াল।

তখন মুহূর্তেই অামার চিন্তা ভাবনাগু‌লো একটু অন্যরকম হ‌য়ে গেল, অা‌মি অামার নি‌জের পা দু‌টো গভীর মমতায় একবার ছু‌ঁয়ে দেখলাম এবং সৃ‌ষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
অামার প্রচণ্ড ইচ্ছা কর‌ছিল ছে‌লেটা‌কে ডে‌কে ব‌লি, অা‌মি কি তোমার সা‌থে কিছুক্ষণ কথা বল‌তে পারবো? তোমার গল্পটা স‌ত্যিই শুন‌তে চাই অা‌মি।

সব মানু‌ষের জীব‌নেরই একটা গল্প থা‌কে, সবার গল্পগু‌লোই অালাদা, কা‌রও সাথে কা‌রও গ‌ল্পের কোনো মিল নেই, বরং একটা জায়গা‌তে সব‌চে‌য়ে বড় পার্থক্য অা‌ছে সেটা হলো, কিছু গল্প একটু বে‌শিই বো‌রিং, যেমন অাপ‌নি যা চা‌চ্ছেন, তাই সা‌থে সা‌থে হা‌জির হ‌য়ে যা‌চ্ছে অাপনার সাম‌নে, কোনো সমস্যা নেই, কোনো অপেক্ষা নেই‌, কোনো ক‌ষ্টের ছোঁয়া নেই, শুধুই অফুরন্ত সু‌খের ছড়াছ‌ড়ি, জীব‌নের অ‌নেকগু‌লো সুন্দর রং (নীল, কা‌লো, বেগু‌নি) কখ‌নোই বোধহয় অাপনি ছু‌ঁয়ে দেখ‌তে পা‌রেন‌নি, অাবার কিছু মানুষের জীব‌নের গল্পটা হয় ঠিক এর উ‌ল্টো, এড‌ভেঞ্চারে ভরপুর, মা‌ঝে মা‌ঝে এড‌ভেঞ্চারের মাত্রাটা এতোই বে‌শি হ‌য়ে যায়, ম‌নে হয় চিৎকার ক‌রে ব‌লি, লাইফটা একটু বো‌রিং ক‌রে দাও প্লিজ।

ওই বো‌রিং জীবনটার ম‌ধ্যে স‌ত্যিকা‌রের সু‌খের ছোঁয়া কতখা‌নি, অাম‌ার ঠিক জানা নেই, কারণ সৃ‌ষ্টিকর্তা যে‌হেতু সব‌কিছুই সৃ‌ষ্টি ক‌রে‌ছেন জোড়া‌তে জোড়া‌তে, সেখা‌নে সুখ অার দুঃখ একসা‌থেই থাক‌বে এটাই তো নিয়ম, অার নিয়‌মের ব্যতিক্রম কোন কিছুই খুব ভালো হওয়ার কথা না, সুখটা‌কে সু‌খের মতো উপল‌দ্ধি করার জন্যই অাপনার দুঃখটা‌কে দরকার।

কা‌রো সা‌থে কথা বলা বা কা‌রো কথা ‌শোনা এই দু‌টো কাজই অা‌মি খুব ভালবা‌সি, সুতরাং খুব নিখুঁতভা‌বে করার চেষ্টা ক‌রি, কা‌রো কা‌রো সা‌থে কথা শুধু হাই হ্যা‌লোতেই শেষ হয়, অাবার কিছু কনভার‌সেশন স‌ত্যিই অনেক দূর পর্যন্ত যায়।

সে‌দিন বা‌সে এক বয়স্ক ভদ্রম‌হিলার সা‌থে কথা হ‌চ্ছিল, ম‌হিলার ছে‌লে মে‌য়েরা সবাই অালাদা অালাদা শহ‌রে থা‌কে, সবাই নি‌জে‌দের নি‌য়ে ব্যস্ত, মা‌ঝে মা‌ঝে ও‌কে দেখ‌তে অা‌সে, এরপর অা‌রো অ‌নেক রকম কথা, ও বললো, তোমার স্কার্ফটা খুব সুন্দর, অা‌মিও বললাম, তোমার এটা সুন্দর ওটা সুন্দর, ওকে অামার ফ্যা‌মি‌লির কথা বললাম, ও হঠাৎ জান‌তে চাই‌লো অা‌মি কার মতো দেখ‌তে, বাবার ম‌তো? নাকি মা এর ম‌তো। প্রশ্নটা যে‌হেতু খুব একটা কমন না, সো খুব ভাল লাগলো শু‌নে, বললাম, অা‌মি অামার বাবার ম‌তো দেখ‌তে।

সেইম প্রশ্নটা অা‌মি ওকে করার অা‌গেই ও বললো, অা‌মিও দেখ‌তে অামার বাবার মতো, অা‌রো বললো, ওরা ম‌নে ক‌রে ‌যে মেয়েরা বাবার মত‌ দেখ‌তে হ‌লে তারা খুব লা‌কি হয়, অা‌মি বললাম, এই কথাটা তো অামরাও মা‌নি।
অা‌মি ও‌কে বললাম, তোমার কেন নি‌জে‌কে লা‌কি ম‌নে হয়? যে কারণটা ও বললো সেটা হলো,
ও ওর বর্তমান হাজ‌বে‌ন্ডের ছয় নাম্বার ওয়াইফ, অার ওদের ম‌তে ‌মে‌য়েরা ব‌াবার মতো দেখ‌তে হওয়াটা যেমন সৌভাগ্যের, তেম‌নি ছয় নাম্বার ওয়াইফ‌দেরকেও বলা হয় লা‌কি, সো ও খুব লা‌কি।

‌হিসাবটা য‌দিও একটু জ‌টিল অামা‌দের কা‌ছে, কিন্তুু অাপনার বা অামার তথাকথিত একটা হিসাব মিলা‌নোর চাই‌তে,, একজন মানুষ‌ যে এ‌তেই নি‌জে‌কে সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতী ম‌নে কর‌ছে, তাকে আপনি রুখবেন কী করে!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.