মহসিনা আফরোজ ইলা:
আমাদের সময়ে ছোটবেলায় মোটামুটি সবাইকে সবচেয়ে বেশিবার যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে সেটা হচ্ছে, বড় হয়ে কী হতে চাও? আমার নিজের কাছে এটা খুব জটিল প্রশ্ন লাগত। আমি অনেক ভেবেও ঠিক করতে পারতাম না, আমি আসলে কী হতে চাই। আমার বলতে ইচ্ছে করত, কিছুই হতে চাই না। ভয়ে বলতে পারতাম না। পাছে বড়দের কাছে বকা খেতে হয়। অবশ্য আমার সাত বছরের সন্তান এই ভয় থেকে মুক্ত। ওকে এই প্রশ্ন করলে ও বিন্দাস বলে দেয়, কিছু হতে চাই না।
তো আমাদের সময়ে এই ‘কী হতে চাও’ এর কমন উত্তরগুলো ছিল, ডাক্তার হতে চাই বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই অথবা শিক্ষক হতে চাই, ইত্যাদি, ইত্যাদি। ছেলে বাচ্চা, মেয়ে বাচ্চা উভয় মোটামুটি একই রকম উত্তর দিত। তবে মেয়ে বাচ্চাদের সে সময় কেউ না বলে দিলেও বড় হতে হতে তারা জানতে পারে আসলে জীবনের এইসব লক্ষ্য উদ্দেশ্য অপশনাল। তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য, একটা ভাল বিয়ে হওয়া (মেয়েরা বিয়ে করে না, তাদের বিয়ে হয়) এবং সন্তানে জন্ম দেওয়া। তা না হলে সে যদি ক্যরিয়ারের শিখরেও পৌঁছে যায়, নাসার মহাকাশ বিজ্ঞানীও হয়, সমাজে কদর পাবে না। আত্মীয়, স্বজন, পাড়া, প্রতিবেশি থেকে শুরু করে দেশ সুদ্ধ লোক তার বাবা, মাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে আসবে, তারা কত দুর্ভাগা, তাদের মেয়ের এখনো বিয়ে হয়নি! বাবা-মা’র ঘাড়ে বোঝা হয়ে আছে। অথচ সেই মেয়ে হয়ত যে পরিমাণ রোজগার করে তা দিয়ে দুই, চারটা পরিবার অনায়াসে লালন পালন করা যাবে।
আগে মানুষ বলত, মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি। এখনো এই ধারণা খুব একটা পালটেছে বলে মনে হয় না। বিয়ের বাজারে পাত্রপক্ষের প্রথম পছন্দ, বিশ, বাইশ বছরের অনার্স পড়ুয়া মেয়ে। মাস্টার্স পাশ করে ফেললেই সেই মেয়েরা মোটামুটি বাতিলের খাতায় চলে যায়। তাদের বয়স নিয়ে নানান রকম কল্পনা, জল্পনা চলতে থাকে। সম্প্রতি খুব কাছ থেকে দু একটা ঘটনা না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না, এই দেশের তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা এখনো এমন প্রাচীন ধারণা পোষণ করেন। কোনরকমে ডিগ্রীটা কমপ্লিট করে মোটামুটি চাকরি করছে এমন ছেলের পরিবারের কাছেও ধর্না দিতে হয় একটা উচ্চ শিক্ষিত, বড় পজিশনে চাকরি করা মেয়ের পরিবারকে। আবার সেই ছেলের পরিবারও, মেয়ের বয়স, গায়ের রঙ ইত্যাদি অজুহাতে মেয়েকে নাকচ করে দিতে পারে। আমাদের মত দেশেই এটা সম্ভব।
আর উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ পদস্থ ছেলেরা তো এমনই চুজি যে পারলে তারা পুরো বাংলাদেশের বিবাহযোগ্য মেয়েই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বেড়ায়। আমি এমন কয়েকজনকে চিনি যাদের পরিবার উপযুক্ত পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে ছেলেকে মোটামুটি বিয়ের বয়সের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছেন। তবে তাদের রিকোয়ারমেন্ট কিন্তু চেঞ্জ হয়নি। অনিন্দ্য সুন্দরী, একই সঙ্গে ধার্মিক এবং স্মার্ট, নম্র, ভদ্র, সাত চড়ে রা কাড়ে না, অনার্স পড়ুয়া, বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে চাই তাদের। এদিকে ছেলের মাথায় টাক পড়ে গেছে, মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে।
‘ভাল ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেব’ মেয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার এর চেয়ে ভাল সমাধান বুঝি হয় না! অথচ অল্প বয়সে বিয়ে দিলে এক অর্থে মেয়ের শিক্ষা জীবন, পেশা জীবনকেই ঝুঁকির মুখে ফেলা হয়। কিন্তু এটা তাদের কাছে কোন তাৎপর্য বহন করে না। এই যে বাংলাদেশে ডোমেস্টিক ভায়লেন্সের এত উচ্চ হার, যৌতুকের জন্য বাড়ির বউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, এসব ঘটনার জন্য কি এমন মানসিকতার মেয়ের বাবা, মা’রা দায়ী নন? তারা কেন মেয়েকে অন্য পরিবারের কাছে গছিয়ে দিতে চান? বিয়ে করা তো মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ এবং সিদ্ধান্ত হওয়া উচিৎ।
মেয়ের কেন বিয়ে হচ্ছে না? এই চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়া বাবা, মায়ের সংখ্যা চারিদিকে কম নয়। যদিও মেয়ে শান্ত, ভদ্র, লেখাপড়ায় ভাল, কেউ কেউ কর্মক্ষেত্রেও উন্নতি করছে। সারা জীবনে হয়ত বাবা, মাকে কোন রকম দুশ্চিতায় ফেলেনি। অথচ আজ সে বাবা, মায়ের জীবনের সবচেয়ে বড় অশান্তির বিষয়। কারণ, তার বিয়ে হচ্ছে না। পাত্র পক্ষ ফিরিয়ে দিচ্ছে। কত অপমান যে এদেশের মেয়েরা মুখ বুজে সহ্য করে!
এভ্রিলকে নিয়ে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে তা যতটা না আয়োজকদের স্বেচ্ছাচারিতা তার চেয়ে বেশি তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে। সে কেন বাবা মায়ের দেয়া বাল্যবিবাহ মেনে না নিয়ে নিজের পছন্দমতো ক্যরিয়ারের পথে পা বাড়ালো? গাইয়া থেকে এমন স্মার্ট হলো যে একেবারে ইয়ামাহার মতো মোটরবাইক কোম্পানির ব্র্যান্ড আম্বেসেডর! এভ্রিল আসলে একটা চরিত্রহীনা, একটা কুলটা। আমাদের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে এভ্রিলের স্পর্ধা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করা আসলে খুবই কঠিন।
লেখক:উন্নয়নকর্মী