দ্বৈত সত্তার অস্তিত্ব ও একজন হুমায়ূন আহমেদ

শামীম রুনা:

একজন মানুষ প্রতিদিন বাঁচছে, খাচ্ছে দাচ্ছে, অফিসে যাচ্ছে বা বাঁচার জন্য যেসব কাজ করতে হয় সব করছে। কাজের ফাঁকে বা প্রধান কর্ম মনে করে প্রেম করছে, বিয়ে করছে বাচ্চাও পয়দা করছে। বিশ্ব সমাজ সংসারের কোনো কাজে তার কোনো গাফিলতি নাই।

এতো সব কিছুর পরও, কোথাও যেন সে বারবার হারিয়ে যায়! সবকিছু থেকেও কী যেন নাই জীবনে … ইচ্ছা করে, সমাজ সংসার সবকিছু থেকে পালিয়ে যায়। বুকের ভেতর শীত ঘুমে কাতর ভয়াবহ দীর্ঘ এক হাহাকার করা সাপ আজীবন বয়ে চলে। এই সাপের কথা সে ছাড়া আর কেউ জানে না, কেউ হয়তো কখনও জানবেও না। বুকের ভেতর এতো ভার, তবু মানুষ হাসি মুখে সংসার করে, লৌকিকতা রক্ষার নামে কেবলই মুখোশ বদলায়, খোলস পাল্টায়।

কোনো এক সময় মানুষটি হয়তো এরকম একটি আলাভোলা গতানুগতিক জীবন যাপন করার স্বপ্ন দেখে নিজেকে তৈরি করেছিলো। কিন্তু আজ এই কাঙ্খিত জীবন তার কাছে লবনহীন বিস্বাদ, অতি সাদামাঠা! এই প্রাণহীন জীবনের জন্য কী একটা জীবন বেঁচে থাকা! পা ঘেঁষটে ঘেঁষটে পাথুরে উপত্যকায় টেনে হিঁচড়ে চূড়ায় উঠার আপ্রাণ চেষ্টা! চূড়ায় উঠে কী হয়? যখন নিজের মনের নতুন স্বপ্নগুলোকে ক্রমাগত গলা টিপে কেবলই হত্যা করতে হয়! যাপিত জীবনকে ত্যানা ত্যানা মনে হলেও তা রাজ পোষাকের মতো করে পরে মিথ্যা অহম দেখাতে হয়! বেঁচে থাকা বড়ো অদ্ভূত এক দশার নাম, কোথাও নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার নাই।

“ডুব” সিনেমায় দেশের সকলে এখন ধুমায়া ডুব দিচ্ছে। সিনেমা ভালো হয় নাই বলে অনেক দর্শকের মন্তব্য। তারপরও প্রতিদিন হলে নতুন নতুন দর্শক যাচ্ছে, তারা বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বায়োগ্রাফি দেখতে চায় বলে অনেকের না পছন্দ সিনেমাটিকে নিজ চোখে দেখতে যায়। যদিও পরিচালক বলেছেন, এটা হুমায়ূন আহমেদের জীবনের গল্প না, তারপরও দর্শক তা মানছে না। আমরা তো জানি, হুমায়ূন আহমেদ কতটা জনপ্রিয় লেখক ছিলো আমাদের দেশে!

সিনেমা কতটা কী বানিয়েছে, না বানিয়েছে, জানি না, সিনেমা দেখার সুযোগ যখন হবে তখন নিশ্চয় জানতে পারবো, তবে এই মুহূর্তে “ডুব”-এর দর্শকদের আলোচনা পর্যালোচনা পড়ে মনে হইতেসে, হুমায়ূন আহমেদের মতো মানুষের আমাদের দেশে জন্মানোটা ঠিক হয় নাই, বা তার মতো মানুষজনকে আমাদের লৌকিক সমাজ ঠিক মেনে নিতে চায় না। এই ধরনের মানুষের মতো হইতে মনে অনেকের সাধ হয়, কিন্তু আবার অন্য কাউকে এই রূপে দেখলে সহ্য হয় না। বার বারই এইসব মানুষের ওপর সমাজ অনেক বানানো রীতিনীতি চাপিয়ে দিয়ে তাদের বশ করতে চায়।

এই ধরনের মানুষজনের ভালোবাসার ক্ষমতা অনেক বেশি। আমার মনে হয়, চাইলেই কেউ ভালোবাসতে পারে না, ভালোবাসারও ক্ষমতা লাগে। মাকে ভালোবাসা, ভাইবোনদের ভালোবাসা, প্রেমিকা, স্ত্রী-সন্তান বা বন্ধুদের ভালোবাসা, দেশ, রাস্তা বা কোনো একটি বিশেষ খাবারকে ভালোবাসার মধ্যেও ম্যাজিক আছে। এই ম্যাজিক ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে লেখক হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি ছিলো বলে তিনি এমন ক্যারিশমাটিক লেখক হতে পেরেছিলেন। আর এই ধরনের মানুষগুলোর বিশেষ গুণগুলোর ওপর সমাজ বাঁধা নিয়ম চাপিয়ে দিয়ে ভাবে, তারা এর বাইরে যাবে কেন, সমাজের বানানো ডায়াসের ভিতর থাকতে হবে!

মানুষ প্রেমে পড়ে, প্রেমিক বা প্রেমিকারে বিয়ে করে সুখের সংসার পাতে। আর একবার বিয়ে নামক ইনস্টিটিউশনে ঢুকলো মানে সমাজ ধরে নেয়, এই ইন্সটিটিউটের বাধ্য ছাত্রছাত্রী হয়ে বাকি জীবন পার করতে হবে, তা জীবন সঙ্গীকে ভালোবাসুক কী মন্দ বাসুক। হাজার খিটমিট নিয়ে সংসার করে যেতে হবে তাদের। যে মানুষের একবার প্রেমে পরার ক্ষমতা আছে, তার জীবনে বার বার প্রেম আসতে পারে!

আমাদের সমাজ ইউরোপ-আমেরিকার মানুষজনের এমন জীবনযাপন দেখে অভ্যস্ত, কিন্তু নিজের দেশের মানুষের বেলায় হা হা করে ওঠে। কেন? মানুষের ভালোবাসার পারদও কি ভৌগলিক রেখার ওপর ভিত করে গড়ে ওঠে নাকি?
যারা ভালোবাসায় বাঁচে তাদের জীবনে প্রেম বারবারই আসার কথা। কেউ হয়তো নিজের সে প্রেম ভালোবাসা গোপন করতে পারে, কেউ পারে না। আমরা যদি হুমায়ূন আহমেদের কথা ধরি, তার জীবনে গুলতেকিনের আগে-পরে আর কেউ যে আসে নাই, সে খবর আমরা যেমন জানি না, তেমনি শাওনের আগে-পরেও কেউ ছিল না, তার খবরও আমাদের অজানা।

আর শাওনকে বিয়ে করার পর তিনি প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনরে ভুলতে পেরেছিলেন কিনা সে কথাও বা কেমনে বলি দর্শক সারিতে বসে থাকা আমরা! এই দুই নারীর বাইরেও তিনি মা, ভাইবোন, আগের সংসারের সন্তানদের ভালোবেসেছিলেন। দ্বিতীয় সংসারেও তার দুই সন্তান আছে, সবার জন্যই তার অপার ভালোবাসা ছিল। তাকে ঘিরে এতো যে প্রেম ভালোবাসা, পাওয়া না পাওয়ার সম্পর্কের গোলকধাঁধা, তা কি সিনেমার সেলুলয়েডের ফিতায় যথাযথ উঠে আসতে পেরেছে? তার ভেতর সম্পর্কের ভাঙা গড়া নিয়ে যে মানসিক বিপর্যয় চলেছিল, তা কি আদৌ অন্য কারো পক্ষে সহজেই বোঝা সম্ভব? না নিজের ভেতর এই দ্বৈত সত্ত্বার একজন মানুষ নিজেই একা বয়ে চলে?

আর আমার এইখানে এসে মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদের জীবনের দ্বৈত সত্ত্বার অস্তিত্বের কথা। আমার মনে হয়, তার মতো ভালোবাসতে পারা মানুষেরা জীবন থেকে কাউকে বিচ্ছেদ করতে পারেন না, কেবল জুড়তেই পারেন। কাউকে যখন সে বিচ্ছেদ করতে পারে না, তখন অন্যরা রাগে-অভিমানে-দুঃখে তাকে ছেড়ে যায়, তখন সে মানুষটি এখানে এসে একজন পুরোপুরি নিঃস্ব আর অভিমানী মানুষে পরিণত হয়।

যে মানুষটি ভালোবাসতে পারে, তার ভালোবাসার ক্ষমতা অনেক বেশি, তা কখনও এক জায়গায় এসে শেষ হওয়ার যেমন নয়, তেমনি নতুন প্রেম বা সম্পর্কের জন্য পুরনো সম্পর্কগুলোও বিস্মৃত হওয়াও তার পক্ষে সম্ভব না। আবার আগের সম্পর্কের দোহাই দিয়ে নতুন কোনো সম্পর্ক জীবনে আসবে না, তা কে কী করে বলে? এটাও তো এক ধরনের হৃদয়ের দাবিকে উপেক্ষা করা।

সমাজের নিয়ম নামের এই যাঁতাকলে তার মতো সৃজনশীল মানুষের জীবন থেঁতলে যায়। তাকে নিয়ে কী ভয়ঙ্কর টানা হেঁচড়া চলেছে ঘরে বাইরে, তিনি কার সঙ্গে সংসার করবেন, আর কার সঙ্গে সংসার করবেন না, তাতে তার যতটা না অধিকার ছিল, তার চেয়ে ভক্তকুলের অধিকার বেশি বলে সাধারণ পাবলিক মনে করতো।

অথচ তিনি কিন্তু এক দ্বৈত সত্ত্বার জীবন যাপন করছিলেন বলে আমার মনে হয়। কেউ চাইলে যেমন পুরনো সম্পর্কগুলো ভুলতে পারে না, তেমনি করে নতুন ভালো লাগা বা নতুন সম্পর্ক তৈরি না করেও থাকা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ আমরাই ধারণা করে নেই, জীবনের এক পর্যায়ে এসে মানুষের উচিত, নতুন সব ধরনের সম্পর্ক থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, তা আদৌ কি সম্ভব?

শেয়ার করুন: