ধার্মিকতা যখন সোশ্যাল মিডিয়ায়

সানজিতা শারমিন:

আমার বাড়ি যেখানে তার আশেপাশে কোন হিন্দু ফ্যামিলি নেই। একটা আছে সেও অনেক দূরে। সেই কারণে তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আমার ধারণা শতভাগে দশ ভাগও নেই। স্কুলে যখন পড়ি, সেখানে যারা আছে তাদের সাথেও তেমন মেলামেশা হয়নি। যারা আমার ক্লোজ, তারা সবাই মুসলিম। ইন্টারেও একি অবস্থা, ক্লোজ ফ্রেন্ডরা সব মুসলিম। ঠিক কী কারণে আমার হিন্দু বন্ধু-বান্ধবী নেই, আমি জানি না। আমি মিশতে পারি না, নাকি তারা পারে না, তাও জানি না।

কিন্তু যখন আমি হায়ার এডুকেশন নিতে হোস্টেলে থাকতে গেলাম নিজ শহর থেকে অন্য শহরে, তখন আমি যে রুমে উঠেছি সেখানে চার জনের সিট। চারজনের মধ্যে তিনজন মুসলিম, একজন হিন্দু।
এই প্রথম আমি হিন্দু কারও সাথে শুধু মেলামেশা না, একেবারে এক রুমে আলাদা বিছানা থাকা সত্ত্বেও এক বিছানা প্রায়ই শেয়ার করি। একরুমে থাকার কারণে আমরা তিনজন পশ্চিম দিকে নামাজ পড়তাম, আর ও সন্ধ্যায় একই সাথে রাধাকৃষ্ণ ফটোগ্রাফের সামনে সন্ধ্যাবাতি জ্বালাতো।

পূজোর শপিং এ আমরা সাহায্য করতাম, ঈদে সে আমাদের করতো। পূজোতে বাড়ি গেলে নানা রকম মিষ্টি-নাড়ু নিয়ে আসতো শুধু আমাদের খাওয়াবে বলে। আমরাও ঈদে বাড়ি গেলে নানা রকম পিঠা নিয়ে আসতাম তাকে খাওয়াবো বলে। কোরবানির ঈদে স্বাভাবিকভাবেই কোরবানি করা গরুর মাংস মা দিয়ে দিতেন। কিন্তু ওর খারাপ লাগবে ভেবে আমরা রুমে না এনে তা হোস্টেলের ফ্রিজে রেখে নিচে ডাইনিং এ খেয়ে আসতাম। কোনভাবেই রুমে আনার কথা ভাবতাম না।
আমার মা-বাবা আমার যেমন খোঁজ নিতেন, তেমনি তার খবরও জিজ্ঞ্যেস করতেন। সেও মাঝে মাঝে বাবাকে বাবা বলে ডাকতো।

কখনো মনে হয়নি তার ধর্ম আলাদা, আর আমার ধর্ম আলাদা, তাকে আমার এভয়েড করা দরকার। আমার বিশ্বাস, সেও কখনো তা ভাবেনি। সে তার দেবদেবীদের গল্প শোনাতো, আমরাও আমাদের ধর্মীয় গল্প করতাম। কত সন্ধ্যা কেটেছে ছাদে বসে এই গল্প বলা আর শোনায়। এমনকি নামাজের সময় সে আমাদের ডেকে দিতো, ভাল লাগতো খুব আমাদের।

এই হোস্টেলে আরো চারজন হিন্দু মেয়ে ছিল। একজন সিলেটি ছিল। আমি আর সেই সিলেটি মেয়েটা খুব চা ভালবাসতাম, এখনো বাসি। তো, সে প্রায়ই চা খাওয়ার জন্য আমাকে তার রুমে ডেকে নিতো। সেই ডাকার সময় সে কি ভেবেছে আমি কেন একজন মুসলিম মেয়েকে চায়ের আমন্ত্রণ করবো? বা আমিই কি ভেবেছি সে হিন্দু? কখনো না, কোনদিন না।

আজ চাকরি করার সুবাদে কত হিন্দু দিদিদের সাথে উঠাবসা, একসাথে খাওয়া, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে। আমি সানন্দেই যাই, যেতে হয়। অফিসে কখনো হিন্দু বা মুসলিম বলে আলাদা করে দাওয়াত করা হয় না। এক সমাজে থাকি, এক কালচারে বাস করি। কে হিন্দু, কে মুসলিম, এই বিবেচনায় ঘরের বাইরে এক পাও ফেলার জো নেই।

কিন্তু তাই বলে আমি তাদের সংস্কৃতি ধারণ করেছি, তাদের ধর্মে কনভার্ট হবো, বা তাদের বিশ্বাস আমার কাছে চলে আসবে এমন ধারণা অমূলক।
আমার ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুভূতি এতোটাই ঠুনকো নয় যে তাদের সাথে মিশলে, বা চলাফেরা করলে আমি হিন্দু হয়ে যাবো বা তারা মুসলিম হয়ে যাবে।

যার যার জায়গায় আমরা ভালোই আছি। কেউ কারো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ নেই। জোরাজুরি নেই কোনো।

আমি রাধাকৃষ্ণ প্রেম কাহিনী জানলেই ভাগ্নের সাথে প্রেম করার মতো চিন্তা যেমন করবো না, তেমনি হজ করলে বেহেশত পাবে ভেবে হিন্দুরা হজ করা শুরু করবে না।
আমরা ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়াতেই বেশি করি। বাস্তবে না।

সত্যি বলতে আমি সামনাসামনি কখনো এর বহিঃপ্রকাশ দেখিনি। এমন কেউ কি আছেন যিনি এ সমাজে বসবাস করে একজন হিন্দু মানুষের ছায়াও মারাননি?
এমন কেউ নেই, একজনকেও খুঁজে পাবেন না।

আমি যে শিক্ষকের কাছে পড়েছি তিনি হিন্দু, যার কাছ থেকে মাস শেষে মাসকাবারি বাজার করি তিনিও হিন্দু, আমার এলাকার নামকরা ডাক্তার, যার চিকিৎসা ছোটবেলায় আমি নিয়েছি মরিমরি অবস্থায় তিনিও হিন্দু, যার আন্ডারে প্রথম চাকরি করেছি, তিনিও হিন্দু, এখন আমার কোয়ার্টার মেটও হিন্দু।
সেই থাইল্যান্ড থেকে আমার হিন্দু বান্ধবী আমার খোঁজ নেয়, উৎসবের ছবি শেয়ার করে। আমাকে ভালবাসে, তার ছায়া আমি দেখতে পাই সেখানে, আমি হিন্দু মুসলিম দেখি না।

একজন আমার আইডি ঘুরে এসে ইনবক্সে বললেন, আপনি হিন্দু আমি জানতাম না।
কী করে বুঝলেন আমি হিন্দু?
এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, আমার রাসমেলায় যাওয়ার ছবি দেখে বুঝে নিয়েছেন।
আমিও ভদ্রলোকের(!) আইডি ঘুরে এসে বললাম, ভাই, আপনিও যে হিন্দু আমি জানতাম না।
তিনি রেগে গেলেন আমার কথায়।

আচ্ছা ভাই মনিপুরী ড্রেস পরেই যদি আমি হিন্দু হই, তাহলে দুর্গা প্রতিমার সামনে আপনাকে দাড়িহীন দেখে হিন্দু ভাবা আমার কি ভুল??
এমন একজন নয়, অনেকেই কাছাকাছি কথা বলেছেন।

ভাই, ধর্ম এতোটা সস্তা না যে আমি টিপ আর জামাকাপড়ে নিজেকে জড়ালে হিন্দু হয়ে যাবো, তাদের প্রোগ্রামে এটেন্ড করলে তাদের বিশ্বাস আমার কাছে চলে আসবে। এই সত্য মেনে নিলে ভালো। আর যদি না মানেন, তাহলে
আপনি কি বলবেন…

আমি যে শিক্ষা হিন্দু স্যারের কাছ থেকে নিয়েছি, তার শিক্ষা মুছে ফেলবো জীবন থেকে?

হিন্দুদের সাথে চাকরি করি বলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্যের কাছে হাত পেতে টাকা চাইবো নিজের খরচ চালাতে?

আমার জ্ঞানকে এনরিচ করতে আমার ধর্ম আর অন্য ধর্ম কেন আলাদা, সেটা বোঝার জন্য যে জ্ঞান থাকা দরকার, তা আমি নেবো না? অন্ধ থাকবো?

আমি আলাদা একটা মুসলিম সমাজ গড়বো, সেখানে আপনি আর আমি থাকবো?

হিন্দুদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিব?

তারা অসুস্থ হলে তাদের সেবা দেবো না?

তাদের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে মজা করবো?

এর একটাতেও যদি আপনার উত্তর হ্যাঁ হয় তাহলে আপনি একটা মূর্খ। সত্যিই মূর্খ। আপনার জানার বা বোঝার অনেক কিছু এখনো বাকি আছে।

আপনি আগে নিজের ধর্ম দেখুন সেখানে কী লিখা আছে, কী করতে বলা হয়েছে!
মানুষই হতে পারেননি, ধার্মিক কেমনে হবেন?

(বাস্তবে আপনি আমারই মতো, ফেইসবুকে শুধু জোর করে ধর্মীয় বাণী)

শেয়ার করুন: