গৃহকর্মি নয়, চাই দায়িত্বশীল ডে-কেয়ার

তামান্না ইসলাম:

প্রবাসে অনেক বাঙ্গালি নারীর মুখেই শুনি দেশের যেসব সুযোগ-সুবিধা, আরাম তারা তীব্রভাবে মিস করেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো একটি ‘বুয়া’ বা গৃহকর্মি।
‘আহ, দেশে কী আরাম, সকালে ঘুম থেকে উঠলেই গরম এক কাপ চা হাতে বুয়া।’ অথবা, ‘দেশে গেলে এক গ্লাস পানিও ঢেলে খেতে হয় না’, কিংবা ‘দেশে বাচ্চাদের কোন খবরই রাখতে হয় না, আম্মার বাসায় এতো এক্সপার্ট একটা মেয়ে আছে’, ……’দেশে, আমাদের বুয়াটা এতো ভালো মাথায় তেল মালিশ করে’, ‘আমাদের বুয়াটা এতো মজার মজার সব খাওয়া রান্না করে’ ….. ইত্যাদি।

কথা পুরোপুরি মিথ্যা নয়, আমাদের দেশে এতো অল্প খরচে এমন আরাম সহজলভ্য, যা প্রবাসে বিরাট বিলাসিতার পর্যায়ে গণ্য হয়, উন্নত দেশে এই আরাম কল্পনার বাইরে। আমরা এই কালচারেই বড় হয়েছি। গ্রামেই হোক, শহরেই হোক সর্বত্র এই প্রথা। কেউ বলেনি এটা শ্রেণী বিভেদ, কেউ শেখায়নি এই প্রথার সাথে জড়িত আছে শিশু শ্রম, জড়িত আছে অনেক নারীর লাঞ্ছনার নীরব ইতিহাসও। কত সামান্য অর্থের বিনিময়ে কী অপরিসীম শ্রম কিনি আমরা, শুধু শ্রম নয়, অনেকটা যেন গোটা মানুষটাকেই কিনে ফেলি।

আশার কথা, সময় পাল্টাচ্ছে। এই খেটে খাওয়া অশিক্ষিত মানুষগুলো কিছুটা হলেও শিক্ষার আলো পাচ্ছে, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এবং নিজেদের অবস্থান পাল্টাতে চেষ্টা করছে। তাই আজকাল ঢাকা শহরেও ঘরে ঘরে হাহাকার, উপযুক্ত গৃহকর্মির প্রচণ্ড আকাল। বিদেশে যারা অনেকদিন আছেন, তারা যদিও এই কালচারের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন এবং তাদের স্মৃতিতে সেই আরামের সুখ স্মৃতিটুকু রয়ে গেছে, কিন্তু দেশে গেলে এখন তাদের প্রায় সবারই একবারের জন্য হলেও বাসার গৃহকর্মিটিকে দেখে বড্ড মায়া হয়, অপরাধবোধ হয়। নিজেকে ঠিক তার জায়গায় মনে হয়, আর খারাপ লাগে এই ভেবে যে ওর কোন ছুটি নেই, তারা এখন ঠিকই বোঝে যে কী কষ্টের কাজ সে করে! সেই ভোর থেকে রাতে ঘুমানো অবধি ওর কাজ। তারা অভ্যাস বশে ভাত খেয়ে থালাটা টেবিলে রেখে উঠতে পারে না আর, ঠিকই নিজের প্লেট, কাপ ধুয়ে রাখে নিয়মিত। পরিবেশের কারণে মানুষ বদলায়, তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়, অসঙ্গতিগুলো চোখে পড়ে।

ঘরের মধ্যে নিজের পরিবারের মানুষের সাথে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা একজন বাইরের মানুষ থাকবে, যার সাথে আছে শ্রেণীভেদ, শিক্ষা, রুচি সবকিছুর ভেদাভেদ এই ব্যাপারটিও খুব একটা আরামদায়ক নয়। সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকা চুরি করলো নাকি, কোন পারিবারিক কথা শুনে ফেললো নাকি, কম বয়সী মেয়ে হলে কোথায় কোন ঝামেলা করলো, তাই চোখে চোখে রাখো, এগুলো সবই অস্বস্তিকর কাজ।

তবু আমরা এই প্রথা ভাঙতে ভয় পাই। আজকাল গৃহকর্মিদের বেতন গগনচুম্বী। কাজে পারদর্শী লোক পাওয়া যায় না। দেশে ফোন করলে যানজটের পরে দ্বিতীয় সমস্যা যদি শুনি বাচ্চাদের স্কুল, পড়ালেখা, তৃতীয় সমস্যা নিঃসন্দেহে গৃহকর্মি। এদেরকে পরিচালনা করতে গিয়ে গৃহকর্ত্রীর আয়ু অর্ধেক শেষ।
সর্বোপরি, আজকাল বিশ্বস্ত কোন মানুষ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এতো সবকিছুর পরেও আমরা ভাবতে পারি না আমাদের নিজেদের সংসারের কাজ আমরা নিজেরাই করবো! এ কথাটা বললেই জানি সবাই তেড়ে আসবে, ‘জানি, জানি, বিদেশে থেকে বড় বড় বুলি কপচানো সহজ।’ কেউ বলে ‘বিদেশের সব সিস্টেম আর, বাংলাদেশ কী এক হলো।’ হয়তো এক নয়ও, কিন্তু দেশের সিস্টেমকে নিজের মতো করে মানিয়ে নিন না। ভয় না পেয়ে, মাথা খাটিয়ে উপায় বের করুন। আর হ্যাঁ, এ ব্যাপারে অবশ্যই অবশ্যই বাড়ির কর্তা, ছেলে, মেয়ে সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।

দুটো উদাহরণ দেই। আমার মায়ের বয়স সত্তর, আর বাবা তেহাত্তর। ওনারা ঢাকায় একটি এপার্টমেন্টে শুধু দুজনে থাকেন। কোনো সার্বক্ষণিক গৃহকর্মি ছাড়া। আমার বাবা শুধু বাজার করেই দায়িত্ব সারেন না, আমার মায়ের সাথে সবজি কাটা, থালা বাসন ধোয়া থেকে শুরু করে বিছানার চাদর বিছানো পর্যন্ত সব কিছুতেই হাত লাগান। আমার মা এখনো বাসায় মেহমান আসলে ঘরে বানানো নাস্তা খেতে দেন। তবে ওনারা নিজেরা খুব সাধারণ খাবার খান। হয়তো দুটো আইটেম দুপুরে বা রাতে। এই বৃদ্ধ দম্পতি যদি পারে নিজেরা চলতে, অন্যরা নয় কেন?

আমার ছোট ভাই অনেক দিন বাইরে থেকে দেশে ফেরত গিয়েছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ফুল টাইম চাকরি করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে। দুটো ছোট বাচ্চা। ওরা ওদের বাসার সব কাজ নিজেরা করে কোন গৃহকর্মি ছাড়া। বাচ্চাদের কোনো প্রাইভেট টিউটরও নেই। সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই। বাচ্চাদের এবং নিজেদের খাদ্যাভ্যাসও সিম্পল করতে হয়েছে। করতে হয়েছে বিচক্ষণ রুটিন। তারপরেও তো পারছে।

তবে হ্যাঁ, একটি জায়গায় শুধু একটি জায়গায় আমার মনে হয়েছে ওদেরকে নির্ভর করতে হয় বাবা, মায়ের ওপর, সেটা হলো ওদের বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য যখন স্কুল বন্ধ থাকে, বা ছুটির পরে। এখন কথা হলো, ওরা এ ক্ষেত্রে ভাগ্যবান যে বাবা, মা বেঁচে আছেন, কাছেই আছেন এবং বাচ্চারা কিছুক্ষণ তাদের সাথে থাকার মতো শারীরিক অবস্থা তাদের আছে। অনেকেরই এই সুযোগটা নাও থাকতে পারে। আমি আমার এক ডাক্তার বান্ধবীকে দেখেছি চাকরি ছেড়ে দিতে, শুধু বাচ্চার দেখাশোনার লোক নেই বলে।

তাই বর্তমানে দেশে চাকরিজীবী মায়েদের সাহায্য করার জন্য দরকার স্বল্পমূল্যে উন্নত মানের, বিশ্বস্ত শিশু তত্ত্বাবধান কেন্দ্র বা ডে কেয়ার। বাড়ির বা সংসারের সব কাজ নিজে করা সম্ভব, কিন্তু একজন চাকরিজীবী মায়ের পক্ষে চাকরির বাঁধা সময়ে সন্তানের সঙ্গে থাকা, তাকে স্কুল থেকে ওঠানো, এগুলো রোজ রোজ করা সম্ভব নয়। একজন চাকরিজীবী মায়ের সন্তান হিসেবে এবং একজন চাকরিজীবী মা হিসেবে আমি জানি মায়েদের কাজের কোয়ালিটি, পরিমাণ সবকিছুই পুরোপুরি নির্ভর করে তার সন্তান কতখানি ভালো আছে, সেই মানসিক প্রশান্তির উপর। সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হলে ভালো মতো কাজ করা কোনো মায়ের পক্ষেই সম্ভব নয়।

ছোট ছোট শিশুদের জন্য উন্নত মানের ডে-কেয়ার প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে শহরের বিভিন্ন এলাকায়। এতো গেল একদম ছোট শিশুদের কথা। কিন্তু যারা স্কুলে যায়, তাদেরকে দিনের মাঝখানে অসময়ে স্কুল থেকে তোলাও বেশ কঠিন, বিশেষ করে যানজটের কারণে। স্কুলের পরের সময়টাতেই বা তারা কোথায় থাকবে? একটা সাত-আট বছরের বাচ্চাকে তো বাসায় একা রাখা যায় না। বিদেশে এসব বাচ্চাদের জন্য স্কুলেই আফটার কেয়ার এর ব্যবস্থা থাকে। এখানে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা নয়, স্বল্প বেতনে অন্য কর্মচারি থাকে। বাচ্চারা ওখানে খেলাধুলা করে, পড়ালেখাও করে। চাকরিজীবী বাবা-মা যাদের অন্য কোথাও বাচ্চা রাখা সম্ভব না, বা কাজের মাঝে বাচ্চা তোলাও সম্ভব না, এখানেই তারা বাচ্চাদেরকে রাখে নিরাপদে।

যেহেতু আমাদের দেশে নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে এখনো, আর আমরা ক্রমাগত চেষ্টা করছি তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, তাই আসুন তাদের বড় বড় সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করি, আর সেগুলো সমাধান করতে চেষ্টা করি।

শেয়ার করুন: