কাজেরও কি লিঙ্গ থাকে?

ফারহানা আফরোজ রেইনী:

ইতি একজন চাকরিজীবী গৃহিণী। আমরা সবাই নিশ্চয় ভাবছি, এটা আবার কেমন পেশা হলো। হবে হয় চাকরিজীবী, না হয় গৃহিণী। চাকরিজীবী গৃহিণী আবার কেমন কথা! ইতি যে একজন চাকরিজীবী গৃহিণী, তা সে শিখেছে তার ছয় বছর বয়সী ছেলের কাছ থেকে। গল্পটা তাহলে বলেই ফেলি।

ইতির ছেলের স্কুল এ আমার মা বিষয় এ প্যারাগ্রাফ শিখিয়েছে এবং সবাইকেই লিখে দিয়েছে আমার মা একজন গৃহিণী। রাতে বাসায় ফিরে ইতি যখন ওর খাতাগুলো দেখছিল, তখন তার ছেলের প্রশ্ন “মা, গৃহিণী মানে কি?” ইতি খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, গৃহিণী হলো যে মা বাসায় থাকেন, বাসার কাজ করেন, সবার দেখাশুনা করেন তিনি। তবে ইতি যেহেতু চাকরি করে, তাই তার ছেলেকে বললো, তুমি লিখতে পারো, আমার মা একজন চাকরিজীবী। ফলাফল হিসেবে সে পরদিন তার ছেলের খাতায় যা দেখতে পেল, তা হলো “আমার মা একজন চাকরিজীবী গৃহিণী”।
এই রকম লেখার কারণ জানতে চাইলে তার ছেলে বললো, মা তুমি দিনে চাকরি করো, আর রাতে বাসায় ফিরে তো বাসার কাজ করো, আমাদের দেখাশুনা করো, তাহলে তো তুমি দুইটাই। তাই তুমি চাকরিজীবী গৃহিণী। অকাট্য যুক্তি। খণ্ডানোর কোনো অবকাশ নেই।

ইতি আসলে এই রকম করে কখনও ভাবেনি। তবে অফিস থেকে ফিরে তাকে যে কাজগুলো করতে হতো, তার মনে হতো এগুলো বুঝি তার জন্যই নির্ধারণ করা। সে ভেবে পায় না, কেন এইগুলো তারই করতে হবে। সে যখন ঘরে ফিরে ক্লান্ত শরীরে ঘরের কাজ করতে থাকে, তারই পাশে তার স্বামী সময় কাটানোর জন্য টিভির চ্যানেল ঘুরাতে থাকে, না হয় বই পড়ে, অথবা বাইরে যায় আড্ডা দিতে। এসব দেখে ইতির কেবলই মনে হয়, কাজেরও কি তবে লিঙ্গ আছে? এই যেমন স্ত্রী লিঙ্গ কাজ এর মধ্যে রয়েছে, চা বানানো, রান্না করা, খাবার টেবিল গুছানো, খাবার পর টেবিল পরিষ্কার করা ইত্যাদি।

সে যদি কখনো খুব ক্লান্ত হয়ে তার স্বামীকে বলে, ‘আজকে রান্না করতে পারছি না “ – উত্তরে তার স্বামীর কাছ থেকে সে কখনোই শোনেনি যে, ঠিক আছে থাক, রান্নাটা আজ আমি করি। বরং মাঝে মাঝে শুনেছে, ঠিক আছে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে আনছি। তাই সে ভাবে, খাবার কিনে আনাটা কি তবে পুরুষলিঙ্গ কাজ? তাহলে ব্যাপারটা যা দাঁড়ায়, তা হলো খাবার রান্না করা একটি স্ত্রীলিঙ্গ কাজ, আর তার বিপরীতে খাবার কিনে আনাটা পুরুষ লিঙ্গ কাজ।

আমরা নিজেরাও আসলে এই ভাবেই অভ্যস্ত এবং কারণে-অকারণে নিজেরাই এই বিভক্তিটা করে ফেলি। এই যেমন একদিন আমি রান্না করছিলাম, আর তখন আমার ছেলে আমার কাছে এসে বললো, মা, আমি তোমার সাথে কাজ করতে চাই। নিজের অজান্তেই আমি বলে ফেলেছিলাম, বাবা, ছেলেদের রান্না ঘরে আসতে হয় না। অর্থাৎ রান্নাঘরে কাজ করাটা স্ত্রীলিঙ্গ কাজ।

আবার আমরা সব সময়ই একটা কথা শুনে থাকি, ছেলেদের কাঁদতে হয় না। কেন? কাঁদাটা কি স্ত্রী লিঙ্গ কাজ? ছেলেরা যদি মানুষ হয়, আর আবেগ অনুভুতি সম্পন্ন হয়, তাহলে ছেলেরা কাঁদবে না কেন? আবার ছেলেরা যদি রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করে, তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যাটা আসলে আমাদের নিজেদের তৈরি। বিয়ের পর ছেলেকে রান্না ঘরে ঢুকে কাজ করতে দেখলে মা হয়তো হায় হায় করে উঠবে। যে ছেলেকে সে এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়াতে শেখাননি, সে কিনা রান্নাঘরে!! কী সর্বনাশ!!

আমরা আমাদের পাঠ্য পুস্তকে পড়ে থাকি স্ত্রী লিঙ্গ শব্দ আর পুরুষ লিঙ্গ শব্দ। কিন্তু স্ত্রী লিঙ্গ কাজ বা পুরুষ লিঙ্গ কাজ বলে কিছু শিখি না বা এরকম কিছু নেই। তাহলে কেন এই বিভক্তি এতো কঠোরভাবে মেনে চলা?

টেলিভিশন এ বাচ্চাদের অনুষ্ঠানের একটা বিজ্ঞাপনে দেখায়, একটা ছেলে দৌড়ে এসে একটা মেয়েকে কিছু একটা দিলো যে কিনা চুলার সামনে বসে ছিল। এরপর মেয়েটি চুলায় আগুন দিলো, রান্না করলো এবং রান্না শেষে তার দুই পাশে বসে থাকা দুইটি ছেলেকে খেতে দিলো। বিজ্ঞাপনের চরিত্রগুলো সবগুলোই ছিল বাচ্চা। তার মানে বাচ্চাকাল থেকে আমরাই শেখাচ্ছি কাজের এই লিঙ্গ ভেদ। এমন যদি দেখানো যেত ছেলে দুটো পাশে বসে না থেকে মেয়েটির সাথে কাজ করছে। তাহলে কি খুব খারাপ হতো বা সমাজ সংস্কৃতি বিরোধী হতো?

আমরা যারা আজকে মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদের কাজ করা নিয়ে কথা বলছি, আমি জানি না ২০ বছর পর আমাদের অবস্থানটা কিরকম হবে। ছেলের বৌ এর সাথে ছেলেকে রান্না করতে দেখলে আমাদের অনুভূতি কেমন হবে আজ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি বলতে পারছি না। তবে এই মুহূর্তের আমি মনে-প্রাণে এইটাই চাই যেন ছেলের বৌ এর সাথে ছেলেকে রান্না করতে দেখলে মুখ থেকে “সর্বনাশ” কথাটা না বেরিয়ে, যেন বেরিয়ে আসে “বাহ্! এই তো চাই”।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.